"জন এফ কেনেডি" এয়ারপোর্ট। গিয়েছিলাম বন্ধুর বাবা-মা'কে বিদায় জানাতে। দু'মাস বেড়ানো শেষে তাঁরা ফিরে যাচ্ছেন দেশে। প্রিয়জনদের বিদায় জানিয়ে যাত্রীরা সিকিউরিটি চেকিং এরিয়ার দিকে যাচ্ছে একে একে। সমস্যা বাঁধলো বৃদ্ধা এক যাত্রীকে নিয়ে। ৬/৭ বছরের ছোট্ট মেয়েটিকে কিছুতেই দাদু'র কোল থেকে নামানো যাচ্ছিলো না। গলা জড়িয়ে প্যচিয়ে ধরে আছে। কাঁদছে। ও দা- দু যেওনা ... বলে গগনবিদারী কান্না। অনেকটা জোর-জবরদস্তি করে দাদুর কোল থেকে ছাড়িয়ে নেয় মেয়েটিকে তাঁর বাবা, মা। একদিকে শিশুটির বাবা-মা কাঁদছে। অন্যদিকে বৃদ্ধা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে সিকিউরিটি চেকিং এরিয়ার দিকে যাচ্ছে__ সে এক বেদনা বিধুর থমথমে পরিবেশ। সেদিন সেখানে আমরা যারা দাঁড়িয়ে ছিলাম প্রায় সবার হৃদয়কে নাড়া দিয়েছিলো দাদু- নাতনির বিচ্ছেদ কালীন কান্না। কি অদ্ভুত মায়ার সম্পর্ক !
এদিকে আমরাও বন্ধুর বাবা-মা'কে বিদায় জানিয়ে হাঁটছি পার্কিং লটের দিকে। সঙ্গে বন্ধু, তাঁর স্ত্রী আর ৭/৮ বছরের ছেলে। বললাম, "আপনার ছেলেরও নিশ্চয়ই এমনই খারাপ লাগছে দাদা-দাদু'র জন্যে... হয়তো প্রকাশ করতে পারছে না।" বন্ধু পত্নী মৃদু হেসে জানালেন__ আমার ছেলে খুশি... একটু আগেই সে বলেছে, "ভালোই হলো এবার আমরা আরাম করে থাকতে পারবো" ! দাদা- দাদী থাকাতে তাঁদের "আরাম করে থাকা"য় কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে বৈকি ! কি অদ্ভুত বৈপরীত্য !
বাড়ির উদ্দেশ্যে ফিরছি। গাড়ি হাইওয়ে ধরে ছুটে চলছে। কানে বাজছে ছোট্ট মেয়েটির কান্না __ ও দা-দু যেও না...
চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো __ অনেক বছর আগে এদেশে আসবার সময়টাতে দাদু'র সাথে দেখা করতে গ্রামে যাই। দাদুকে আমরা "বু" ডাকতাম। আমি বিদেশ চলে যাচ্ছি বিধায় পরিবারের সকলের বিষণ্ণ মন। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে লাঠি ভর করে হেঁটে হেঁটে আমার বু অনেকটা পথ এসে দাঁড়িয়েছিলো। বয়সের ভারে নুইয়ে থাকা মানুষটি ঠায় দাঁড়িয়েছিলো, আমি তাঁর দৃষ্টিসীমায় মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত।
একের জন্যে অপরের ভেতরটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া এক সম্পর্ক...
মায়া-মমতা আর ভালোবাসায় মিশে থাকা পারিবারিক মূল্যবোধের সম্পর্ক...
সম্পর্কগুলো তো এমনই হবার কথা, তাই না ?
২১টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
আপু আমাদের সময়টা বেশ ছিলো। আসলে এসব দেশে একা একা বড়ো হয়, তাছাড়া অনেক পরিবার সেই শিক্ষাটুকুও দেয়না। জানো এই হ্যামিল্টনে এসে তিনটি মাস আমি আমার বান্ধবীর বাসায় ছিলাম। ওর মেয়ে আমায় ওর রুম ছেড়ে দিয়েছিলো। অথচ এ দেশে জন্ম-বড়ো হয়েছে। আর ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে, তাও কখনোই ওর মাকে জিজ্ঞাসা করেনি নীলা আন্টি কবে যাবে! বরং যেদিন নতূন বাসায় উঠি ওর কথা আরোও কিছুদিন কেন থেকে যাচ্ছিনা?
এসব শিক্ষা পরিবার থেকে দিতে হয়। আমাদের দেশে এক সন্তান থাকলে সেও প্রায় এমন হয়।
তোমার এসব পোষ্ট অসাধারণ -{@
রিমি রুম্মান
আসলে পরিবারই প্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক।
প্রার্থনা রইলো ভাল হয়ে উঠো তাড়াতাড়ি ।
নীলাঞ্জনা নীলা
-{@
ছাইরাছ হেলাল
সম্পর্কগুলো যা ছিল, যেমন থাকার কথা ছিল, কেন জানি তা তেমন থাকলো না।
সব কিছুই ঘটে যাচ্ছে চোখের সামনে, যেখানে সামান্য দর্শক মাত্র।
রিমি রুম্মান
সম্পর্কগুলো এমন হওয়া উচিত নয়। আমি আমার আগের প্রজন্মকে সন্মান করলে আমার পরের প্রজন্ম আমার কাছ হতে শিখবে, সন্মান করবে__ আমার বিশ্বাস ।
আবু খায়ের আনিছ
আপু দূরবীন এ হেমকান্তের ভাবনার কথা মনে আছে, পরিবার আত্বীয় নিয়ে। এর বাইরে আর কি বলার আছে।
এই শিক্ষাগুলো কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয় এগুলো পরিবার থেকেই শিক্ষা দিতে হয়।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। পরিবারই সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক।
জিসান শা ইকরাম
জীবনে আমরা প্রায় সবাই শুধুই বেঁচে থাকি
ভালো খাই,পড়ি,ভালো বাসাবাড়িতে থাকি,ভালো গাড়িতে চরি
ভাবি এটিই জীবন
খুব একটি তাকিয়ে দেখি না,বা শুধুই দেখে যাই…… কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনা আমাদের মাঝে।
আপনি এসব দেখেন
দেখেন বলেই আপনার সামনে এমন বৈপরীত্য আসে
আপনার এই দেখার চোখকে শ্রদ্ধা জানাই।
একের জন্যে অপরের ভেতরটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া এক সম্পর্কের মাঝে থাকার আনন্দ অন্য যে কোন আনন্দের তুলনায় সেরা
তুলনা হয় না এমন আনন্দের।
শুভ কামনা।
রিমি রুম্মান
আমি যা দেখি, আমার লেখায় সেইসব অন্যদের দেখাতে চাই। আর তাই হয়তো বারবার এমন বিষয়গুলো সামনে না এনে পারিনা।
ভাল থাকুন। শুভকামনা।
ব্লগার সজীব
একই ঘটনার সাদা এবং কালো দুটোই দেখলাম আপনার লেখায়।পারিবারিক বন্ধনটি কতইনা মধুর। (y)
রিমি রুম্মান
পারিবারিক বন্ধন কেন যেন হারিয়ে যেতে বসেছে আজকাল। অথচ এটি কতই না জরুরী আমাদের জন্যে।
নাসির সারওয়ার
পারিবারিক মূল্যবোধ সে তো পরিবার থেকেই তৈরি হয়। আপনার দৃষ্টি একটু প্রকট বলেই হয়তো আপনাকে এই বৈপরীত্য ভোগায়।
অনেকটা অসহায় হয়েই দেখতে হচ্ছে এই অবক্ষয়।
রিমি রুম্মান
মানবীয় অনুভূতি আমাদের সকলেরই আছে। শুধু এর যত্ন নেই। শুধু আমার আমার করেই আমাদের সময়গুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে।
অনিকেত নন্দিনী
লেখাটি পড়ে নিজের অতীত ঝলকে উঠলো। দাদা-দাদু থাকতেন গ্রামের বাড়িতে। যেদিন বাড়ি যেতাম সেদিন দেখতাম বাড়ির বাইরের উঠানে ঘোমটা টেনে দাদু দাঁড়িয়ে আছেন। বাড়ির গেট পেরোতেই হাসিমুখে দুহাত বাড়িয়ে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতেন, “বুবু, আইছো?” আমরা বাড়ি যাচ্ছি এইটা কেমন করে টের পেতেন সেই রহস্য আজো উদ্ধার হয়নি। ফিরে আসার সময়ে যাবার দিনের বিপরীত দৃশ্য দেখতাম। দুজনেরই চোখ ছলছল। দুজনেই কান্না লুকাবার চেষ্টা করতেন আর বলতেন, “স্কুল/কলেজ বন্ধ হইলে আবার আইসো বুবু”। বহুদূর এসেও পেছনে তাকিয়ে দেখতাম তাদের দেখা যায় কিনা, তারা হাত নাড়ছে কিনা। ঝাপসা চোখে ভালো দেখতে পেতামনা।
সন্তানের বড় শিক্ষক তার বাবা-মা। একটি পরিবারে বাবা-মা যাদের সত্যি সত্যি শ্রদ্ধা করে, সন্তানেরা তাদের সাধারণত অশ্রদ্ধা করতে পারেনা। পরিবার ও সম্পর্কের মূল্যবোধ তো বাবা-মাকে দেখেই শেখে বাচ্চারা।
একের জন্য অপরের ভেতরটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া সম্পর্কের অনুভূতি নিয়ে বড় হয়েছেন বলেই বৈপরীত্যগুলি বেশি করে চোখে ঠেকে।
ভালো থাকবেন আপু। শুভকামনা।
রিমি রুম্মান
সন্তানের বড় শিক্ষক তার বাবা-মা। একটি পরিবারে বাবা-মা যাদের সত্যি সত্যি শ্রদ্ধা করে, সন্তানেরা তাদের সাধারণত অশ্রদ্ধা করতে পারেনা__ আপনার সাথে পুরোপুরি একমত। আমি আমার অগ্রজদের সন্মান করলে আমার সন্তানরা আমার কাছ হতে সেটি শিখবে, এতে কন সন্দেহ নেই।
তবুও সবাই কেন বুঝেও বুঝে না, জানিনা।
আমাদের শিশুরা ভাল কিছু শিখুক, প্রার্থনা।
অনিকেত নন্দিনী
স্বার্থপরতা আর হিংসাপরায়নতার কারণেই এমন হয় আপু। অন্যদের সাথে ভাগাভাগি না করে একাই সব ভোগের চেষ্টায় যারা লিপ্ত, তাদের সন্তানের কাছে এরচেয়ে ভালো কিছু আশা করা যায়না। আফসোস এদের জন্য। এরা কখনোই জানবেনা স্বজনদের সাথে সবকিছু ভাগাভাগির মজা কী জিনিস। 🙁
আপনার প্রার্থনা মঞ্জুর হোক।
-{@
অরুনি মায়া
নন্দিনী আপুর মত আমিও বলতে চাই, বাবা মায়ের দেওয়া শিক্ষার উপরই নির্ভর করে সন্তান রা কিভাবে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের গ্রহণ করবে | বীজ যত বেশি পরিপুষ্ট চারা তত ভাল |
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছ মায়া আপু। সঠিক শিক্ষাটুকু আমরা কি আমাদের সন্তান্দের দিচ্ছি ?
ভাল থাকুক আমাদের শিশুরা, তাঁদের বাবা মায়েরা, দাদু নানু’রা।
মোঃ মজিবর রহমান
এটা ন আত্তার টান। এটান হৃদয় নিংড়ানো।
কেমনে ছেড়ে যাবে বলেন।
রিমি রুম্মান
আমার আজো সেই শিশুটির অশ্রুসজল মুখ ভেসে উঠে সামনে। আজো আমি তাঁর দাদূকে যেতে না দেয়ার সেই চিৎকার শুনতে পাই যেন।
মোঃ মজিবর রহমান
এটা স্বাভাবিক আপু আপনি ও আপনার পরিবারের এই টান্টা অনুভব করেন বলেই অনুভব করেন
যারা এইটান পরিবারে উপেক্ষিত তাঁরা ব্যারথ এটা বুঝতে।