রতন এই শহরে কন্কনে শীতের দিনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফ্লায়ার বিলি করে। হ্যাংলা পাতলা গড়ন। শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যাও আছে। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় হাসপাতাল, ডাক্তার এড়িয়ে চলে। হাঁপাতে হাঁপাতে একদিন আমায় ফ্লায়ার দিচ্ছিলো। আমি ব্যাগে থাকা ইনহেইলারটি ওকে দেই। সেই থেকে মাঝে মাঝেই ওকে ইনহেইলার দিতাম। সেটা ব্যবহার করে ও ভাল বোধ করতো। এ নিয়ে তাঁর কৃতজ্ঞতার শেষ নাই।
একবার দেশে যাবার আগে কেনাকাটায় ব্যস্ত আমি। জংশন ব্লুবার্ডের মোড়ে দেখা। বলি, "রতন, দেশে যাচ্ছি, তোর মায়ের জন্য কিছু দিবি ?" রতন কাচুমাচু করে বলে, "আফা, এই দ্যশে তো সবই দাম, এরচেয়ে টাকা পাঠাইলেই বরং মা'র কাজে লাগে"। আমি বলি, সবসময় তো বলিস তোর মা কোমরের ব্যথায় কষ্ট পায়, "ব্যনগাই" নামের একটা ব্যথার মলম আছে, ওইটা দিতে পারস"। রতন হিসাব করে। টাকা আর ডলারের হিসাব। অতঃপর বলে, "আফা, বাংলাদেশের "টাইগার বাম" আর এই দেশের "ব্যনগাই" একই জিনিষ। আমি বুঝি, রতন তাঁর কষ্টের প্রতিটি ডলারই ওর মাকে পাঠায়, এটা সেটা কিনে দেয়াকে অপচয় কিংবা বিলাসিতা মনে করে। জানালো, কিছু ডলার দিবে ওর মায়ের জন্য। আমি পরদিন যে কোন একসময় এসে নিয়ে যাবো জানিয়ে অন্য কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে যাই।
পরদিন দুপুরে ওঁর বাসার সামনে গাড়ি পার্ক করে ফোন দেই। রতন ওর বাসায় এক কাপ চা খেয়ে যেতে পীড়াপীড়ি করে। পুরনো এপার্টমেন্ট। যেতে যেতে বাঙালি রান্নার গন্ধ নাকে আসছিলো। কখনো শুঁটকির গন্ধ, কখনো গরুর মাংসের গন্ধ। এক ফ্যামিলির সাথে শেয়ারে থাকে। এক বেডরুমের বাসার লিভিং রুমে গাদাগাদি করে দু'জন আঙ্কেল আর রতন থাকে। আমায় কোথায় বসতে দিবে, কি খাওয়াবে__ রীতিমত হুলুস্থুল দশা। যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ অতিথি আমি ! চা দিতে দিতে রতন বলে, " আফা, জীবন একটা খড়কুটা, ভাসাইতে ভাসাইতে আমারে এইখানে নিয়া আসছে, তা-ও মন্দের ভাল মা'রে, ভাইবোনগুলারে কিছু দিতে পারি।
ফিরে আসবার সময় রতন বালিশের নিচ থেকে একটি খাম ধরিয়ে দেয়, ওর মায়ের জন্যে। গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যায়। গলার স্বর একটু নিচুতে নামিয়ে অপরাধীর মত করে বলে, "আফা, আমি যে এইখানে এমন আছি, আমার মায়েরে কইয়েন না, তাঁরা জানে আমি অনেক ভাল আছি"। আমি পৃথিবীর সমস্ত বিস্ময় নিয়ে তাকাই। এই যে, পরিবারের এতগুলো মানুষের সুখের জন্যে কন্কনে শীতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অর্থ উপার্জনের প্রাণান্তকর চেষ্টা, অর্থ সাশ্রয়ের জন্যে কষ্ট করে থাকা__ এটা কি অপরাধ !! মনেমনে বলি, তুই আসলেই তোর মায়ের অমূল্য রতন !
এসব বছর কয়েক আগের কথা।
নিউইয়র্কে এখন বসন্ত। বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ। ব্যস্ততম জংশন ব্লুবার্ডে টুকটাক কিছু কেনাকাটার উদ্দেশ্যে যাই। রতনকে আজ আর ফ্লায়ার বিলি করতে দেখিনি। একটু এগোতেই ফলের দোকানে দেখি। বিক্রেতার সহকারী হিসেবে কাজ করছে। এগিয়ে যেতেই উৎফুল্ল কণ্ঠে জানালো দেশে ফিরে যাচ্ছে। ওর মা'ও গত হয়েছে গতবছর। আমায় বলে, " আফা, আফনের আব্বা, আম্মারে কিছু দিবেন ? আমি পৌঁছায়া দিমু নে"। বলি, "আমার তো আব্বা, আম্মা নাই"। রতনের উৎফুল্ল মুখ নিমিষেই বিবর্ণ হয়ে যায়। ছোট্ট একটি শ্বাস নিয়ে বলে, " ওহ্, আফ্নে তো দেহি আমার লাহান-ই, এতিম "।
বাড়ি ফিরছি। বাবা-মা দু'জনের মায়াময় মুখ দুটি ভেসে উঠে চোখের সামনে।
বাবার কণ্ঠস্বর কানে বাজে__ রিমি, লোক পাইলে আমার জন্য ভিটামিন ট্যাবলেট পাঠাইস।
মায়ের কণ্ঠস্বর কানে বাজে___ রিমি, লোক পাইলে ব্যথার মলম পাঠাইস......
গাড়ি ফরটি থ্রি এভিনিউ ধরে এগিয়ে চলছে। রাস্তার দু'ধার ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। ভুল করে এক চিল্তে সোনালি রোদ মুখে এসে পড়ে। শেষ বিকেলের রোদ। রেকর্ড প্লেয়ারে গান বেজেই চলছে বিরামহীন ...
কেউ বলে দখিনা, কেউ বলে মাতাল বাতাস
আমি বলি, আমার দীর্ঘশ্বাস ...
কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে পলাশের মাস...
১৪টি মন্তব্য
লীলাবতী
বাস্তব কাহিনীটি হৃদয় ছুঁয়ে গেলো। প্রবাসে যিনি থাকেন কত চেষ্টা থাকে তার প্রিয় পরিজনকে ভালো রাখার। কষ্টগুলো বুকে চাঁপা দিয়ে হাসি ফোটান বাবা মা ভাইবোনের মুখে। সবাই ভালো থাকুক।
রিমি রুম্মান
সব প্রবাসী আবার এমন নয়, আপু। কেউ কেউ আছেন, শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। দেশে বাবা-মা, ভাই-বোনদের খবরও রাখেন না। এমন মানুষও আমার আশেপাশেই দেখা। এদের নিয়ে লিখবো আরেকদিন।
ভাল থাকুন সবসময়।
লীলাবতী
অপেক্ষায় থাকি আপনার লেখার জন্য। নিজের চারপাশের মানুষদের নিয়ে আপনি যে ভাবে লেখেন এমনটি আমি আর কোথাও পড়িনি।
আপনিও ভাল থাকুন আপু।
জিসান শা ইকরাম
এই সব হাসি আনন্দ কস্ট নিয়েই আমাদের দিনরাত্রি। জীবন থেকে নেয়া লেখায় আপনি তুলনাহীন।
শুভ কামনা।
রিমি রুম্মান
দাদাভাই, কত কি-ই দেখি চারিপাশে। লিখলে শেষ হবার নয়। শুধু একটু সময় বের করতে পারলেই বাস্তব ঘটনাগুলো সামনে নিয়ে আসবো। ভাল থাকুন। সুস্থ থাকুন।
ইকবাল কবীর
আমরা প্রবাসিরা কত কষ্ট করে দেশের প্রিয় মানুষের মুখে হাসি ফুটাই সেটা আমরা ছাড়া অন্য কেউ বুঝবে না। বাবা মা ভাই বোন সবাইকে ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরে একাকি জীবন মাঝে মাঝে খুব দুর্বিষহ হয়ে উঠে। তবুও দেশে ফোন করলে হাসি মুখে বলি “আমি খুব ভাল আছি মা”।
রিমি রুম্মান
আমার একটি লেখা আছে, প্রবাস জীবনের প্রথম দিকের যন্ত্রণাময় দিনগুলো নিয়ে। সারাদিন চাকুরি খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত আমরা রাতে বাড়ি গিয়ে মা’কে চিঠি লিখি__ ” আমরা অনেক ভাল আছি মা, চিন্তা করো না, দোয়া করো কেবল।”
কিছু মিথ্যে ক্ষতিকর নয়। কিছু মিথ্যে যদি মায়েদের অশান্ত মন শান্ত করে__ তবে সে মিথ্যে আমি বলেছি জীবনে একবার নয়, একাধিকবার। 🙁
ইকবাল কবীর
তা ঠিক বলেছেন। এই রকম মিথ্যা আমিও মাঝে মাঝে বলি মায়ের সাথে।
ব্লগার সজীব
প্রবাসিদের কষ্ট লেখায় ফুটে উঠেছে। স্বজনদের মুখে হাসি ফোটাতে সাধ্যের অতীত কাজ করেন সবাই।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন, নিরাপদ থাকুন।
শুভকামনা…
দীপংকর চন্দ
অত্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণ শব্দাবলী পড়তে পড়তে বুক ভরে উঠলো দীর্ঘশ্বাসে। অজান্তে।
অনেক অনেক শুভকামনা জানবেন সুলেখক।
অনেক ভালো থাকবেন। সবসময়।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন আপনিও। দীর্ঘশ্বাসের লেখা লিখতে চাই না। তবুও চোখের সামনে নাড়া দিয়ে যাওয়া ঘটনাগুলো না লিখেও পারি না।
খসড়া
এত সাবলীল ভাবে স্মৃতি কথা কিভাবে লেখেন। চমৎকার আপনার অবজারভেশন।
নীলাঞ্জনা নীলা
প্রতিদিন মিথ্যে বলি, মামনি ব্যথা নেই। ওয়াকার ছাড়া হাঁটতে পারি। টাকা নিয়ে ভেবোনা। আরে আমি $২০০০ পাই মাসে।
বাপি বাচ্চাদের মতো বলে ওঠে, “একটা ওয়াকার পাঠাস তো।” মামনি বলে, “তোর বাপি যে কি! এমন ছেলেমানুষী করে বলে! আচ্ছা মাম রে চোখের নীচে কালি পড়ে কেমন জানি দাগ দাগ হয়েছে। কিছু কি আছে লাগানোর? কেউ আসবে? তাহলে পাঠিয়ে দিস।” বলি আচ্ছা পাঠাবো। যখন চায় কিছু খুব ভালো লাগে। কিন্তু পাঠাতে পারিনা। মানুষ পাইনা।
আপু ভালো থেকো। -{@