২য় পর্বঃ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)#

হই হুল্লোড় শুনে আমি কেবিনের বাইরে এসে দেখি ২৪/২৫ বছরের এক যুবক গণ পিঠুনি খাচ্ছে আর নিজের নাম বলছে মোহাম্মদ মুহসিন। বাড়ি বলছে পটিয়া। আমি নিজের জায়গায় ফিরে এলাম। অকেক্ষণ পর জাহাজের পিছনে টয়লেটে গেছি। দেখি পিছনের ডকে ঐ লোকটিকে শুইয়ে কানের ভিতর সমুদ্রের লোনা পানি ঢেলে দিচ্ছে। লোকটিকে আগেই মারতে মারতে পরনের সমস্ত কাপড় খুলে নিয়েছিলো। সমস্ত শরীরে একটা জাইঙ্গা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না।
লোকটির গায়ের অনেক জায়গায় কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। জ্ঞান যায় যায় অবস্থা। ব্যাপারটা দেখে আমার তেমন ভালো না লাগলেও আমি চলে এলাম আমার কেবিনে। আগেই বলেছি যাত্রীদের অবস্থা দেখে আমিও অসুস্থ বোধ করছিলাম। টেবলেটতো আগেই খেয়েছি এখন টেবিলে হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকলাম।

আমার পাশের আসনে কুতুবদিয়া উপজেলা চেয়ারম্যানের ভাই বাবুল। তিনি একজন ভদ্রলোকের কাছে গত সপ্তাহের ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা দিচ্ছিলেন। জাহাজের অনেক যাত্রীই বসে বসে ঝিমুচ্ছে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছিলো মরুভূমির বুক চিরে উঠের কাফেলার গতির মতো করে। এমন সময় হঠাৎ খবর এলো মুহসিন নামের ঐ যুবকটিকে সাগরে ফেলে দেয়া হয়েছে। ও মাই গড!

এ খবরে সবাই চমকে উঠলো, নিমেষেই দুর হয়ে গেলো আমার তন্দ্রা। বলে কি? এত মারধর করার পরও লোকটির শাস্তি হলো না? একেবারে পানিতে ফেলে হত্যা? তাও এই বিক্ষুদ্ধ তরঙ্গ মালায় নিক্ষেপ করে? হত্যা করার মতো অপরাধ সে করেছে বলে তো মনে হয় না। আমি তাড়াতাড়ি কেবিন থেকে বের হয়ে দেখি সবাই পেছনের রেলিং থেকে কী যেন দেখার চেষ্টা করছে। জাহাজ কিন্তু তখনও সামনের দিকে বিরামহীন গতিতে ছুটে চলছে সাগরের বুক চিড়ে। তখন সময় বিকাল প্রায় চারটার মতো হবে।

আমাদের জাহাজ গহিরার প্রায় ৫/৬ কিলোমিটার মাঝ সাগর দিয়ে এগিয়ে চলছে। বাঁশখালীর ছনুয়া আসতে আর বেশী দেরি নেই। চট্টগ্রামের সদরঘাট থেকে সকাল দশটায় জাহাজ যাত্রা শুরু করেছিলো। আমি ডকে বেরিয়ে মানুষের জন্য কিছুই দেখতে পেলাম না। তাড়াতাড়ি তিন তলায় উঠে গেলাম। উঠে দেখি বেশ অনেকখানি পেছনে কালো ধরনের কি একটা যেন ঢেউয়ের সাথে উঠানামা করছে। লোকেরা বলাবলি করছে ওটাই ফেলে দেয়া মানুষ।

ততক্ষণে জাহাজের মাষ্টারের নিকট খবর পৌছে গেছে। উনি বিজ্ঞ লোক, দেরি না করে সাথে সাথে জাহাজের গতি ঘুরিয়ে দিয়েছেন। জাহাজ ধীরে ধীরে ঘুরে এবার উল্টা উত্তর মুখি চলতে শুরু করলো। জাহাজ ফিরতি পথে লোকটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাকে বাঁচাতেই হবে। যাত্রী মহলের মধ্যে বলবলি হচ্ছে- লোকটিকে যে ফেলেছে তাকে ধরে রাখা হোক। এতো মারার পরও সাধ মিটেনি! আমিও বুঝতে পারছিলাম না মানুষ এখনও এরকম মুর্খ রয়ে গেছে কীভাবে! আরে, সে যদি কাউকে খুনও করে বসতো তাহলে আইন আদালত থানা পুলিশ কী জন্য আছে? তাকে নিয়ে এমনিতেই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। বিশেষ করে আমার আরো খারাপ লাগছিলো, আমরা ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে কুতুবদিয়া যাচ্ছিলাম কিছু দুস্থ লোকের সাহায্যার্থে। আর যাবার পথেই যদি একজন সুস্থ মানুষকে খুন করে যাই, তাহলে আমাদের সাহায্যের সার্থকতা কোথায়? জাহাজ লোকটির কাছাকাছি এসে বন্ধ হয়ে গেছে।

সব মানুষ একদিকে ঝুকে পড়েছে লোকটিকে দেখতে। জাহাজ লোকটির প্রায় সাত-আট হাতের মধ্যে চলে এসেছে। তার হাত দুটো একটু একটু নড়ছে, তবে জ্ঞান আছে বলে মনে হয়না। তাকে উদ্দেশ্য করে জাহাজ থেকে একটি রঙ্গিন সুইমিং জেকেট ফেলে দেওয়া হলো। জেকেটটাকে পানির ঢেউ অন্য দিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। তারপর রশি বাধা একটা টিউব খুব কাছেই ফেলে দেওয়া হল। কিন্তু, লোকটির তো হুসই নেই, সুতরাং সে কিছুই ধরতে পারলোনা। উলট-পালট ঢেউয়ের আঘাতে আবারো সে জাহাজ থেকে দুরে সরে যেতে লাগলো।
প্রথম থেকেই ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগছিলো। একটি লোক চোখের সামনে এভাবে মারা যাবে আর আমরা জাহাজের প্রায় দু’শো মানুষ দিব্যি তামাশা দেখবো? এটা কেমন কথা! অথচ লোকটিকে বাঁচানোর কার্যকর কোন ব্যবস্থাই গ্রহন করা হচ্ছে না। লোকটি আবারো ঢেউয়ের আঘাতে ভেসে যাচ্ছে দেখে আমি মোস্তাফা কামাল ভাইকে বললাম- কামাল ভাই, আমি সাগরে ঝাঁপ মারতেছি। কামাল ভাই হচ্ছেন আমাদের ত্রাণ কমিটির লিডার (বর্তমানে মরহুম, আল্লাহ উনাকে বেহেস্ত নসীব করুন, আমিন)। তিনি আমাকে শক্ত করে আকড়ে ধরে বললেন- আপনি কি পাগল হয়েছেন? দেখছেন না সমুদ্র কী গরম! আপনাকে খুঁজতে আরো পনেরো জন লাগবে। আমি বললাম- কিন্তু চোখের সামনে একটা তরতজা জীবন এভাবে অসময়ে ঝরে যাবে অথচ আমাদের করার কিছুই নেই? আমার তো নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। কামাল ভাই বললেন- জাহাজ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে, দেখেন না কী হয়।

ততক্ষণে সমুদ্রের হিংগ্র ঢেউ লোকটিকে জাহাজ থেকে আবারও একশো গজের মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। জাহাজ আবার ষ্টার্ট দিয়ে ঘুরিয়ে দেয়া হচ্ছে লোকটির দিকে। আমি কামাল ভাইয়ের অজান্তে জাহাজের নীচের তলায় চলে এলাম। মাথায় চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, কিছু একটা করা দরকার। তখনও সিদ্ধান্তহীনতায় ভূগছিলাম। তবে আমার মনে এই বিশ্বাস বদ্ধমুল ছিলো যে লোকটিকে বাঁচাতেই হবে। কেবিনে এসেই ব্যাগ থেকে জরুরী প্রয়োজনে আনা জাইঙ্গাটা বের করে পড়ে নিলাম। জাইঙ্গাটা কেন পড়লাম তা হয়ত আমার অবচেতন মনে জানে অথবা জানে না। আমি আসার সময় ফূলপ্যান্ট পড়ে আসিনি কারণ কুতুবদিয়ায় হয়ত আমাদেরকে বস্তা কাঁধে নিয়ে পানি এবং কাদার মধ্যে অনেকটা পথ হাটতে হতে পারে। আমি কেবিনের মধ্যে আনমনে পায়চারি করছিলাম। আমার মুষ্ঠিবদ্ধ দুই হাত পরস্পরের সাথে কিছুক্ষণ পর পর সংঘর্ষিত হচ্ছিলো। দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরছি বার বার।

পায়চারীর এক ফাঁকে কেবিন থেকে বের হয়ে দেখি লোকটির অনেকটা কাছে চলে এসে জাহাজটি আবার দাঁড়িয়ে পড়েছে। আবার রশি বাধা টিউব ছুড়ে মেরে টেনে আনা হচ্ছে। লোকটির তখন অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থা। জাহাজের উপর-নীচের তিন সারি লোক আফসোসের সাথে পর্যবেক্ষণ করছে একটা তরতজা প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে। সকলেই মর্মাহত, বেদনাহত, এবং চিন্তাকিষ্ট। মনে হচ্ছে বোবা দৃষ্টিতে অস্তরবি দেখা ছাড়া কারো যেন কিছুই করার নেই। শোকাতুর দৃষ্টিতে উপভোগ্য দৃশ্যপটই বটে! আমার বুকের ভিতর ঢিব ঢিব করছে। কোন ভয় বা শংকার লেশ মাত্র সেখানে নেই। আছে বিবেকের দংশন আর সিদ্ধান্তহীনতার যাতনা।

আমি রেলিং থেকে যখন দ্বিতীয় বার কেবিনে ঢুকি তখন আমার গায়ের সাফারী হাতে চলে এসেছে। গায়ে আছে হালকা সবুজ রংয়ের হাফহাতা গেঞ্জি(টি-শার্ট)। কেবিনে পায়চারি করতে করতে হাতের ঘড়ি খুলে পকেটে রেখে গায়ের অবশিষ্ট গেঞ্জিও খুলে নিলাম। এভাবে নিজের অজান্তেই নিয়ে ফেললাম চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত। আমার সামনের সিটে বসা ছিলেন মোটাসোটা এক ভদ্র লোক। ক্লিন সেভড। যাবেন বাঁশখালীর ছনুয়ায়। এ মুহুর্তে রুমে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি। তিনি এতক্ষণ আমাকে লক্ষ্য করছিলেন। ভদ্রলোক আমার অবস্থা দেখে চোখ বিস্ফারিত করে জিজ্ঞেস করলেন- আপনি সমুদ্রে ঝাপ মারবেন নাকি? আমি বললাম- হ্যাঁ, লোকটিকে যে বাঁচাতে হবে। দেখছেন না, মরে গেলোই বলে!..........
(চলবে)

৩য় পর্বের লিংকঃ

http://www.sonelablog.com/উত্তাল-সাগরে-আমি-৩-মোট-৭প/

#লেখাটি মোট ৭ পর্বে শেষ হবে। (y) 

0 Shares

২৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ