জীবনের ব্যাস্ততার মাঝে একটু সময় পেলেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনলাইনে ঘাটাঘাটি করি। প্রায় প্রতিদিন ই জানতে পারি মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা তথ্য এবং লোমহর্ষক ইতিহাস। ছোটবেলা থেকেই এই বিষয়টা নিয়ে আমার ছিলো বিপুল আগ্রহ। ছোটবেলায় যখন বিদ্যুৎ চলে গেলে অসহ্য গরমে ঘুম আসতোনা, ঠিক তখনই আম্মুর পাশে বসে গল্প শুনতাম, মুক্তিযুদ্ধের সত্য গল্প।
আজ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটা বাস্তব গল্প বলবো আপনাদের। আমি এতদিন ধরে জানতাম এই গল্প হয়তো সবার ই জানা। তাই নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি কিছু মানুষ কে কয়েকদিন আগে নক দিয়েছিলাম এবং জিজ্ঞেস করেছলাম তারা জানে কিনা। কয়েকজন বলেছে জানেনা আবার অনেকে নাম শুনেছে কিন্তু বলতে পারেনা সঠিক কাহিনী টা।
“অপারেশন জ্যাকপট”
পাকিস্তানি সেনাদের তখন চলছে একরোখা ধ্বংসযজ্ঞ । তাদের আক্রমণে কোনঠাসা হয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশের সকল মানুষ গুলো। ঠিক সেভাবে প্রতিরোধ করে উঠতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধের কোন ইউনিট। ঠিক সেই সময় দেশের প্রতি ভালবাসা আর বুকে অদম্য সাহস নিয়ে যেগে উঠলো একদল প্রবাদ পুরুষ। তারা ছিলেন নাভাল কমান্ডার। প্ল্যান ছিলো পাকিস্তান থেকে সাবমেরিন ছিনতাই করার কিন্তু সেই প্ল্যান ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তাদেরকে অগত্যা পালিয়ে দিল্লী চলে আসতে হয়। সেই সময় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ১১ টি সেক্টর থেকে ভাল সাঁতার জানেন এমন তিনশ জন যুবক কে বাছাই করা হলো ট্রেনিং এর জন্য। পলাশীর ভাগীরথী নদীর তীরে কয়েকমাস ব্যাপি চললো গোপন ট্রেনিং। তাদের এই গোপন ক্যাম্পের নাম ছিলো C2P.
এই সুইসাইড স্কোয়াডের প্ল্যান ছিলো পাকিস্তানী বাহিনীর রেশন এবং অস্ত্র পরিবহনে বাঁধা দেওয়া। যখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্পেশাল বাহিনী গুলো একে একে সড়ক এবং রেলপথ এ সকল সেতু উড়িয়ে দিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলো , তখন নদী পথ ছাড়া পাকিস্তানীদের যোগাযোগ এর কোন এ উপায় ছিলোনা। আর নদীপথে তাদের রুখতেই প্ল্যান করা হলো “ অপারেশন জ্যাকপট” এর । দেশের প্রধান চারটি সমুদ্র ও নদী বন্দর কে ঘিরে প্ল্যান করেছিলেন তারা। চট্টগ্রাম , মংলা, নারায়ণগঞ্জ এবং চাঁদপুর।
ট্রেনিং এরপর ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে অপারেশন এর জন্য রেডি একদল স্পেশাল কমান্ডো বাহিনী। তারা দুইভাগে ভাগ হয়ে যান। একদল অবস্থান করে পলাশী তে এবং আরেকদল চলে যায় আগরতলায়। পলাশী তে অবস্থান করা দলটি ব্যারাকপুর সুন্দরবন হয়ে মংলায় এসে পৌছান। আগরতলায় অবস্থান করা দলটি তিন ভাগে ভাগ হয়ে নারায়ণগঞ্জ , চাঁদপুর এবং চট্টগ্রাম এসে পৌছায়।
১৯৭১ সালের ১২ ই আগস্ট প্রত্যেকটি দল ই পৌছে গিয়েছিলো তাদের নিজ নিজ অবস্থানে। তারপর শুরু হলো তাদের অপেক্ষার পালা । আক্রমনের কমান্ড না আসা পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে হবে। আর এই কমান্ড কিভাবে আসবে জানেন ? রেডিওর মাধ্যামে । হ্যাঁ রেডিওর মাধ্যমে । প্ল্যান ছিলো কলকাতার আকাশবাণী থেকে পুর্বাঞ্চলের জন্য স্পেশাল প্রোগ্রামে বাজানো হবে একটা গান। যে গানটার অর্থ হলো সবায় কে চূড়ান্ত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকা । আর তার ১৪ ঘন্টা পর বাজবে আরো একটি গান। যার অর্থ তখনি যোগদিতে হবে চূড়ান্ত আক্রমণে। রেডিও বুকে নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনতে শুরু করলেন প্রত্যেক দলের দলনেতারা । কখন বাজবে সেই কাঙ্ক্ষিত গান !!!
প্রথম গানটি বেজেছিলো ১৩ই আগস্ট। গানটি ছিলো সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া “ আমার পুতুল যাবে শ্বশুরবাড়ী”। গানটা বাজার সাথেই সাথেই শুরু হলো চূড়ান্ত প্রস্তুতি। এরপর আবার অপেক্ষা কখন বাজবে সেই কাঙ্ক্ষিত গানটি।
১৪ ই আগস্ট। সমুদ্রের গর্জনে তখন কেউ কেউ নিজের কন্ঠস্বর ই শুনতে পাচ্ছিলেন না । চারদিকে থমথম আবহাওয়া আর ঝিঝিপোকার ডাক। ঠিক সেই মুহুর্তে বেজে উঠলো আকাশবাণী থেকে সেই কাঙ্ক্ষিত গান। গানটি ছিলো পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া “ আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম যত গান” ।
গানটা শোনার সাথেই একযোগে শুরু হলো দেশের চারটি পয়েন্টে অপারেশন।
চট্টগ্রামে অবস্থান নেওয়া দলটি তিনভাগে ভাগ হয়ে ১২ টি জাহাজে মাইন সেট করে দিয়ে আসে। ঠিক একই ভাবে মংলা, নারায়ণগঞ্জ এবং চাঁদপুরের স্পেশাল কমান্ডো দল জাহাজে মাইন সেট করে আসে। এর কিছুক্ষন পর বিকট শব্দে মাইন গুলো বিস্ফোরিত হতে থাকে।
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে “ অপারেশন জ্যাকপট” ছিলো মুক্তিবাহিনীর প্রথম কাউন্টার এট্যাক। পাকিস্তানী বাহিনী সর্বোপ্রথম বুঝতে পেরেছিলো মুক্তিবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে এবং তাদের কাছে এই অপারেশন টা ছিলো একদম অনাকাঙ্ক্ষিত।
সেই অপারেশনে চারটা পয়েন্টে পাকিস্তানীদের প্রায় ২৬ টি জাহাজ উড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন আমাদের নাভাল কমান্ডার রা। এছাড়া দেশের বিভিন্ন যায়গা থেকে এই বাহিনী প্রায় ১২০ টা ছোট জাহাজ , ষ্টীমার এবং নৌকা ডুবিয়ে দ্যায়। এই অপারেশনে শহীদ হয়েছিলেন আমাদের ৮ জন মুক্তিসেনা। আহত হয়েছিলেন অনেকেই।
এই অপারেশন জ্যাকপটের মত আরো অনেক অপারেশনের মাধ্যমেই আমরা পেয়েছিলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি সেই সকল মানুষ যারা নিজের জীবন হাতে নিয়ে এগিয়ে এসেছিলো আমাদের দেশের জন্য , এই মাতৃভূমির জন্য।
তথ্যসুত্রঃ বাংলাপিডিয়া, ইউটিউব
১৩টি মন্তব্য
মৌনতা রিতু
আমার কাছে পুরো বাংলা পিডিয়াটা আছে। আসলে জানার আছে অনেক। এখনো অনেক জানতে হবে আমাদের।
ভালো পোষ্ট।
আসিফ মাহমুদ
ধন্যবাদ আপনাকে। 🙂
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
এ সব আরো বেশী বেশী লিখতে হবে জানাতে হবে মুক্তিযুক্তকে যুদ্ধের করুন নিষ্ঠুর ইতিহাসকে ছড়িয়ে দিতে হবে।সুন্দর লেখা। -{@
আসিফ মাহমুদ
ধন্যবাদ ভাইয়া। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এইটা আমার প্রথম লিখা। চেস্টা করবো সামনে আরো। ধন্যবাদ আপনাকে 🙂 -{@
ইঞ্জা
আমি শুনেছিলাম অপারেশন জ্যাকপট হয়েছিলো চট্টগ্রাম বন্দরে কিন্তু আজ সত্যরূপটা পেলাম, ধন্যবাদ।
আসিফ মাহমুদ
আপনাকেও ধন্যবাদ -{@
ইঞ্জা
শুভেচ্ছা
নীলাঞ্জনা নীলা
“অপারেশন জ্যাকপট” আমিও শুনেছিলাম চট্টগ্রাম বন্দরে। কিন্তু এতোকিছুর কিছুই জানা ছিলোনা।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আসিফ মাহমুদ
ধন্যবাদ আপু -{@
নীহারিকা
বিস্তারিত জানা ছিলো না, আজ আপনার পোস্টের মাধ্যমে জানলাম। সেজন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি ঘটনা রক্তে শিহরণ জাগায়। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন ভাবাই যায় না। আর অপারেশন জ্যাকপটের মত পালটা জবাবে এত্তগুলো জাহাজ একই সময়ে উড়িয়ে দেয়া কতটা সাহস থাকলে করা যায় তা হয়তো সেই যোদ্ধারাই বলতে পারেন।
সালাম ও শ্রদ্ধা সকল মুক্তিযোদ্ধাদের।
আসিফ মাহমুদ
হ্যাঁ। ভাবলেই গা থম থম করে। কতটা ভালবাসা দেশের প্রতি থাকলে এত বড় কাজ করা যায় তা অকল্পনীয়।
ধন্যবাদ আপনাকে 🙂
চাটিগাঁ থেকে বাহার
ভালো লাগে মুক্তিযুদ্ধের বীরদের সফলতার কথা শুনতে ও জানতে। সকল শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
আপনাকে ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য। -{@
আসিফ মাহমুদ
ধন্যবাদ আপনাকে -{@