গল্প পড়লে টান টান উত্তেজনা ফ্রি…. :v

৩য় পর্ব (সত্য ঘটনা অবলম্বনে) #
আমার শরীর তখন উত্তেজনায় কাঁপছে। তারপর উনাকে বললাম- দয়া করে আমার কাপড় ও ঘড়ি আপনি রাখবেন। এই বলে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলাম। তখন আমার পুরো শরীর উদোম, পরনে একটা লুঙ্গি। খালি গায়ে দেখে কয়েকজন যাত্রী এসে আমাকে ঘিরে ধরলো। একজন বলল- উনি মনে হয় সাগরে লাফ মারবেন। আমি বললাম- হ্যাঁ, আমি লাফ মারবো। দেখছেন না ভাই, ওর জ্ঞান নেই; রশি, টিউব কিছুই ধরতে পারছে না। এমন সময় জাহাজের একজন কর্মচারী কোত্থেকে দৌঁড়ে এসে বলল- আপনি কি ঝাপ মারবেন? আমি বললাম- হ্যাঁ। সে বলল- তাহলে একটু দাঁড়ান, লুঙ্গি নিয়ে সাঁতরাতে পারবেন না। আমি একটা জাইঙ্গা নিয়ে আসি। আমি কিছু বলার আগেই লোকটি চলে গেল এবং মুহুর্ত পরে একটা জাইঙ্গা নিয়ে এলো।

‘আমি জাইঙ্গা পড়েছি’- বলেই পরনের লুঙ্গি খুলে ছেড়ে দিলাম। এখন আমার জাইঙ্গা ছাড়া সমস্ত শরীর উদোম। গা দেখা যাচ্ছিল বলে লজ্জায় আমার শরীরটা সংকুচিত হয়ে আসছিলো। আমি লাফ দেওয়ার জন্য ‘বিসমিল্লাহ’ বলে এক পা সামনে বাড়িয়েছি- এমন সময় পেছন থেকে একজন লোককে, ‘দাঁড়ান’, ‘দাঁড়ান’ বলে হাত তুলে চিৎকার করে করে এগিয়ে আসতে দেখা গেলো। লোকেরা আগন্তুক কে পথ ছেড়ে দিতে লাগলো। কাছে আসলেন যিনি তাঁকে তিন তলার কন্ট্রোল রুমে নাবিককে বিভিন্ন নির্দেশ দিতে দেখেছিলাম। অর্থাৎ জাহাজের মাষ্টার আথবা ক্যাপ্টেন না কি যেন বলে, তাই। উনি কাছে এসে আমাকে বললেন- আপনি সত্যি ঝাঁপ দিবেন? আমি বলালাম- হ্যাঁ ! বলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম. . . .. .।

মাষ্টার সাহেব তাড়াতাড়ি বললেন- দাঁড়ান, দাঁড়ান, একটা লাইফ জেকেট পড়ে নেন। বলেই কোথায় হাওয়া হয়ে গেলেন। আমি যে লাফ মারতে যাচ্ছিলাম, মাষ্টারের ডাকে শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য রেলিং এর একটা লোহার হাতল ধরে ফেললাম। কয়েক মিনিট পরেই মাষ্টার একটা লালে গোলাপী লাইফ জেকেট নিয়ে আসলেন এবং তা আমাকে পরিয়ে দিতে লাগলেন। মাষ্টার সহ আরো কয়েক জনে আমাকে যখন জেকেটের ফিতা বেধে দিতে লাগলেন তখন আমার নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো এই জন্য যে সবাই আমাকে ভাবছে ‘হিরু’। এখন মনে হচ্ছে লাইফজেকেট ছাড়া এই বিক্ষুদ্ধ তরঙ্গমালায় ঝাপ দিলে আমি নিজেই বিপদে পড়ে যেতাম। আসলে লোকটির মৃত্যু নিশ্চিত দেখে আমি তাকে উদ্ধার করার জন্য হিতাহীত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছিলাম। আমার মনের মধ্যে এতো সাহস কোত্থেকে এলো আমি জানি না।

লাইফজেকেট পড়ার পর নিজেকে কোন বিদেশী সিনেমার রঙ্গিন পর্দার দু:সাহসী ডুবুরীর মত অনুভূতি হচ্ছিলো। ছোট কালে আমার শখ ছিল ডুবুরী হয়ে সাগরের তলা থেকে মুক্তা সংগ্রহ করবো অথবা নাবিক হয়ে মাসের পর মাস অথৈ সাগরে হারিয়ে যাবো। ছোট কালের সেই শখের কথা এ মুহুর্তে আমার মনে পড়ে গেলো। সুইমিং জেকেট পরাতে সব মিলে পাঁচ মিনিটও দেরী হয়নি। তৈরী হওয়ার পর আমাকে একটা রশি দেওয়া হলো এবং রশির মাথা সব সময় হাতে রাখতে বলা হলো। অত:পর আল্লাহর নাম নিয়ে জাহাজ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সু-বিশাল তরঙ্গ মালার ভিতর। সাগরের বুকে পড়েই নিজেকে পানির উপর ছেড়ে দিলাম। আমাকে সহ ঢেউ একটা চক্কর খেলো। অত:পর স্থির হয়ে থাকালাম ঐ মূমূর্ষ লোকটির দিকে। উপর-নিচে ভাসতে ভাসতে জাহাজ থেকে আবার প্রায় পঁচিশ-,ত্রিশ গজ সরে গিয়েছিলো লোকটি। আমার হাতের রশিটা কোমরের সাথে গিট দিয়ে নিলাম। এরপর প্রি-ষ্টাইলে সাঁতার দিলাম লোকটির উদ্দেশ্যে। সাঁতারের অভ্যাস আগে থেকেই ছিলো। স্কুল জীবনে একবার গ্রাম্য ক্লাবের আয়োজিত সাঁতার প্রতিযোগিতায় পুরস্কারও পেয়েছিলাম।

আমার শরীরের সামনে বুকের সাথে এবং পিছনে পিঠের সাথে লম্বালম্বী লাগানো দুইটা করে এবং মাথার পিছনে পাশাপাশি একটাসহ মোট পাঁচটি শূলা। প্রত্যোকটি শূলার প্রস্ত ও বেধ তিন ইঞ্চি করে এবং দৈর্ঘ্য প্রায় বার ইঞ্চি। দুই শূলার মাঝখানে পাঁচ ইঞ্চির মত ফাঁক। এক শূলার সাথে অন্য শূলা আর্মী কালারের চওড়া ফিতা দিয়ে সংযুক্ত। অনেকটা বাচ্চা ছেলের স্কুল বেগের মত গঠন। গলার দিকে তিন ফুটের মত একটা চিকন সুতা। সুতার সাথে একটি শক্তিশালী বাঁশি বাধা থাকে যদিও এখন নেই। এই হচ্ছে সুইমিং জেকেট বা লাইফ জেকেট। যত বড় ঢেউই আসুক, এই জেকেট একজন লোককে ভাসিয়ে রাখতে সক্ষম।

আমি সাঁতার কেটে এগিয়ে যাচ্ছিলাম সামনের দিকে। ঢেউয়ের বিপরীতে আমাকে যেতে হচ্ছে বলে কিছুটা বিঘ্ন ঘটছিলো। বড় ঢেউ আসলেই নিজেকে ঢিলে করে দিই। ফলে কিছুটা পিছিয়ে যেতে হয় এবং পরক্ষণেই আবার এগুতে শুরু করি। আমি লোকটিকে দেখতে পাচ্ছি। তবুও জাহাজ থেকে সবাই চিৎকার এবং ইশারা করে লোকটিকে দেখিয়ে দিচ্ছে। বিরাট জাহাজের সমস্ত যাত্রী এক পাশে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য উপভোগ করছিলো। মানুষের ভারে দানবাকৃতি জাহাজটি এক পাশে কাত হয়ে আছে। যাত্রীদের চেহারায় উৎকন্ঠার ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমি তখন তরঙ্গ মালা ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম সামনের দিকে।

অবশেষে লোকটি আমার নাগালের মধ্যে এলো এবং আমি তাকে ধরে ফেললাম। অত:পর লোকটিকে আমার বুকের উপর টেনে নিলাম। মাথার পিছনের শূলা আমার মাথাকে ভাসিয়ে রেখেছে। লোকটি এখন আমার বুকের উপর সম্পুর্ন নিরাপত্তায় আছে। কিন্তু কোন হুসতো নেই-ই বরঞ্চ নাক-মুখ দিয়ে ফাঁনা বের হচ্ছে। চেহারা হয়ে গেছে মরা সাপের মত হলুদাভ। ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে লোকটির নাক মুখ পানিতে ডুবছে আর ভাসছে। ফলে চোখ, নাক এবং মুখের ভিতর লবণাক্ত পানি ঢুকে যাচ্ছে। আমি বাম হাতে ওর মাথাটি উপরের দিকে তুলে ধরে জাহাজে ইশারা করলাম ধীরে ধীরে রশি টানার জন্যে।

আমার গ্রীন সিগনেল পেয়ে জাহাজ থেকে রশি আস্তে আস্তে টানা শুরু করল। আমি তখন নিজেকে সম্পূর্ন পানির উপর ছেড়ে দিলাম। আমি জাহাজে থাকতেই আমার কানের প্রবেশ পথ কটন দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিলাম যাতে লবণাক্ত পানি মাথার ভিতর ঢুকতে না পারে। কারণ আমার ধারণা ছিল মাথার ভিতর লবণাক্ত পানি প্রবেশ করলে চিন্তা ধারা স্বাভাবিক কাজ করতে পারবে না। তা ছাড়া মাঝ দরিয়ায় জ্ঞান হারাবারও আশংকা করেছিলাম। উল্লেখ্য যে সম্পুর্ন বেসরকারী আমাদের এই ত্রাণবিতরণ অভিযানে আমরা খুব ছোট খাট জিনিসের প্রতিও নজর রেখেছিলাম। যেমন- মোমবাতি, ম্যাচ, কাপুর, সিপ্টেপিন, ব্লেড, টয়লেট পেপার, বোল, গ্লাস, চামচ, এমন কি আমরা সুই-সুতা পর্যন্ত নিয়েছিলাম।

আমাদের সাত বস্তা ত্রাণ সামগ্রীর প্রধান বিষয় ছিল খাদ্য, বস্ত্র, ঔষধ। খাদ্য ছিল চিড়াগুড়। সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের বিষয়; সেটা হল লবণ তৈরীর দেশে আমাদেরকে লবণও নিতে হয়েছিল। ছোট বড় সকলের জন্যে মোট নয়শত ঊনষাট পিছ কাপড় আমাদের সাথে ছিল। এ সমস্ত ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করতে গিয়ে কুতুবদিয়ায় আমরা বহু প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিলাম। আমাদের জ্ঞান ভান্ডারে সঞ্চিত হয়েছিলো বহু নতুন এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতা।

আমরা গ্রুপিং করে সেখানে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছিলাম। কেউ কাপড়, কেউ খাদ্য-বস্তু, কেউ বস্ত্র-পাতি, ইত্যাদি বিতরণ করেছিলাম। সেখানকার সক্ষম এবং শিক্ষিত লোকেরা আমাদের কাজে সহযোগিতা করেছিলো। সিরাজুল ইসলাম নামের গাজীপুর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র আমাদেরকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সক্রিয় সহযোগিতা করেছিল। শুনেছি বর্তমানে ঐ সিরাজুল ইসলাম ভাই জেলা জজ পর্যায়ের দায়িত্বে আছেন।

কুতুবদিয়ায় যখন আমরা সেবা বিতরণ করছিলাম তখন সেখানে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার আমাদেরকে রুটির ঝুড়ি নামিয়ে দিয়েছিল বিতরণের জন্য। আমাদের কে দিয়েছিল কারণ আকাশ থেকে ফেলা ঝুড়িগুলো আদম সন্তানের গলিত নাড়িভুড়ি এবং প্রভূ ভক্ত জীব-জন্তুর পঁচা দূর্গন্ধ-যুক্ত পানিতে ডুবে যাচ্ছিলো বলে।

সেখানে আমার দায়িত্ব ছিল ডাক্তারী করা। এলাকার শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত এমন একজন মানুষ পাওয়া যাবেনা যে আহত হয়নি। কারো হাত কেটে গেছে, কারো পা কেটে গেছে, কারো মাথা ফেঁটে গেছে, কারো বুকে জখম হয়েছে, কারো শরীরের মাংস সহ কেউ যেন খামছে খেয়ে ফেলেছে। জখম থেকে রক্ত ঝরছে, পুঁচ ঝরছেি, পানি ঝরছেি এবং বিনা চিকিৎসায় পঁচা দূর্গন্ধ বের হচ্ছিলো। কারো মাথা ব্যথা, কারো গায়ে জ্বর, কারো পেট কামড়ি, কারো সর্দি, কারো ডায়রিয়া- এই ছিল তখন এলাকাবাসীর অবস্থা।

যেখানে আমরা সেবা বিতরণ করছিলাম সেখানে গত আট দিনে অন্য কোন সরকারী বা বেসরকারী সাহায্যকারী দল পৌছেনি। আমি একেক বাড়ীতে যাচ্ছিলাম, আসলে ঘূর্ণি ঝড়ের কারণে সেখানে কোন বাড়ীর অস্থিত্ব ছিলো না। ভাংগা বেড়া, টিন, গাছ ইত্যাদি মাটিতে বাঁকা করে রেখে অন্য পাশে বাঁশ খুটা দাঁড় করিয়ে কোন রকমে মানবেতর জীবন অতিক্রম করছিলো এলাকাবাসী।
(চলবে)

৪র্থ পর্বের লিংকঃ

http://www.sonelablog.com/উত্তাল-সাগরে-আমি____৪____-মোট-৭-প/

#

(y) সিরিজটি মোট ৭ পর্ব

0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ