আ জার্নি বাই বাস!

বোকা মানুষ ৬ জানুয়ারি ২০১৫, মঙ্গলবার, ০২:২০:৫৭অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি, বিবিধ, ভ্রমণ ২০ মন্তব্য

গত কালকের চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার বাসযাত্রাটা ছিল বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরপুর! শুরু হল বাস কোম্পানির ফোনে। তারা জানালো যে রাত এগারটার বাস রাত নয়টায় ছাড়বে যাতে অবরোধ শুরু হওয়ার আগেই ঢাকায় প্রবেশ করা যায়! একবার ভেবেছিলাম যাত্রার দিন পরিবর্তন করি। কিন্তু ঢাকায় জরুরী কাজ থাকায় বিরক্তি নিয়েই ন'টা বাজে রওয়ানা করলাম! বাস ছাড়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই কোনো এক মহামতি তীব্র ঘনত্বের বায়বীয় দুর্গন্ধ ত্যাগের মাধ্যমে বাসের বাতাস বিষাক্ত করা শুরু করলেন! এরকম হঠাৎ যে কারো হতেই পারে ভেবে মাফলারে নাক চেপে ধরে নিজেকে আপাততঃ রক্ষার ব্যবস্থা করলাম! কিন্তু না! কপালে শনি থাকলে তা ঠেকায় কে! সেই অচিহ্নিত ভদ্রলোক/ ভদ্রমহিলা একই কাজ নিয়মিত বিরতিতে করে যেতে লাগলেন! এসি বাসের বদ্ধ বাতাসে এরকম বায়ুদূষণ যে নিউট্রন বোমার মতই ভয়ঙ্কর হতে পারে তা আশা করি ভুক্তভোগীমাত্রই বুঝবেন। যাই হোক, এক পর্যায়ে সহ্য করতে না পেরে দায়িত্বরত গাইডকে সবাই যাতে শুনতে পায় সেরকম উচ্চস্বরে বললাম, "ভাই, এয়ার ফ্রেশনারের ক্যানটা বাসের মধ্যে পুরা খালি করেন! দুর্গন্ধের অত্যাচারে তো টিকতে পারছিনা!" (ভাবলাম এটা শুনে হয়তো বায়বীয় গুনের অধিকারী ব্যাক্তির হুঁশ হবে, তিনি বাসের অন্য যাত্রীদের রেহাই দেবেন তার বায়বীয় অত্যাচার থেকে! কিসের কি! হাইওয়ে ইন আসা পর্যন্ত তিনি নিষ্ঠার সাথে তার অপকর্ম চালিয়ে গেলেন!) বিপদের উপর বিপদ, পাছপাকনা গাইড খুব মোলায়েম স্বরে বললেন "স্যার, এয়ার ফ্রেশনার শেষ হয়ে গিয়েছিল দেখে আনতে পারিনি!" বহু কষ্টে গাইডকে চাটগাইয়া চ বর্গের যাবতীয় গালি দেয়া থেকে বিরত করলাম নিজেকে! হাইওয়ে ইনে বাস থামতেই লাফ দিয়ে বাসের সামনের অংশে চলে গেলাম এবং কেউ নামার আগেই উচ্চস্বরে বললাম "ভাই বা বোন, আপনাদের যে-ই বাসের বাতাস বিষাক্ত করতেসিলেন এতক্ষণ, খাওয়া দাওয়া করেন বা না করেন, কিন্তু আল্লাহ্-র ওয়াস্তে এইখানে হাইগা নিয়েন! এদের এখানে পরিষ্কার আর স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা আছে!" দায়ী ব্যাক্তি আমার পরামর্শ গ্রহন করেছিলেন সম্ভবতঃ। কারন হাইওয়ে ইন ছেড়ে আসার পর এই অতিয়াচার আর হয়নি!

 

কিন্তু যাত্রাবিরতির পর শুরু হল আরেক নাটক! আমার পেছনের সিটের যাত্রী সিটে বসতে গিয়েও ছিটকে সরে এলেন। এবং উর্ধ্বশ্বাসে গাইড অভিমুখে ছুটলেন! তার পিছু পিছু গিয়ে যা জানলাম, তা হলো: পেছন দিকের কোনো সিটের যাত্রী বমি করে ফ্লোর ভাসিয়েছেন এবং সেই বমি আমার পেছনের যাত্রীর পায়ের কাছে পর্যন্ত চলে এসেছে! তিনি বললেন যে এ অবস্থায় সিটে বসা তার পক্ষে সম্ভব না, অতএব ফ্লোর পরিষ্কার করা হোক! তার যে পাছ পাকা, সেটা গাইড আবার প্রমান করলো পরিষ্কার করার উদ্যোগ নেয়ার বদলে কে বমি করেছে সেটা বের করার উদ্যোগ নিয়ে! আমি ঘটনা দেখে যাচ্ছিলাম চুপচাপ। আমার পেছনের যাত্রীদ্বয় এবং অন্যরাও বারবার ফ্লোর পরিষ্কারের তাগাদা দিচ্ছেন, কিন্তু পাছপাকনা গাইড সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে কে বমি করেছে তা বের করার চেষ্টা করেই যাচ্ছে! এদিকে ওই দুই যাত্রী বাসে না বসায় বাসও ছাড়তে পারছেনা! ভাবলাম অনেক হয়েছে! এতক্ষন আমি গাইডের সাথে আপনি সম্বোধনেই কথা বলছিলাম। কিন্তু এবার গলায় কর্তৃত্বের স্বর ফুটিয়ে তাকে বললাম "কি ব্যাপার, তুমি ফ্লোর পরিষ্কারের ব্যাবস্থা না করে কে বমি করেছে সেই তদন্ত শুরু করলে কেন?" উত্তরে থতমত খেয়ে গাইড যা বললো, তার সারমর্ম হল যে, বমি পরিষ্কার করাতে হলে টাকা লাগবে, এবং সে টাকা দিতে হবে বমি করা যাত্রীকে। তাই সে দায়ী যাত্রীকে খুঁজছে! শুনে আমার মেজাজ চরমভাবেই খিঁচড়ালো! এবার গলায় কর্তৃত্বের সাথে রাগ মিশিয়ে বললাম "ফাজলামি করার জায়গা পাওনা, না! তুমি এখন নামো, হাইওয়ে ইনের ম্যানেজারকে বলো এটা পরিষ্কার করার ব্যাবস্থা করতে তোমাকে সাহায্য করার জন্য!" আমার চেহারায় কি ছিল জানিনা, কিন্তু আমার এ কথার পর আমার দিকে তাকিয়ে সে সুড়সুড় করে নেমে গেল এবং পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব ঠিকঠাক! যাই হোক, বমি মোছা হলেও বমির গন্ধ তো আর যাচ্ছিল না। তাই ঢাকা পৌঁছানো পর্যন্ত আর ঘুমাতে পারিনি। ভাবলাম ঢাকায় যেহেতু রাত তিনটার দিকে পৌঁছুবো, তারপরই না হয় কাউন্টারের ওয়েটিং রুমের একটা বেঞ্চিতে সকাল পর্যন্ত যদ্দুর পারি ঘুমিয়ে নেব!

 

ঢাকায় পৌঁছুলাম রাত তিনটায়। দেখি যে কাউন্টারের সামনে বাস রেখেছে, সেটা বন্ধ। গাইডকে কাউন্টার খুলতে বলাতে সে বললো যে অন্য কাউন্টারটা খোলা আছে, কিন্তু মালিবাগ ফ্লাইওভারের কাজ চলতে থাকায় সেটার সামনে থামাতে পারেনি। সেই কাউন্টার এটা থেকে ২০০-৩০০ গজ দুরে। অগত্যা তল্পি তল্পা নিয়ে হেঁটেই সেটার দিকে রওয়ানা দিলাম সবাই। কাউন্টারে গিয়ে দেখলাম সেখানে রাত্রের বাসের দুয়েকজন যাত্রী আগে থেকেই আছে। তাদের মধ্যে একজন মোটামতন যাত্রী একটা বেঞ্চের একপ্রান্তে বসে বসেই হালকা নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে, আর তার বেঞ্চের অন্যপ্রান্তে বয়স্ক একজন যাত্রী বিরস বদনে বসে আছে। যাই হোক একটা বেঞ্চিতে ব্যাগকে বালিশ বানিয়ে "অবশেষে ঘুমের সুযোগ" এই ভাবনা নিয়ে একটু চিৎ হলাম। চোখটা সবে লেগে এসেছে এই সময় হঠাৎ মিগ-২৯ জঙ্গী বিমানের মত শব্দে নাক ডাকার শব্দ এবং একজনের কন্ঠে "অই ব্যাডা, চোপ!" ধমক এবং সমস্বর হাসির শব্দে চোখটা খুলে গেল! একটু ধাতস্থ হতে যা বুঝলাম, ওই মোটা যাত্রীর নাক ডাকার শব্দের তীব্রতা আকষ্মিক বেড়ে যাওয়াতে ওই বয়স্ক যাত্রীর চটকাও হঠাৎ ছুটে যায়! তাতেই ওই বয়স্ক যাত্রীর ওই ধমক। নাক ডাকা এবং ধমকের সিকোয়েন্সটা এতই কমিক ছিল যে কেউ হাসি আটকে রাখতে পারেনি। এরপর চলতে থাকলো মোটা লোকের সামনে, পিছনে, বামে, ডানে ঝুঁকে বিভিন্ন তাল, লয় আর মাত্রায় নাক ডাকা এবং কিছুক্ষণ পরপর বয়স্ক যাত্রীর "হেতেরে ধাক্কা দেন না কেউ", "নাক ডাকন ন', যেন টাক্টর চইলতেছে", "হেতে কিছু খাইছে, খালি খাইছে ন', হ্যাড ভরি খাইছে, নইলে এত ধাক্কায়ও উডে না ক্যায়া", "হেতে বাফের ব্যাডা একজনই বেগ্গুনেরে চেতন রাইখছে", ইত্যাকার বিরক্ত কিন্তু কমিক মন্তব্যের পালা! আর সেসব শুনে সবার হা হা, হি হি, হো হো, খিক খিক, খ্যাঁক খ্যাঁক হাসি! এসবের মধ্যে কি আর ঘুমানো যায়! তাই গ্যাঁট হয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম আলো ফোটার। এরপর আকাশ একটু ফর্সা হওয়ার পর লোক চলাচল শুরু হতেই যা থাকে কপালে ভেবে আল্লাহ্-র নাম নিয়ে একটা সিএনজি নিয়ে রওয়ানা দিলাম বাসার উদ্দেশ্যে! ভোর সাতটায় বাসায় এসে ঘুমন্ত ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে দিলাম অবশেষে শান্তির ঘুম! শেষ হল বিচিত্র এক বাস যাত্রার রাত!

0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ