আসলে করোনা ভাইরাস নিয়ে এতো বেশি লেখা হচ্ছে যে কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা তা নিয়ে আমাদের অনেকেই কনফিউজড হয়ে গিয়েছি, কিন্তু কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাস কি এখন আমরা সবাই জানি।

করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি চীনের উহানে হলেও বর্তমানে এ ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর ১৭৭টা দেশে, এই মুহূর্তের হিসাব অনুযায়ীঃ

বাংলাদেশে আক্রান্ত ২৪, সুস্থ ৩, মৃত্যু ২।
বিশ্বে আক্রান্ত ২,৩৪,০৭৩, দেশ ১৭৭, মৃত্যু ৯,৮৪০।


তাহলে অবস্থা কতটুকু খারাপ তা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন।

অথচ আমরা সবাই চীনকে গালাগাল দিচ্ছি করোনা ভাইরাসকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, কিন্তু সেই চীনই ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে এই করোনা ভাইরাসকে নির্মূল করতে, একদল অতিমানবের দিন রাত অক্লান্ত ঘুমহীন সেবা আর চিকিৎসার কারণে চীনের উহান আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, গত দুইদিন ধরে সেখানে আর কোন নতুন লোক করোনায় আক্রান্ত হয়নি, ৩৭ জন নতুন করে করোনা ভাইরাস নিয়ে সেখানে ঢুকেছে, তারা করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয়ে গেছে।
এখন তারা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্ব জয়ে, কিছুদিনের মধ্যে দুনিয়া-কেও তারা জয় করে ফেলবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

সবচেয়ে বিপদজনক অবস্থায় পড়েছে ইটালি, ইউরোপের উন্নত দেশ গুলোর মধ্যে ইটালি পর্যদুস্ত হয়েছে করোনা আক্রান্তদের নিয়ে, বিশ্বের সবচাইতে বেশি মৃত্যুবরণ করেছে এই ইটালিতেই, অথচ এর আতুর ঘর চীনে তেমন মানুষ মরেনি যা ইটালিতে মরেছে, এর কারণও আছে।
শুধু মাত্র হেলাফেলা করার কারণে ইটালিতে করোনা আক্রান্ত এবং মৃত্যু সবচাইতে বেশি, যখন সে দেশে মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছে, তখনো সুস্থ রা ড্রিংক্স বারে জমা হয়ে মদ গিলছে, শুধু মাত্র একটা চার্চ (গির্জা) থেকেই হাজারে হাজারে সংক্রমিত হয়েছে, তাহলে বুঝুন কি অবস্থায় না হয়েছে।

এই মুহূর্তে পুরা বিশ্বের মায় বাপ খ্যাত আমেরিকা জুজে চলেছে করোনা আক্রান্তদের নিয়ে, ফ্রান্স, সৌদি আরব, কুয়েত, ইরান, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, ভারত সহ ১৭৭টি দেশ বিপদ পারদের সর্বোচচ শিখড়ে, সবাই যেন এক যুদ্ধ অবস্থায় বিচরণ করছে, পৃথিবীর অনেক দেশ এখন লক-ডাউন অবস্থায় আছে।

এখন আসি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেঃ

খেয়াল করুণ, উহান, হুবেই তথা চীনে যখন এই করোনা রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লো তখন বাংলাদেশ সরকার নিজ দায়িত্বে প্রায় দেড়শ জনের কাছাকাছি বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনে নিজ দেশে এবং তাদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয় আশকোনার হজ্ব ক্যাম্পে, তাদের মধ্যে কয়েকজনকে কুর্মিটোলা হাসপাতালেও ভর্তি করা হয়, কিন্তু চৌদ্দ দিন পর তাদেরকে সুস্থ থাকায় বাড়িতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু ইটালিতে করোনা ছড়িয়ে পড়াতে ওখান থেকে হঠাৎ করে বেশ অনেক বাংলাদেশি প্রবাসী ফেব্রুয়ারীর শেষ দিকে এমিরেটস এয়ারলাইনস ভর্তি করে আসতে শুরু করে, তখন সরকার তাদের হজ্ব ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং সেখানেই এই প্রবাসীদের হম্বিতম্বি দেখে, তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকবে মুচলেকা নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে দেয়, এর পিছু পিছু আরও প্রবাসী ইটালি, সৌদি আরব, আরব আমিরাত সহ বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরে আসতে থাকে এবং তাদেরকেও হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়।

আমরা বাঙ্গালী জাতি, কখনো কি কারো কথা শুনেছি না মেনেছি? আমাদের ভাব সবসময় থাকে যেমন কি "হামারা বাপ সুলতান থা" (আমার বাবা রাজা ছিলো), তেমনি অবস্থা হলো এই প্রবাসী বাঙ্গালীদের। তারা কেউ বাড়ি ফিরেই বিয়ের পিঁড়িতে, কেউ বিয়ের শপিং, বাজার সদাই করছে, কেউ চায়ের দোকানে, বাজারে আড্ডা মারছে, অতি মুসল্লি যাচ্ছে মসজিদে।
আজ দেখুন কতজনকে তারা আক্রান্ত করলো এই কোরানা ভাইরাসে।

মাত্র তো আক্রান্ত করা শুরু হলো, মাত্র তো চব্বিশ জন্য আর মারা গেলো মাত্র দুইজন।
আরেহ না ভাই, বিশেষজ্ঞরা বলছেন আগামী চব্বিশ দিন হলো ডেঞ্জার পিরিয়ড, এ সময় করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক ভাবে বেড়ে যাবে, বাড়বে মৃতদের সংখ্যা।

এখন তাহলে কি করা উচিত আমাদের?

চীন                                            বাংলাদেশ                                           ইটালি

আমি কোনো বিশেষজ্ঞ নই, নই আমি ডাক্তার কিন্তু আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যা করা উচিত বলে মনে করি তা হলো যথাক্রমেঃ

১) এই মুহূর্ত থেকেই আমাদের আর কোনো ভুল করা যাবেনা, সামান্যতমও নয়। যদি ভুল হয় তাহলে এর খেসারত আমাদেরকে জীবন দিয়ে দিতে হবে।
২) এই মুহূর্তেই বাংলাদেশ সরকারের উচিত সকল বিমান চলাচল বন্ধ করা, সকল বর্ডার সিল করে দেওয়া, যাকে ইংরেজিতে বলে No ins, no out.
কাউকেই এই দেশে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবেনা এবং বের হতে দেওয়া যাবেনা।
৩) সকল ধরণের জমায়েত, মিছিল, মিটিং বা যেখানে প্রচুর মানুষ জমায়েত হতে পারে তা বন্ধ করা, যার কিছু কিছু করাও হয়েছে।
৪) সকল ধরণের শপিংমল, শপিং এরিয়া শুধু মাত্র খাদ্য দ্রব্য বিক্রি হয় এমন বাজার ছাড়া সকল কিছু বন্ধ ঘোষণা করা উচিত।
৫) যত ফেরত প্রবাসী এসেছেন তাদের বাড়িঘর পুলিশ, আনসার, বিজিবি দিয়ে ঘেরাও করে রাখা উচিত, তাদের বাধ্য করা উচিত যেন তারা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকে।
৬) যারা অমান্য করবে, তাদের দৃশ্যপটে এনে, বেঁধে পিটিয়ে সবার জন্য শিক্ষণীয় উদাহরণ সৃষ্টি করা উচিত।

এখন আসি হাসপাতালের বিষয়ে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত জরুরী ভাবে বিমানে করে বিদেশ থেকে নিম্নলিখিত বিষয় গুলো নিয়ে আসা, যার জন্য No tender, no work worder, no permission এর ব্যবস্থা করতো জরুরী ভাবে হাসপাতাল গুলোতে দেওয়া উচিত।

১) কয়েকশো লাইফ সাপোর্ট ইউনিট, কয়েকশো সিসিইউ, আইসিইউ ইউনিট যা করোনা ভাইরাস ছাড়াও অন্যান্য রোগের রুগীদেরও কাজে লাগবে।
২) দ্রুত দেশের সকল ডাক্তার নার্সদের জন্য পিপি (পার্সোনাল প্রটেক্টিভ স্যুট) দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
৩) জরুরী ভাবে করোনা আক্রান্তদের সুস্থ করার প্রয়াসে যা মেডিসিন এবং ছোটোখাটো ইকুইপমেন্ট নিয়ে আসা উচিত।
৪) শুধু মাত্র দুই চারটা হাসপাতাল নয়, জরুরী ভাবে বাংলাদেশের সকল হাসপাতাল গুলোতে অধিক পরিমাণে করোনা ইউনিট গঠন করা উচিত।
৫) চীন সরকার যেহেতু ফাইটিং করোনার জন্য তাদের ডাক্তার, নার্স ইত্যাদি পাঠাতে চেয়েছে, তা দ্রুত এবং জরুরী ভাবে এনে আমাদের ডাক্তার নার্সদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৬) দ্রুত উল্লেখযোগ্য হারে কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশনের জন্য স্থান নির্ধারণ এবং নির্মাণ করা।
৭) দরকার হলে দেশের আর্মির সহায়তা নিতে হবে।

উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলোতে কোনো কম্প্রোমাইজ করা উচিত হবেনা।

এখন আসি আমরা সাধারণ জনগণের কি করা উচিত, খেয়াল করুণ এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই, তাহলে আমরা কি করবো?

১) আমাদের উচিত যথাসম্ভব নিজেদেরকে গুটিয়ে নেওয়া, সকল ধরণের সামাজিকতা থেকে, আড্ডা থেকে দূরে থাকুন, কারণ আমাদেরকে বাঁচতে হবে, খেয়াল করুণ, নিজেকে বাঁচাতে হবে।

২) খেয়াল করুণ, ইতিমধ্যে আসা সকল প্রবাসীদের কে বলছি, প্লিজ আপনারা যা করার করে ফেলেছেন আর করবেন না, দয়া করে আপনার নিজ স্বার্থে, নিজের বউ বাচ্চা, বাবা মা, ভাই বোনদের জন্য হলেও নিজ ঘরের একটা রুমে নিজেকে আগামী চৌদ্দ দিনের জন্য আবদ্ধ করে রাখুন, নিজে বাঁচুন, অন্যদেরকেও বাঁচতে দিন।

৩) সকলের উচিত ঘরে বাইরে যেখানেই থাকুন নিজের চোখে, মুখে, নাকে হাত দেবেন না, এতে করোনা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সমূহ চান্স থাকে।

৪) ঘনঘন হাত ধোয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করুণ, এতে আপনি করোনা আক্রান্ত হতে বেঁচে যাবেন।

৫) ঘরে বাহিরে খেয়াল করুণ, ঘরে বা বাইরের কারো দরজা, কলিংবেল, লিফটের বোতাম, ইলেক্ট্রনিক সুইচ, ইলেক্ট্রনিক আইটেম, মোবাইল ফোন ইত্যাদি পরিষ্কার রাখুন বিশুদ্ধ করার মেডিসিন দিয়ে। কিছু ধরতে হলে একবার ব্যবহারযোগ্য হ্যান্ড গ্লাভস, টিস্যু দিয়ে ধরুন এবং একি জিনিস দ্রুত প্লাস্টিকের ব্যাগে রাখুন এবং দ্রুত তা আবার জ্বালিয়ে ফেলুন, খেয়াল রাখতে হবে তা যেন একবারের বেশি ব্যবহার নাহয়।

৬) প্রতিদিনের পরিধানের কাপড় প্রতিদিন ধুয়ে ফেলুন, প্রতিদিন ব্যবহার্য ফেইস মাস্ক প্রতিদিন জ্বালিয়ে ফেলুন অথবা ধুয়ে ফেলুন গরম পানিতে।

৭) ব্যবহার করা টিস্যু, মাস্ক কখনোই ব্যাগে, পকেটে খোলা রাখবেন না বা বাইরে রাস্তাঘাটে, ডাস্টবিনে না ফেলে তা প্লাস্টিকের ব্যাগে রাখুন এবং পরে জ্বালিয়ে ফেলুন।

৮) কারো সাথেই, আবার বলছি কারো সাথে কোলাকুলি, হ্যান্ডশেক করবেননা বা গা ছোঁয়াছুঁয়ি থেকে বিরত থাকুন।

৯) থুথু কাশি হলে বা কফ রাস্তাঘাটে, এদিকে সেদিকে ফেলবেন না, জানেন তো এইসব থেকেই করোনা ভাইরাস ছড়ায়।

১০) হাঁচি আসলে দুই হাত দিয়ে মুখ না ঢেকে, হাতটিকে বাঁকা করে ইংরেজি V অক্ষরের মতো করে V এর মাঝে বা মাঝ বরাবর হাঁচি দেন, এতে আপনার হাতে তালু থেকে করোনা রোগ ছড়াতে পারবেনা এবং যত দ্রুত পারুন আপনার হাত, কাপড় ধুয়ে ফেলুন।
এ ছাড়া হঠাৎ হাঁচি এলে খোলাখুলি ভাবে হাঁচি দেবেন না, যেভাবে বলেছি সেভাবেই হাঁচি দেবেন।

১১) জ্বর, সর্দি কাশির সিজন হলেও খেয়াল রাখবেন জ্বর, সর্দি কাশি হয়েছে, তাহলে দ্রুত অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা একটা রুমে আবদ্ধ করে নিন। অন্যদের থেকে কমছে কম ছয় হাত দূরে থাকুন, বলে দিন আপনার খাবার দাবার, মেডিসিন সব দরজার সামনে রেখে যাবে, ওরা চলে গেলে আপনি নিয়ে নেবেন, আপনার নিজের ব্যবহৃত বাসন, প্লেট, বাটি, চামুচ সব আলাদা রাখুন, নিজেই পরিষ্কার করে কাছেই রাখুন, খাবার দাবার দেওয়ার সময়, এবং বাসন কোসন  নেওয়ার সময় সেইসব গ্লাভস পরিধান করুণ।
দ্রুত হটলাইনে যোগাযোগ করে হাসপাতালে যাওয়ার ব্যবস্থা নিন বা ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুণ।

১২) ঘনঘন কুসুম গরম পানি, এন্টি অক্সিডেন্ট আছে এমন ধরণের খাবার খান। ফল খান বা অসুস্থ হলে জুস খান, ওটস, লেবু পানি, কমলা, আপেল, টমেটো স্যুপ খান, গাজর খান বা জুস খান, এইসবে করোনা থেকে মুক্তি পেতে পারেন।

সব শেষে অনুরোধ করছি, পারলে নিজেরা আগামী কিছুদিন ঘরে থাকুন যাকে বলে সেল্ফ কোয়ারেন্টাইন করা, নিয়ম করে রাতে ঘুমান (কমছে কম আট ঘন্টা ঘুমান), পুষ্টিকর খাদ্য খান, গণপরিবহন এড়িয়ে চলুন, নিজে বাঁচুন, দেশকে বাঁচান।

আল্লাহ রহমানুর রহিম আমাদের সকলকে নেক হায়াৎ দান করুণ, আমীন।

ছবিঃ গুগল।

0 Shares

৩৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ