কমলা রাণীর সাগর দীঘি

কামাল উদ্দিন ১৭ এপ্রিল ২০২০, শুক্রবার, ১০:৩২:২৩পূর্বাহ্ন ভ্রমণ ২৫ মন্তব্য

আমরা জানি কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটা ইউনিয়ন। আজকে আমার পোষ্ট হলো তার উল্টো চিত্র নিয়ে। মানে আমি বলতে চাচ্ছি ১৫টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচং এর কথা। বানিয়াচং এ আমার যাত্রা মুলত "কমলা রাণীর সাগর দীঘি" দর্শন করার জন্যই। যাকে নিয়ে রয়েছে একটা অবিশ্বাস্য মিথ।

মিথ বা লোক কাহিনীটি এরকম- বানিয়াচং-এর পদ্মনাত রাজা বিয়ে করে প্রাসাদে তুলেছিলেন তরফ অঞ্চলের রাজকুমারী কমলাবতীকে। রূপবতী ও গুণবতী রাণীর প্রশংসায় কিছুদিনের মধ্যেই পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে প্রজারা। রাণীর ঘরে এক পুত্র সন্তান জন্ম নেয়ার পর পরই একদিন রাজা স্বপ্নে দেখেন- কে যেন তাকে একটা বড় দীঘি খনন করার আদেশ করছে। রাজা পরপর তিন রাত একই স্বপ্ন দেখে অবশেষে গন্ডমালীকে আদেশ দিলেন একটি বড় দীঘি খননের। তখন সাগরের মতো বিশাল এক দীঘি খনন করা হয়, তাই এর নাম হয় সাগর দীঘি । এদিকে রাজার হিংসুটে ছোট বোন কেউকা গন্ডমালীকে অর্থের লোভ দেখিয়ে দিঘির প্রথম কোপ রাণী কমলাবতীর নামে উঠাতে রাজী করায়। এক সময় দীঘি খননের কাজ শেষ হলে দীঘিতে পানি উঠছেনা দেখে রাজা দুশ্চিন্তায় পড়েন। রাণী এবার স্বপ্নে দেখলেন- এ দীঘিতে তিনি আত্মদান করলেই কেবল তাতে পানি উঠবে। এটা কেউ মেনে না নিলেও প্রজাদের পানির চাহিদার কথা চিন্তা করে রাণী কমলাবতী নিজেই সিদ্ধান্ত নেন- তিনি আত্মাহুতি দেবেন এবং সত্যি সত্যিই একদিন সুসজ্জিত হয়ে রাণী দিঘিতে নেমে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। রাণী যতো এগোন ততো পানি বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে এক সময় রাণী কমলাবতীর পুরো শরীরই পানির মধ্যে তলিয়ে যায়। আত্মদানের এ অসামান্য কাহিনীর ওপর ভিত্তি করেই সাগর দীঘিকে অনেকে কমলা রাণীর দীঘি নামেও অবহিত করেন।

এ দিঘি নিয়ে বাংলা ছায়াছবিসহ রেডিও মঞ্চ নাটক রচিত হয়েছে। এর পাড়ে বসে পল্লী কবি জসিমউদ্দিন ‘রাণী কমলাবতীর দিঘি’ নামে একটি কবিতা রচনা করেছিলেন। সে কবিতাটি তার ‘সূচয়নী’ কাব্য গ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।

(২/৩) হবিগঞ্জ থেকে বানিয়াচং যাওয়ার পথে বাম দিকে সাতাই নদীতে জাল কিংবা বর্ষি দিয়ে মাছ ধরার এমন চিত্রগুলো বেশ মন কারে।

 

(৪/৫) চোখে পড়ে এমন গরু রাখালের পদচারণা। দেখে সত্যিই মনটা ভরে যায়।

 

(৬) বানিয়াচং এর একেবারে উপকন্ঠে এই ব্রীজটিকে বলে শুটকি ব্রীজ। নিচের সরু নদীটার নাম শুটকি নদী।

 

(৭) হবিগঞ্জ থেকে বানিয়াচং যাওয়ার গাড়িগুলোও কিন্তু বেশ।

 

(৮/৯) দুই পাশের এমন দেখেই বুঝা যায় বানিয়াচং সত্যিই অসাধারণ সুন্দর।

 

(১০) এক সময় আমরা চলে এলাম কাঙ্খিত সাগর দীঘির পাড়ে।

 

(১১) এত দূর থেকে এসে সাগরের পানির একটু স্পর্শ না নিলে কি হয়?

 

(১২/১৩) দীঘির মাঝামাঝি স্থানে দাড়িয়ে দুই দিকের দুটি ছবি। কথিত আছে দীঘির দৈর্ঘ ২ কিলোমিটার আর প্রস্থ্য ১ কিলোমিটার। বাস্তবে বর্তমানে ইহা আরো অনেক ছোট।

 

(১৪/১৫) মাছ ধরা, হাড়ি-পাতিল ধোয়া, গোসল সবই এলে কমলা রাণীর এই দীঘিতে।

 

(১৬) দীঘির শেষ প্রান্তে গাছের শেকড়ে বসে এই মিথের কথা ভাবলে মনটা কোথায় কোন সুদূরে হারিয়ে যা.......

 

সব শেষে এই দীঘি দেখতে গিয়ে পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের কবিতাখানি.......
--------------------------------------------------------------------
কমলা রাণীর দীঘি ছিল এইখানে,
ছোট ঢেউগুলি গলাগলি ধরি ছুটিত তটের পানে।
আধেক কলসী জলেতে ডুবায়ে পল্লী-বধূর দল,
কমলা রাণীর কাহিনী স্মরিতে আঁখি হত ছল ছল।
আজ সেই দীঘি শুকায়েছে, এর কর্দমাক্ত বুকে,
কঠিন পায়ের আঘাত হানিয়া গরুগুলি ঘাস টুকে।
জলহীন এই শুষ্ক দেশের তৃষিত জনের তরে।
কোন সে নৃপের পরাণ উঠিল করুণার জলে ভরে।
সে করুণা ধারা মাটির পাত্রে ভরিয়া দেখার তরে,
সাগর দীঘির মহা কল্পনা জাগিল মনের ঘরে।

লক্ষ কোদালী হইল পাগল, কঠিন মাটিরে খুঁড়ি,
উঠিল না হায় কল-জল-ধারা গহন পাতাল ফুঁড়ি।
দাও, জল দাও, কাঁদে শিশু মার শুষ্ক কন্ঠ ধরি,
ঘরে ঘরে কাঁদে শূন্য কলসী বাতাসে বক্ষ ভরি।
লক্ষ কোদালী আরো জোরে চলে, কঠিন মাটির থেকে,
শুষ্ক বালুর ধূলি উড়ে বায় উপহাস যেন হেঁকে।

কোথায় রয়েছে ভাট ব্রাক্ষণ, কোথায় গণক দল,
জলদী করিয়া গুনে দেখ কেন দীঘিতে ওঠে না জল?
আকাশ হইতে গুণিয়া দেখিও শত-তারা আঁখি দিয়া,
পাতালে গুণিও বাসকি-ফণার মণি-দীপ জ্বালাইয়া।
ঈশানে গুণিও ঈশানী গলের নর-মুন্ডের সনে,
দক্ষিনে গুনো, শাহ মান্দার যেথা সুন্দর বনে।
আকাশ গণিল, পাতাল গণিল, গলিল দশটি দিক,
দীঘিতে কেন যে জল ওঠেনাক বলিতে নারিল ঠিক।

নিশির শয়নে জোড়মন্দিরে স্বপন দেখিছে রাণী,
কে যেন আসিয়া শুনাইল তারে বড় নিদারুণ বানী;
সাগর দীঘিতে তুমি যদি রাণী! দিতে পার প্রাণদান,
পাতল হইতে শত ধারা-মেলি জাগিবে জলের বান।
স্বপন দেখিয়া জাগিল যে রাণী, পূর্বের গগন-গায়,
রক্ত লেপিয়া দাঁড়াইল রবি সুদূরের কিনারায়।
শোন শোন ওহে পরাণের পতি ছাড় গো আমার মায়া,
উড়ে চলে যায় আকাশের পাখি পড়ে রয় শুধু ছায়া।

পেটরা খুলিয়া তুলে নিল রাণী অষ্ট অলঙ্কার,
রাসমন্ডল শাড়ীর লহরে দেহটি জড়াল তার।
কৌটা খুলিয়া সিঁদুর তুলিয়া পরিল কপাল ভরি,
দুর্গা প্রতিমা সাজিল বুঝি বা দশমীর বাঁশী স্মরি।
ধীরে ধীরে রাণী দাঁড়াইল আসি সাগর দীঘির মাঝে,
লক্ষ লক্ষ কাঁদে নরনারী শুকনো তটের কাছে।
পাতাল হইতে শতধারা মেলি নাচিয়া আসিল জল,
রাণীর দুখানা চরণে পড়িয়া হেসে ওঠে খল খল।
খাড়ু জলে রাণী খুলিয়া ফেলিল পায়ের নুপূর তার,
কোমর জলেতে ছিড়িল যে রাণী কোমরে চন্দ্রহার।
বুক-জলে রাণী কন্ঠে হইতে গজমতি হার খুলে,
কোরের ছেলেটি জয়ধর কোথা দেখে রাণী আঁখি তুলে।
গলাজলে রাণী খোঁপা হতে তার ভাসাল চাঁপার ফুল।
চারিধার হতে কল-জলধারা ভরিল দীঘির কূল।
সেই ধারা সনে মিশে গেল রাণী আর আসিল না ফিরে,
লক্ষ লক্ষ কাঁদে নরনারী আকাশ বাতাস ঘিরে।
* * *
কমলা রানীর এই সেই দীঘি, কার অভিশাপে আজ,
খুলিয়া ফেলেছে অঙ্গ হইতে জল-কুমুদীর সাজ।
পাড়ে পাড়ে আজ আছাড়ি পড়ে না চঞ্চল ঢেউদল,
পল্লী-বধূর কলসীর ঘায়ে দোলে না ইহার জল।
কমলা রাণীর কাহিনী এখন নাহিক কাহারো মনে,
রাখালের বাঁশী হয় না করুণ নিশীথ উদাস বনে।
শুধু এই গাঁর নূতন বধূরে বরিয়া আনিতে ঘরে,
পল্লীবাসীরা বরণ কুলাটি রেখে যায় এর পরে।
গভীর রাত্রে সেই কুলাখানি মাথায় করিয়া নাকি,
আলেয়ার মত কে এক রূপসী হেসে ওঠে থাকি থাকি।

 

0 Shares

২৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ