আমরা যারা ষাটের দশকে (৬০-৬৯) জন্ম নিয়েছি তারা আমার সাথে একমত হবেন। আমাদের বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই হলেও সহসা কোন কিছু ভুলার কথা না। কারন বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের স্মৃতি শক্তি কিছুটা কমে গেলেও অতীতের অনেক কথা বা ঘটনা সবসময় মনে থাকে। আর এটাই হচ্ছে স্মৃতিচারন। স্মৃতিচারন সব সময় সুখের ও মধুর হয়, আবার কারো কারো জীবনে বেদনাদায়ক হয়ে উঠে। বিশেষ করে নারীদের বেলায় সবচেয়ে বেশী হয়। তার একমাত্র কারন নারীরা জন্ম থেকেই পুরুষদের তুলনায় বিসর্জন বা ত্যাগ এবং যে কোন প্রতিকুল পরিবেশে কষ্টটা বেশী সহ্য করেন। নারীদের সহ্য শক্তি ও বিসর্জন নিয়ে না হয় অন্য কোনদিন লেখা যাবে।

৬০’এর দশকে আমাদের শৈশব,কৌশোর ও যৌবনটা কেটেছে অনেকটাই চিত্ত-বিনোদনহীন। চিত্ত-বিনোদন বলতে ছিলো, খোলা মাঠে কাঁদা-মাটিতে ফুটবল, হা-ডু-ডু, দাড়িয়া বান্ধা, সাত চারা, টিলো এক্সপ্রেস ও গোল্লাছুট খেলা। শিশুকালে মেয়েদের সাথে মাঝে মাঝে বৌ-চি ও এক্কা দোক্কা বা কুতকুত খেলা। আমাদের মাঝে যারা অভিজাত ও ধন্যাঢ্য পরিবারের সন্তান ছিলো তারা বেডমিন্টন ও ক্রিকেট খেলতো। তাদের সাথে যাদের ভাল বন্ধুত্ব ছিলো শুধু তারাই বন্ধুদের সাথে খেলতো।

১৯৬০ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত টেলিভিশন ছিলো কয়েকটি পরিবারের কাছে। তাদের অধিকাংশই ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানী, ব্যবসায়ী ও সরকারী আমলা। আমাদের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের টেলিভিশনে চিত্ত-বিনোদন ছিলো দুঃস্বপ্ন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে দেশ স্বাধীন হলে এই দেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা চিরতরে বিদায় নেয়। সময়ের সাথে তাল দিয়ে ধীরে ধীরে আমাদের দেশে শিল্প-কারখানা ও উন্নয়নমুখী কার্যক্রম গড়ে উঠা শুরু করে। ৭০’ দশকের শেষের দিকে ও ৮০’ দশকে আমাদের অনেকের ঘরে ঘরে টেলিভিশন চলে আসে। আমরা খেলাধুলার পাশা-পাশি চিত্ত-বিনোদনের জন্য বিটিভিকে আরেকটি মাধ্যম হিসেবে বেঁছে নিলাম। ভাঁটা পড়তে থাকে কাঁদা-মাটির অনেক খেলাই।

১৯৭৬ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত আমরা কৌশর ও যৌবনে ছিলাম। সেই সময় বিটিভিতে জনপ্রিয় বেশ কিছু সিরিজ অনুষ্ঠান দেখানো হতো। তারমধ্যে সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান, বায়োনিক ওম্যান, কোজাক, ডালাস, ম্যাক গাইভার, ইনক্রিডেবল হাল্ক, চার্লিস এ্যাঞ্জেল, লিটল হাউজ ইন প্রেইরী নিয়মিত প্রচার হতো। আনন্দমেলা, চতুরঙ্গ, সিরিজ নাটক অয়োময়, সংশপ্তক, সকাল-সন্ধ্যা নাটকগুলি বেশ জনপ্রিয় ছিল। বিদেশী গানের মধ্যে সলিড গোল্ড,বনিয়েম ও এ্যাবা (ABBA)। স্বাধীনতার পর প্রথম পপ সংগীত নিয়ে আসে পপ সম্রাট আজম খান। আমরা কিশোর ও যুবকরা আজম খানের গানের ভক্ত হয়ে পড়ি। ব্যান্ড গ্রুপও তৈরী হয় সেই সময়। তার মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে আসা “সোলস” বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। শিল্পীদের মধ্যে ফকির আলমগীর, ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজ, খালিদ হাসান নিলু, জানে আলম সহ বেশ কয়েকজন শিল্পী নিয়মিত বিটিভিতে গানের অনুষ্ঠান ছাড়াও জেলায় জেলায় মঞ্চ অনুষ্ঠান শুরু করে। তখন বিনোদনের জন্য আমরা গানকেও বেঁছে নেই।

ছাত্রাবস্থায় আরেকটা বিনোদন ছিলো বই পড়া। তখন অনেক এলাকায় লাইব্রেরী ছিলো। সদস্য হয়ে সেই লাইব্রেরীতে বিনা পয়সায় বই পড়া ও বাড়িতে নেয়া যেত। তাছাড়া প্রতিটি জেলা সদরে সরকারী ভাবে “বাংলাদেশ পরিষদ” ছিলো। সেখানেও বই পত্রিকা ম্যাগাজিন পড়া হত। সংস্কৃতিমনা ছোট ছোট ক্লাব বা সংগঠন নাটক ও রম্য অনুষ্ঠান করতে পারতো। আমরা ছুঁটে যেতাম বাংলাদেশ পরিষদে চিত্ত-বিনোদনের জন্য।

৮০’ দশকে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলো বই ,পত্রিকা ও চলচ্চিত্র বিষয়ক ম্যাগাজিন। ”চিত্রালী” ও ”পূর্বাণী”। মা-খালা ও বোনদের ছিলো “বেগম” পত্রিকা। প্রতি শুক্রবার চিত্রালী ও পূর্বাণী প্রকাশ হতো। যৌবনে সিনেমা দেখা নেশার মতন ছিলো। তাই চিত্রালী ম্যাগাজিন হাতে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতাম। চিপাচস (চিত্রালী পাঠক পাঠিকা চলচ্চিত্র সংসদ) নামে একটা পাতা থাকতো। তাতে আবার সদস্য হওয়া যেত। আমি সেই চিপাচসের সদস্য ছিলাম। কারন আমার পছন্দের নায়ক-নায়িকাদের খোজ খবর রাখার জন্য। আরেকটি পাতা ছিলো বাচসাস। সবগুলিরই সম্পদাক ছিলেন গীতিকার মরহুম আহাম্মেদ জামান চৌধুরী (আজাচৌ)।

গোয়েন্দা কাহিনীর বই ”কুয়াশা” “মাসুদ রানা” “দস্যু বনহুর” ও “দস্যু রাণী” ছিলো ছাত্র সমাজে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। সেই সময় এমন কোন ছাত্র খুঁজে পাওয়া যেত না যারা এই গোয়েন্দা কাহিনীর বই না পড়েছে। আমারা অনেকেই এই বই কিনে পড়তাম। আবার একজন কিনলে ১০/১২জন পালাক্রমে নিয়ে পড়াতাম। সেক্ষেত্রে খরিদকৃত বন্ধুর সাথে এই ১০/১২ জনের সুসম্পর্ক থাকা বাঞ্চনীয় ছিলো। এই সবগুলি বই সিরিজ বা ভলিউমে প্রকাশ হত। আবার কিছু সংখ্যক উচ্ছশৃঙ্খল যুবকের পছন্দে ছিলো ভারতীয় চটি বই।
কুয়াশা ও মাসুদ রানা বইয়ের লেখক ছিলেন ঢাকার কৃতি সন্তান, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের স্বনামধন্য ছেলে, সেবা প্রকাশনীর স্বত্যাধিকারী কাজী আনোয়ার হোসেন। আর দস্যু রাণী ও দস্যু বনহুরের লেখিকা ছিলেন বগুড়া জেলার শেরপুরের কৃতিমান সাহিত্যিক রোমেনা আফাজ।

আমি কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানার সবগুলি সিরিজ সেই সময় কিছু ক্রয় করে কিছু লাইব্রেরীতে যেয়ে কিছু বন্ধুদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে পড়েছিলাম। প্রায় মুখস্ত ছিলো। মাসুদ রানা বা কুয়াশা বা দস্যু বনহুর বা দস্যু রাণী ছাড়া আমাদের ছাত্র জীবন ছিলো শুকনা পাতার মতন মচমচ। কাজী আনোয়ার হোসেনকে দেখার সৌভাগ্যও হয়েছিলো আমার। পরের কোন লেখায় বিশদ বর্ননা দেয়া যাবে।

সর্বশেষঃ
একই পাতিল বা হাঁড়ির ভাত পরিবারের বাবাও খাচ্ছে, ছেলেও খাচ্ছে। অথচ বাবা বার্ধ্যক্যে যাচ্ছে ছেলে যৌবনপ্রাপ্ত হচ্ছে। এখানে ভাতের কোন গুন নেই।

ষাটের দশকেও ভাইরাস বা মহামারীর প্রাদুর্ভাব ছিলো। আক্রান্ত এলাকায় শত শত মানুষ মারা যেত। যেমন গুটি বসন্ত কলেরা অন্যতম ছিলো।

বিংশ শতাব্দিতে করোনা বা কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটে। বিশ্ব জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে। পূর্বের ভাইরাসের মতন সীমাবদ্ধ না থেকে বিশ্ব ভ্রমন করছে। এখানেও ভাইরাসের কোন গুন নেই।

আমাদের সময়ও চিত্ত-বিনোদন ছিল। এখনও চিত্ত-বিনোদনের মাধ্যমগুলি হাতের মুঠোয় পাওয়া যাচ্ছে। এখানেও বিনোদনের কোন গুন নেই।

গুনটা হচ্ছে বিবর্তনের বা সময়ের।

সবাই ভাল থাকুন। সচেতন হয়ে চলাফেরা করুন।
আল্লাহ সহায় হউন।
আমীন।

0 Shares

৩০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ