ইশ্বরের পাহাড় (প্রথম পর্ব)

তৌহিদুল ইসলাম ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮, বুধবার, ০৮:৫৪:১১অপরাহ্ন ভ্রমণ ২৩ মন্তব্য

পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে হাঁটছি আমি আর মমব্রু। সে আমার আঙুল আলতো হাতে চেপে ধরে হাটছে। ছেড়ে দিচ্ছে আবার একটু পর পর এসে হাতে হাত রেখে হাঁটছে। সন্তান যেমন বাবার হাত ধরে হাটে সেরকম। এই অনুভুতিটা আমারো ভালো লাগছে বলে আমি না করিনি তাকে।

আমার পিছনে স্বপন মামা সাথে লিপন ভাই। রাঙামাটি থেকে কর্ণফুলী নদীপথে আরো তিন ঘন্টা নৌকায়, তারপর এক ঘন্টা উঁচুনিচু পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটাপথ পেড়িয়ে আমরা এসেছি ছোট্ট গ্রাম কিয়াকিতে। এটাই মমব্রুদের গ্রাম। চারপাশটা এত সবুজ শান্ত আর নিরিবিলি, কুলকুল শব্দে বয়ে চলা ইতাই ঝড়নার পাড় ঘেসে এই কিয়াকি গ্রামের অবস্থান। সে নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখে এতঘন্টার কষ্টকর যাত্রার সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেল আমার। মমব্রু হাত দিয়ে ইশারা করায় দূরে দেখতে পেলাম উঁচু সবুজে ঘেরা তাকিয়াপালা পাহাড়। দিনের উজ্জ্বল রোদের আলোয়ে সেদিকে তাকিয়ে চকচকে সবুজে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। স্থানীয় অধিবাসীরা তাকিয়াপালা পাহাড়কে নাম দিয়েছে ইশ্বরের পাহাড়!

অফিস থেকে ক'দিনের ছুটি নিয়ে আমি আর সহকর্মী লিপন ভাই এসেছি রাঙামাটিতে। এখানে স্বপন মামা মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা। সেই সুবাদে এখানে আসা। আমার অতি উৎসাহ দেখে মামা নিজেই এই নির্জন কিয়াকি গ্রামে আসার পরিকল্পনা করেছেন। আমাদের মূল গন্তব্য তাকিয়াপালা পাহাড়। যেটি এদিকে দেশের সীমানার শেষ পাহাড়, ওপারে মায়ানমার। তার চূড়ায় উঠে আমরা সূর্যোদয় দেখবো। মায়ানমারের আকাশে সূর্য উঠবে আর আমরা বাংলাদেশ থেকে দেখবো, এমনটা ভাবতেই শিহরিত হয়ে উঠলাম আমি। লিপন ভাইয়ের হ্যা না বলতে কিছু নেই। আমি যেখানে সেও সেখানে।

তাকিয়াপালা পাহাড় যেতে হয় এই কিয়াকি গ্রাম পার হয়ে। বিদ্যুৎ নেই, মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। মোটকথা স্বাভাবিক আরামদায়ক জীবনযাপনের সেখানে কোন ব্যবস্থা নেই। মামা নিজেও আগে কিয়াকি গ্রামে আসেননি বলে তারও সঠিক ধারনা নেই এ সম্পর্কে। এ সব কিছু মেনে নিয়েই আমরা এসেছি। এই গ্রাম পেরিয়ে পায়ে হাঁটা দু'মিনিটের পথ পার হলেই মিয়ানমার। বাংলাদেশ আর মিয়ানমারের মাঝখানে নেই কোন কাটাতাঁরের বেড়া। বড় বড় এবড়োখেবড়ো টিলাগুলোই বর্ডার সীমানা। মাঝেমধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা আসে টহল দিতে। তারাও পায়ে হেঁটে আসে। তাদের ক্যাম্প থেকে এ গ্রামের দুরত্ব প্রায় অর্ধেক দিনের পথ।

মামার সুবাদে আমরা সেনাবাহিনীর অনুমতি পেয়েছি এখানে আসতে। তবে জানমালের নিরাপত্তা নিজেদের বহন করতে হবে এই মর্মে লিখিত দিয়ে আসতে হয়েছে আমাদের। তারা উপকার করেছে এটাই, সাথে আমাদের গাইড মমব্রুকে দিয়েছে। মমব্রু প্রায়শই এই সেনা ক্যাম্পে যাতায়াত করে তাদের সাথে। সে স্কুলে পড়েনা, কিয়াকি গ্রামে স্কুল নেই। তেরো চৌদ্দ বছর বয়স। হালকা পাতলা লিকলিকে শরীর তবে বেশ শক্তসামর্থ্য কিশোর ছেলে সে। এই পাহাড়েই তার জন্ম, এখানকার গহীন বন জংগল আর পাহাড় তার নখদর্পনে। বাংলাদেশী সেনাসদস্যরা টহলে আসলে তাকে সাথে নেয় গাইড হিসেবে। তারাই আমাদের মমব্রুকে সাথে দিয়েছে, তাতে আমাদের রাস্তাঘাট চিনতে কোন অসুবিধা হবেনা এটা ভেবেই।

মমব্রুরা মং উপজাতি। তার মায়ের নাম চিনিপ্রু। এখানে নারী শাসিত সমাজ ব্যবস্থা। পাহাড়ে জুম চাষ করে নিজেরাই নিজেদের শস্য উৎপাদন করে। আর পাহাড়ি হাঁটাপথে কষ্টসাধ্য যাত্রা করে নদীর তীরের বাজারে গিয়ে বিক্রি করে। মমব্রুর বাবা নেই, মারা গিয়েছে তাকিয়াপালা পাহাড়ে। কিভাবে কেউ জানেনা। তার অন্তস্টিক্রিয়া স্থানীয়রা সম্পন্ন করেছে তাকিয়াপালা পাহাড়ের গোড়ায়, যেখানে তার মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল সেখানে। পুরো শরীর রক্তাক্ত আর থেঁতলে ছিলো তার, সবাই বলে ইশ্বর তার ছেলেকে নিজের বুকে টেনে নিয়েছেন।

বড় সমস্যা হলো মমব্রুদের ভাষা আমরা কেউ বুঝিনা, তবে তারা আমাদের ভাষা কিছু কিছু বোঝে। তাই ইশারায় কাজ চালাতে হচ্ছে। কিয়াকি গ্রামে এসে আমরা মমব্রুদের বাড়িতেই এলাম। গাছের খুঁটির উপরে সব ঘরবাড়ি। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ঘরে উঠতে হয়। পাহাড়ি হিংস্র পশুদের আক্রমন থেকে বাঁচার জন্যই এই ব্যবস্থা। সন্ধ্যা নামছে, গোধূলির লালচে আলোয় ইতাই ঝড়নার পানিতে লালচে আভা এসেছে। মামা চিনিপ্রুর হাতে জোড় করে কিছু টাকা গুঁজে দিতে চাইলেন কিন্তু মমব্রু জোরে জোরে মাথা নাড়ছে দেখে সে টাকা নিলোনা। মমব্রু তার মাকে মং ভাষায় আত্তি আত্তি বলে কিছু বললো যার একবর্নও আমরা কেউ বুঝলামনা। লিপন ভাই আমাকে বললেন মমব্রু তার মাকে আব্বা নামে কিছু সম্বোধন করেছে। সে এখানে আসার আগে গুগোল থেকে তাদের ভাষা জানার চেষ্টা করেছিলো। মা বাবা ভাই বোন ভাত পানি এসবের মং ভাষার আভিধানিক অর্থ সে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করেছে। কিছুই তার মনে নেই। শুধু আত্তি মানে বাবা এটাই মনে আছে। (চলবে)

ছবিঃ সংগৃহীত

0 Shares

২৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ