অন্যরকম ছুটির দিন

রিমি রুম্মান ১৯ জুলাই ২০১৬, মঙ্গলবার, ১২:৩৮:৪৩অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ১৬ মন্তব্য

নিউইয়র্কে আমার এক ভাড়াটিয়া ছিলেন।

দেশে স্ত্রী আর আমার বয়সী দু'টি কন্যা ছিল তাঁর। তিনি ম্যানহাটনে "হোমলেস শেল্টার" এ চাকুরী করতেন। সপ্তাহের পাঁচদিন কাজ, দুইদিন ছুটি। দেখা হলে, গল্প হলে, গল্পের পুরোটা জুড়েই থাকতো উনার পরিবার। বলতে বলতে খানিক আবেগপ্রবণ হয়ে উঠতেন। হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা পরিবারের জন্যে বিশুদ্ধ এক আবেগ।

ছুটির দিনে আমরা যখন শহরের বাইরে দূরে বেড়াতে যাই, কোন না কোন পার্টিতে যাই, কিংবা বন্ধুদের নিয়ে হৈচৈ, আড্ডায় মেতে থাকি, তিনি তখন একাকি ছুটি কাটাতেন অন্যভাবে। একদিনের মেট্রোকার্ড কিনে নিতেন, যা  দিয়ে সারাদিন বাস, ট্রেনে ঘুরে বেড়ানো যায় একই ভাড়ায়। বাসার সামনের বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করতেন। Q58 বাস এলে জানালার পাশের সিটে গিয়ে বসতেন। শহর দেখতেন দিনভর। যাত্রীরা উঠে, আবার গন্তব্যে নেমেও যায়। কিন্তু তিনি বসে থাকতেন শেষ স্টেশন পর্যন্ত। আবার উল্টো দিকে ফিরতেন। আমি বলতাম, বসে থাকতে বোরিং লাগে না আপনার ? উত্তরে তিনি বলতেন, " এসির ঠাণ্ডা হাওয়ায় বসে বসে শহরের মানুষজনের, গাড়িগুলোর নিরন্তর ছুটেচলা দেখতে, ঘোরলাগা প্রকৃতি, শহর দেখতে ভালোই লাগে। এ ছাড়া আমার তো এই শহরে কেউ নেই, আনন্দ করবার জায়গা নেই।"

আরেকজন বড়ভাই ছিলেন। দেশে তাঁর স্ত্রী আর একমাত্র পুত্র। ছুটির দিনে একাকি এখানে, ওখানে ঘুরতেন। সামান্য অসুস্থ ছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হলে পার্কে কিংবা রাস্তার পাশে বেঞ্চিতে বসে বিশ্রাম নিতেন। একদিন বিশ্রাম নেবার সময়টাতে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েন। পার্কের বেঞ্চিতে এমন করে ঘুমিয়ে থাকবার অপরাধে পুলিশ তাঁকে জরিমানা করে। তীব্র মনখারাপ নিয়ে সেদিন তিনি বাড়ি ফিরেন।

জীবনের প্রয়োজনে স্ত্রী-সন্তান-পরিবার থেকে দূরে বিদেশ বিভূঁইয়ে এমন অজস্র মানুষ থাকেন, যাঁদের ছুটির দিন মানে অপার আনন্দের কোন দিন নয়। খাঁখাঁ রৌদ্রের ভর দুপুরের মতই শুন্যতা বুকে নিয়ে কাটিয়ে দেন ছুটির দিন। কাটিয়ে দেন জীবনের অনেকটা সময়। অতঃপর একদিন শেকড়ে ফিরেন, নয়তো ফিরে তাঁর দেহ।

যেসব সন্তানরা তাঁদের বাবাকে জীবিত থাকার পরও বাবার উষ্ণ সান্নিধ্য পেলো না, ছুটির দিনগুলোয় বায়না ধরে এখানে ওখানে বেড়াতে যেতে পারলো না, তাঁদের মতন দুর্ভাগা আর কে হতে পারে ? কিংবা যেসব বাবা'রা এক আকাশের নিচে থেকেও সন্তানকে দেখতে পায়না, জড়িয়ে ধরতে পারে না, কাছে থেকে আবদারগুলো মেটাতে পারেন না, তাঁদের মতন হতভাগা পিতা আর কে হতে পারে ?

ছোট্ট এই জীবনে যারা পরিবার নিয়ে একসাথে জীবনের সুন্দর সময় অতিক্রম করছে, তাঁরা ভাগ্যবান। সত্যিই ভাগ্যবান।

রিমি রুম্মান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ