ইসলামে সুদকে হারাম ও ব্যবসাকে হালাল করা হয়েছে। খুব সহজ ভাষায় এবং সাদা-সিধে ভাবে 'সুদ' আর 'ব্যবসা' কে সংজ্ঞায়িত করা যাক।

সুদ হচ্ছে অলস টাকা নিজে সরাসরি কোনপ্রকার উৎপাদন বা ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে অন্য কাউকে টাকা লগ্নির বিনিময়ে নির্দিষ্ট হারে মূল লগ্নির উপর যে অতিরিক্ত অংশ নেয়া হয়। আর ব্যবসা হচ্ছে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে সরাসরি পন্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় বা উৎপাদন এ অর্থ বিনিয়োগ ও ঝুঁকি গ্রহণ করা।

প্রাক-ইসলাম সময়ে মহাজনী ব্যবসা সমাজে উৎপাদনহীনতা এবং আর্থ-সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা রাখতো। ধনীরা তাদের জমানো অর্থ কোনপ্রকার উৎপাদন বা ব্যবসায় বিনিয়োগের ঝামেলায় না গিয়ে তুলনামূলক দরিদ্র লোকদের মাঝে চড়া সুদে অর্থ লগ্নি করতো। সুদের হার এতই বেশি থাকত যে কয়েক মাসের মধ্যেই সুদে-আসলে লগ্নিকৃত অর্থ দ্বিগুণ-তিনগুণ হয়ে যেত। আর এই অর্থ ফেরৎ না দিতে পারলে ঋনগ্রহীতা এবং তার পরিবারের উপর নেমে আসতো অমানবিক নির্যাতন ও অত্যাচার।

ঠিক এই পরিস্থিতিতে ব্যবসাকে ভাবা হয়েছে উত্তম। কোন মহাজন যদি সুদের বিনিময়ে অর্থ লগ্নি না করে সরাসরি ব্যবসায় বিনিয়োগ করতো তা হলে অর্থনীতিতে সরাসরি এর অবদান থাকতো অনেক ইতিবাচক। নতুন নতুন পন্যউৎপাদন জীবনযাত্রার মানকে উন্নত করে ও কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয় ফলে সমাজ আর্থ-সামাজিক ভাবে উন্নততর হয়। যার ফলে অলস অর্থ সুদের বিনিময়ে লগ্নি না করে ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্য ইসলামে বলা হয়েছে। ব্যবসায়কে করা হয়েছে হালাল আর সুদকে হারাম।

সেই অর্থে 'সুদ' নয় বরং ব্যাকিং (ইসলামীক এবং কনভেনশনাল উভয়ই) প্রথাটাই হারাম!! কিন্তু আসলেই কী তাই?

খুব গভীরে ভেবে দেখলে দেখা যায় এই আধুনিক বিশ্বে, সভ্যতা এখন অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে যুৎসই অর্থনৈতিক সিস্টেমএ ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকঋণ বাদে বড় কোন ব্যবসায়ই এখন অসম্ভব ।

ইসলামী ব্যাংক কি আসলে ব্যবসা করে?

'ব্যবসা' বলতে সরাসরি কোন পন্যসমাগ্রী ক্রয়ের মাধ্যমে আর্থিক ঝুকি গ্রহণ করা এবং সেই পন্যসমগ্রী বিক্রয় (লাভ অথবা ক্ষতিতে) করাকে বুঝায়। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকি সিস্টেমএ এই প্যাচটা অদ্ভুৎ। বলা হয় গ্রাহক অর্থাৎ যিনি ব্যবসা করেন তাকে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসায় পরিচালনার সাপেক্ষে অর্থপ্রদানই হচ্ছে বিনিয়োগ (কনভেনশনাল ব্যাংকিংয়ে যাকে বলা হয় ঋন)। খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার হচ্ছে কোন ব্যবসার পূর্বনির্ধরিত কোন লাভের হার থাকতে পারেনা কারন ব্যবসায়ীক পণ্যের চাহিদা ও যোগান, বাজার পরিস্থিতি, আর্ন্তজাতিক মুদ্রা বিনিময় হার ইত্যাদির উপর নির্ভর করে ব্যবসায়র বেশি বা কম মুনাফা অর্জিত হয়, এমন কি লাভের জায়গায় ক্ষতিও হতে পারে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ইসলামী ব্যাংকিংএ এই মুনাফার হার পূর্বনির্ধারিত হয়ে থাকে এবং লাভের হার ( আমার জানা মতে ইসলামী ব্যাংকগুলোর সাধারণ ব্যবসায়ীক বিনিয়োগে পূর্বনির্ধারিত মুনাফার হার ১৫-১৮ শতাংশ) থাকলেও কোনপ্রকার ক্ষতির হার নির্ধারিত আছে বলে আমার জানা নেই!! অর্থাৎ ব্যাপারটা দাঁড়ায় ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে কেউ বিনিয়োগ করলে তার ব্যবাসায় কোনদিন কোন ক্ষতি হবে না, শতভাগ মুনাফা নিশ্চিত!! ।

এখানে খুব সহজ একটা প্রশ্ন মনের ভেতর জাগতে পারে যে ইসলামী ব্যাংকেও তো আর দশটা কনভেনশনাল ব্যাংকের মত দৈনন্দিন লেনদেন চলে তাহলে তারা ব্যবসাটা করে কখন ও কিভাবে! ব্যাংক কি সরাসরি তার বিনিয়োগ গ্রহীতা ( না কি ব্যবসায়ীক অংশীদার!) এর কোন ব্যাবসায়ীক ক্রয়কার্যে অংশগ্রহণ করে! তা না হলে আর্থিক ঝুঁকি (ব্যবসার অন্যতম উপাদান) গ্রহণ করে কিভাবে?

উত্তরগুলোও অদ্ভুত! না, ইসলামী ব্যাংকের কর্মচারী-কর্মকর্তা কেউই তাদের বিনিয়োগকৃত (ঋণগ্রহিতার) প্রতিষ্ঠানে সরাসরি উপস্থিত থেকে ব্যবসা করেন না (তাইলে ব্যাংকিং করবে কে?)। বিনিয়োগ গ্রহীতা যার কাছ থেকে পন্যসামগ্রী ক্রয় করেন অর্থৎ বিক্রেতাকে ব্যাংক সরাসরি মূল্যপরিশোধ করে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক-মিঃ কাদের টাঙ্গাইলের একজন ধান ব্যসায়ী। তিনি দূর-দূরান্তের বিভিন্ন জেলা যেমন-নওগাঁ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁ এর প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জের হাটবাজার ও মোকাম থেকে ধান ক্রয় করে চাউল তৈরি করে বিক্রি করেন। তিনি যদি তার ব্যবসার প্রয়োজনে ইসলামী ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ (ঋন) গ্রহন করতে চান তাহলে ইসলামী ব্যাংক তাকে একটা পূর্বনির্ধারিত মুনাফার হার বেঁধে দিবে। ধরা যাক ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ গ্রহণ পূর্ব্বক মিঃ কাদের দিনাজপুরের সেতাবগন্জ উপজেলার তালবাড়ী ইউনিয়নের ভাটারা গ্রামের হাটে কৃষক বাচ্চুমিয়ার কাছ থেকে তিন মণ ধান ক্রয় করলেন। হিসেবমতে ইসলামী ব্যাংক টাঙ্গাইল শাখা দিনাজপুরের সেই প্রত্যন্ত গ্রামের প্রান্তিক চাষী বাচ্চু মিয়াকে মূল্য পরিশোধ করার কথা। এখন প্রশ্ন-বাচ্চু মিয়া কি টাঙ্গাইলে ইসলামী ব্যাংকে যাবে তার বিক্রিত ধানের দাম আনতে নাকি ইসলামী ব্যাংক দিনাজপুরে যাবে ধানের দাম দিতে? বাস্তবে কোনটাই হয় না। মিঃ কাশেমকে তার পরিচিত ইসলামী ব্যাংকে হিসাব আছে এমন কাউকে ক্রেতা সাজিয়ে অথবা নকল ভাউচার বানিয়ে ব্যাংক থেকে বিনিয়োগরে অর্থ উত্তোলন করতে হয়! ব্যাপারটা কী ব্যবসা হলো নাকি জালিয়াতী আর মিথ্যাচার?? আর পূর্ব নির্ধারিত লাভের হার এর ব্যাপারটা তো থাকছেই যার সাথে কনভেনশনাল ব্যাংকের সুদ এর কোন মৌলিক পার্থক্য নেই।

ইসলামী ব্যাংকিং এ কিছু গুরত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্যনীয়-

১) মুনাফার হার সুদের হারের মতই পূর্বনিধারিত এবং এই হার প্রথাগত বা কনভেনশনাল ব্যাংকের সুদের হারের সাথে কম্পিটেটিভ রেঞ্জে নির্ধারিত হয়। যেমন- কনভেনশনাল ব্যাংকগুলোতে সুদের হার গড়ে ১৫% থেকে ১৮% এর মধ্যে। ইসলামী ব্যাংকিংএও মুনাফার হার ১৫% থেকে ১৮% এর মধ্যে!!

২) ইসলামী ব্যাংক দাবী করে যে তারা ব্যবসার ভিত্তিতে বিনিয়োগ করে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিনিয়োগগ্রহীতা নিজেনিজেই ব্যবসা করেন, তার ক্রয়-বিক্রয়, উৎপাদন বা ব্যবসা পরিচালনার সাথে ব্যাংকের কেউ থাকেন না। বরং বিক্রেতাকে মূল্য পরিশোধের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিথ্যাচার ও জালিয়াতির আশ্রয় নিতে হয়।

৩) ব্যবসায় এর মৌলিক একটা শর্ত হচ্ছে ব্যবসায়ীক ক্ষতির ঝুঁকি গ্রহণ। এক্ষেত্রে ব্যাংক বিন্দুমাত্র ঝুঁকি গ্রহণ করে না বরং মুনাফার হার পূর্বেই বেঁধে দেয়। এমনকী বিনিয়োগ গ্রহীতা যদি ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখিন হয়ে গ্রহিত অর্থ ফেরৎ না দেন বা বিলম্ব করেন ব্যাংক তার কাছে গচ্ছিত বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে বিক্রয় করে তার ব্যাবসায়ীক পার্টনারকে আরো ক্ষতির মুখে ছুড়ে ফেলে!

৪) যে কোন ব্যাংকের চাইতে ইসলামী ব্যাংকে আমানতের হার সব চাইতে কম। অন্য দশটা ব্যাকং আপনাকে ফিক্সড ডিপোজিটো উপর যদি ১২-১৩ শতাংশ ইন্টারেস্ট দেয় ইসলামী ব্যাংক দিবে মাত্র ৭-৮ শতাংশ কারন তারা জানে সাধারন মুসলিমগন সুদ থেকে ১০০হাত দূরে থাকার জন্য এবং বেহেস্তের টিকিট লাভের আশায় শুধু তাদের কাছেই অর্থ গচ্ছিত রাখবে, এক লক্ষটাকায় এক কোটি টাকা সুদ দিলেও কনভেনশনাল ব্যাংকে যাবে না। ফলে অন্য ব্যাকের স্প্রেড (ঋন ও আমানতের সুদের হারের পার্থক্য) যদি ৫ হয় ইসলামী ব্যাংকে সেটা হয় ৮-১০ শতাংশ। এর সম্মিলিত ফল হচ্ছে ২০১২ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর বার্ষিক পরিচালন মুনাফা ১,৮০০ কোটি টাকা ( নিকটতম প্রতিদন্দ্বি প্রাইম ব্যাংক- মাত্র ১,০০০ কোটি টাকা!)।

অথচ আমরা সাধারন মুসলমানরা কখনো এ বিষয়গুলো ভেবে দেখিনা বরং মনে তাদের উপর অন্ধ বিশ্বাস রাখি যে তারা আমাদের জন্য বেহেস্তের টিকিট বিতরণের কন্ট্রাকটরি নিয়েছে। ইসলামী ব্যাংক সাধারন মুসলামানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুজিঁ করে ব্যবসার নামে মিথ্যাচার আর জালিয়াতি করে গড়ে তুলেছে এক বিশাল অর্থের উৎস। আর আমরা অতি সাধারণ বিশ্বাসী মুসলামানরা প্রতিনিয়ত বোকা হচ্ছি আর আমাদের অজান্তেই পরিপুষ্ট করছি ৭১ এর ঘাতক দালাল-রাজাকারদের, প্রতিনিয়ত অপমানিত করছি দেশমাত্রিকা, লক্ষ শহীদের রক্ত আর কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতাকে ।

দয়াকরে একটি বার বিষয়টিকে গভীর ভাবে ভেবে দেখুন।

0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ