মজনু মিয়া হকচকিয়ে উঠলো। ভয়ে কলিজাটা নড়েচড়ে বসেছে। হৃৎপিণ্ডটা ভেতর থেকে গুতাগুতি করছে। যেকোনো সময় বের হয়ে আসতে পারে। পুরো শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। ঝড়-ঝাপটার মতো। যেদিকে যাচ্ছে নিঃশেষ করে যাচ্ছে।
লাল্টু ভয়ে স্তম্ভিত। পুরোপুরি সংকুচিত। দেহপিঞ্জর নিবুনিবু। কন্ঠস্বর নিরুত্তাপ দোটানায় সংশয়।
পুরো শরীর ঘামে ভরা। কপাল চুইয়ে চুইয়ে ঘাম ঝরছে। ভয়ের ছিটেফোঁটা চোখেমুখে। ঠোঁট দুটোও অদৃশ্য বাতাসে ঝিনঝিন করছে। তৃষ্ণায়...। বুক ভর্তি তৃষ্ণার তৃণমূল।
মেয়েটি গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে। অশ্রুপাতে চেহারাটা বিবর্ণমুখী।
এই লাল্টু, এই লাল্টু, কই গেলি?
না, লাল্টুর কোন সাড়াশব্দ নেই। দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিশ্বাস চলছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।
গায়ে হাত লাগিয়ে, এই লাল্টু! এই লাল্টু! কি অইয়াছেরে তোর? কোনহ কথাই শুনবার পারছোস না যে?
থতমত হয়ে, কে কে?
এই লাল্টু, এই লাল্টু, আমি...। আমি তোর মজনু ওস্তাদ যে।
অ্যা...।
কিরে! ভয়ে তোর দেহি কলিজাটুহু শুখাইয়া গেছে।
হ ওস্তাদ। ঠিকই কইয়াছেন। এখন কি করবাইন।
কি আর করুম! হাসপাতালে নিতে অইবো। নইলে তো ফাইসা যামুগা।
হ, তইলে মানিক ওস্তাদরেও ডাহেন। তারাতাড়ি নিবার পারুমনে।
মানিক গাঁজার নেশার ছোবলে জখম। টানছে তো টানছেই। হুঁশ বেহুঁশে অজ্ঞান অবচেতন। এই মূহুর্তে দুনিয়ার কোন খোঁজখবর নেই তার কাছে। সে একাই মাদকের জান্নাতে দাখিল। একাই মাদকের ভয়াল থাবার সিংহাসনের রাজা।
ওস্তাদ, ওস্তাদ। ঘুমিয়ে গেছেন নাহি?
কেরে? আমাকে ডাকছিস কেন?
না ওস্তাদ! মানে...
কিরে লাল্টু! মানে মানে করছিস কেন?
মানে...। দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। শামসু ওস্তাদ তো...।
কি কথা কইবার লাগছোস? কথা হাঁচানি।
হ, ঠিহক কথা।
তিনজন শামসুকে টেনেটুনে বাইরে বের করলো। বাইরে পুরাতন এক টায়ারের উপর শুইয়ে দিল। সবাই তখন হাঁপাচ্ছে। জোরে জোরে নিশ্বাস ছাড়ছে। ইতিমধ্যে লাল্টু বলে উঠলো - মজনু ওস্তাদে কোন খাওন খাইছে যে শরীরডা এতো পিডা। ওজন দেখছিন ওস্তাদ। পুরোদস্তুর হাতির লাহান। দুই মিনিটেই হাঁপাইয়া উঠছি।
হ রে লাল্টু! এক্কেবারে ঠিহক কথাই কইছোস। শরীরডা যেন গন্ডারের চামরার মতো।
আচ্ছা ওস্তাদ, শামসু ওস্তাদে ছিলো কোতায় এ্যাতদিন?
পরে একদিন বলুমনে। এখন নেতো, বাসে তোল।
মানিক বলে উঠলো, না ওস্তাদ। বাসে নেওন যাইতো না। সবাই বলাবলি করবে আমিই এক্সিডেন্ট করেছি। তখন মেলা ঝামেলা অইবো।
তয় কি করবি এখন?
গ্যারেজে জুম্মনের সিএনজির চাবি ঝুলানো আছে। সিএনজি লইয়াই...।
হ, তইলে তাই করি চল।
হাসপাতালে ঢুকতেই মেয়েটির কান্নাকাটি আরও বেড়ে গেলো। সেকি উচ্চস্বরে কান্না! কান্নার শব্দ পেয়ে কয়েকজন নার্স এসে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। তবুও কি কান্না থামে? এ কান্না আত্মার সংমিশ্রণের কান্না। রক্তবিন্দুর কান্না। এ কান্নায় হৃৎপিণ্ড কথা বলে।
ডাক্তার এসেই জিজ্ঞেস করলো, কিভাবে কি হয়েছে?
মজনু মিয়া থতমত হয়ে বলল, ' আমি চিনিনা। রাস্তার পাশে পইড়া থাকতে দেইখা হাসপাতালে নিয়া আইছি স্যার।
মেয়েটির কি হয়? জানেন কিছু?
মেয়েটির বাবা।
ও আচ্ছা। তাহলে আপনাদের কিছু হয়না।
না স্যার। কিছুই অয়না।
মেয়েটি দৌড়ে এসে ডাক্তারের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, আমার আব্বুরে বাঁচান। আমার আব্বুরে বাঁচান।
শামসুকে ইমারজেন্সিতে নেওয়া হলো। মেয়েটি মেঝেতে বসে পড়লো। গুটিসুটি হয়ে কাঁদতে লাগলো।
হাসপাতালের গেইট পার হতেই মজুন মিয়া মুচকি হাসি হাসতে লাগলো। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে লাল্টু আর মানিকের বাড়ালো। লাল্টু কিছুটা হতভম্ব হলো। মতিগতি কিছুই বুঝতে পারলো না। শুধু জিজ্ঞেস করলো, ' ওস্তাদ! আপনি মুচকি মুচকি হাসছুন কেন? আর মিথ্যে কডআর মিথ্যে কথাডাই বা কইছন ক্যা?'
মজনু মিয়া ১০০ টাকার একটা নোট লাল্টুর হাতে দিয়ে বলল, যা দুই-তিনডা টাইগার লইয়া আয়।

ছবিঃ সংগৃহীত

0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ