অনন্য সুভাষ (৩)

সাতকাহন ৭ ডিসেম্বর ২০১৪, রবিবার, ১০:২৫:১১অপরাহ্ন সাহিত্য ২০ মন্তব্য

১৯২১ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত সুভাষ বসু তাঁর রাজনৈতিক গুরু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের পাশে থেকে তাঁর সমস্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সুভাষ ছিলেন দেশবন্ধুর যোগ্য উত্তসূরী।

সুভাষ ১৯২১ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই পুরো ভারতবর্ষে বিভিন্ন যুব সংগঠনের সভা-সমিতিতে যোগ দিয়ে তাদের ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিয়ে বক্তব্য রাখেন এবং পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন। ১৯২২ সালের মে মাসে তরুণদের স্বাধীনতা সংগ্রামে উৎসাহ দিয়ে একটি প্রবন্ধ লিফলেট আকারে প্রকাশ করেন। এই প্রবন্ধে তিনি লেখেন:

‘আমরা এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়াছি একটা উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে, একটা বাণীর জন্য। আলোক জগৎ উদ্ভাসিত করিবার জন্য যদি গগনে সূর্য উদিত হয়, গন্ধ বিতরণের উদ্দেশে, বনমধ্যে কুসুমরাজি যদি বিকশিত হয়, অমৃতময় বারিদান করিতে, তটিনী যদি সাগরভিমুখে প্রবাহিত হয়, যৌবনের পূর্ণ আনন্দ ও ভরা প্রাণ লইয়া আমরাও মর্ত্যলোকে নামিয়াছি একটা সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য, স্বাধীনতা।

এই দুঃখসঙ্কুল, বেদনাপূর্ণ নরলোকে আমরা আনন্দ-সাগরের বান ডাকিয়া আনিবো। আশা, উৎসাহ, ত্যাগ ও বীর্য লইয়া আমরা আসিয়াছি। আমরা আসিয়াছি সৃষ্টি করিতে কারণ, সৃষ্টির মধ্যেই আনন্দ। তনু, মন-প্রাণ, বুুদ্ধি ঢালিয়া দিয়া আমরা সৃষ্টি করিবো। নিজের মধ্যে যাহা কিছু সত্য, যাহা কিছু শিব আছে-তাহা আমরা সৃষ্ট পদার্থের মধ্যে ফুটাইয়া তুলিবো। আত্মদানের মধ্যে যে আনন্দে আমরা বিভোর হইবো, সেই আনন্দের আস্বাদ পাইয়া পৃথিবীও ধন্য হইবে।

আমরাই দেশে দেশে মুক্তির ইতিহাস রচনা করিয়া থাকি। আমরা শান্তির জল ছিটাইতে এখানে আসি নাই। বিবাদ সৃষ্টি করিতে, সংগ্রামের সংবাদ দিতে, প্রলয়ের সূচনা করিতে আমরা আসিয়া থাকি। যেখানেই বন্ধন সেখানেই গোঁড়ামি, যেখানেই কুসংস্কার সেখানেই সঙ্কীর্ণতা-সেখানেই আমরা কুঠার হস্তে উপস্থিত হইবো।

আজ পৃথিবীর সকল দেশে বিশেষত, যেখানে বার্ধক্যের শীতল ছায়া দেখা দিয়াছে, তরুণ সম্প্রদায় মাথা তুলিয়া প্রকৃতস্থ হইয়া সেখানে দণ্ডায়মান হইয়াছে। কোন দিব্য আলোকে পৃথিবীকে তাহারা উদ্ভাসিত করিবে তাহা কে বলিতে পারে...! ওগো আমার তরুণ জীবনের দল তোমরা ওঠো, জাগো, ঊষার কিরণ যে দেখা দিয়াছে।’[৩]

১৯২২ সালের ডিসেম্বর মাসে আর্যসমাজ হলে নিখিল বঙ্গ যুব সম্মিলনীর অধিবেশনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির ভাষণে সুভাষ ভরাট কণ্ঠে বলেন:

‘যেখানে জীবনের লীলাখেলার আনন্দের লুট হতো, যেখানে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের উৎসগুলির প্রাচুর্য্যে আমাদের ভাণ্ডার উপচে পড়তো, যেখানে জলে সুধা, ফলে অমৃত, শস্যে দেশের অনন্ত প্রাণদায়িনী শক্তি ছিলো, সেখানে আজ বিরাট শ্মশান খাঁ খাঁ করছে। প্রেতের ছায়া দেখে অর্ধমৃত প্রাণ শিউড়ে উঠেছে। এক বিন্দু জল নেই, এতোটুকু জীবন নেই। তোমরা জাগো ভাই, মায়ের পূঁজো শঙ্খ বেজেছে, আর তোমরা তুচ্ছ দীনতা নিয়ে ঘরের কোণে বসে থেকো না। এমন সুন্দর দেশ, এমন আলো, এমন বাতাস, এমন গান, এমন প্রাণ, আজ মা সত্যিই বুঝি ডেকেছেন। ভাই, একবার ধ্যাননেত্রে চেয়ে দেখো, চারদিকে ধ্বংসের স্তুপীভূত ভষ্মরাশির ওপর এক জ্যোতির্ময়ী মূর্তি। কী বিরাট! কী মহিমায়! শ্যামায়মান বনশ্রীতে নিবিড় কুন্তলা, নীলাম্বর-পরিধানা, বরাভয়বিধায়িনী, সর্বাঙ্গীন, সদা হাস্যময়ী, সেই তো আমার জননী।

সেখানে রাজনৈতিক মতদ্বৈধের কোনো স্থান নেই। সমাজ পদ্ধতির কোনো বিশিষ্ট আচার-অনুষ্ঠানকে গোঁড়ামির দ্বারা বড় করে দেখা হবে না। বিভিন্ন ধর্মের পার্থক্য কোনো বাঁধা সৃষ্টি করবে না। সেখানে সমস্ত দেশবাসী জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে একই আদর্শে বিশ্বাসী, একই লক্ষ্যে, একই পথে আপন মনুষ্যত্বকে পাথেয় হিসাবে গ্রহণ করে আমরণ চলতে থাকবে।

অন্তর থেকে কর্মশক্তি আমাদের উদ্বুব্ধ করবে, যে নৈতিক বল আমাদের সত্য ও ন্যায়ের পথে চালিত করবে সেই শক্তি, সেই বলকে আহুতির অগ্নির মতো চিরন্তনের জন্য উদ্দীপ্ত রাখতে হবে। আশা চাই, উৎসাহ চাই, সহানুভূতি চাই, প্রেম চাই, অনুকম্পা চাই, সবার উপরে মানুষ হওয়া চাই। মানুষের মধ্যে দেবতার প্রতিষ্ঠাই আমাদের সাধনা। জীবনব্যাপী এই সাধনার মধেই আমাদের মুক্তি নিহিত।’[৪]

১৯২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’তে সুভাষের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় এই প্রবন্ধে সুভাষ লেখেন:

‘দেড়শত বৎসর পূর্বে বাঙালি বিদেশিকে ভারতের বক্ষে প্রবেশের পথ দেখিয়েছিলো। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত বিংশ শতাব্দীর বাঙালিকে করতে হবে। বাঙলার নর-নারীকে ভারতের লুপ্ত গৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে। কি উপায়ে এই কার্য সু-সম্পন্ন হতে পারে এটাই বাঙলার সর্বপ্রধান সমস্যা। বাঙালি জাতীয় জীবনের অন্য সব ক্ষেত্রে অগ্রণী না হলেও আমার স্থির বিশ্বাস যে, স্বরাজ সংগ্রামে বাঙলার স্থান সর্বাগ্রে। আমার মনের মধ্যেও কোনো সন্দেহ নেই যে, ভারতবর্ষে স্বরাজ প্রতিষ্ঠিত হবেই এবং স্বরাজ প্রতিষ্ঠার গুরুভার প্রধানত বাঙালিকেই বহন করিতে হইবে। অনেকে দুঃখ করে থাকেন, বাঙালি মাড়োয়ারি বা ভাটিয়া হলো না কেনো? আমি কিন্তু প্রার্থনা করি বাঙালি যেনো চিরকাল বাঙালিই থাকে। বাঙালিকে এই কথা সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, শুধু ভারতবর্ষ কেনো সারা পৃথিবীতে তার একটি স্থান আছে-এবং সেই স্থানের উপযোগী কর্তব্যও তার সামনে পড়ে রয়েছে। বাঙালিকে স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে, আর স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভারত গড়ে তুলতে হবে। সাহিত্য, বিজ্ঞান, সঙ্গীত, শিল্পকলা, শৌর্য-বীর্য, ক্রীড়া-নৈপুণ্য, দয়া-দাক্ষিণ্য-এই সবের ভিতর দিয়ে বাঙালিকে নতুন ভারত সৃষ্টি করতে হবে। জাতীয় জীবনের সর্বাঙ্গীন উন্নতি বিধান করবার শক্তি এবং জাতীয় শিক্ষার সমস্বয় করবার প্রবৃত্তি একমাত্র বাঙালিরই আছে।

গত দুই তিন বৎসর ধরে বাংলাদেশে যে জাগরণের বন্যা এসেছিলো সে বন্যা এখন ভাঁটার দিকে চলেছে বটে, কিন্তু জোয়ারের আর বেশি বিলম্ব নাই। বাংলাদেশে জাতীয়তার স্রোতে আবার প্রবল বন্যা আসবে। সে বন্যার স্পর্শে বাঙলার প্রাণ আবার জেগে উঠবে। বাঙালি সর্বস্ব পণ করে আবার স্বাধীনতার জন্য পাগল হয়ে উঠবে, দেশ আবার স্বাধীনতা লাভের জন্য বদ্ধপরিকর হবে।

ভাই, তোমরা সকলে কি আত্মবলির জন্য প্রস্তুত আছো? এসো, হে আমার তরুণ জীবনের দল, তোমরাই তো দেশে দেশে মুক্তির ইতিহাস রচনা করেছো। আজ এই বিশ্বব্যাপী জাগরণের দিনে স্বাধীনতার বাণী যখন চারিদিকে ধ্বনিত হচ্ছে তখন কি তোমরা ঘুমিয়েই থাকবে?

ওগো বাঙলার যুব সম্প্রদায়, স্বদেশ সেবার পূণ্যযজ্ঞে আজ আমি তোমাদের আহ্বান করছি। তোমরা যে যেখানে যে অবস্থায় আছো, ছুটে এসো। চারিদিকে বাঙলা মায়ের মঙ্গল শঙ্খ বেজে উঠেছে।’[৫]

১৯২৪ সালে কোলকাতা পৌর কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মেয়র নির্বাচিত হন। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরেই তিনি প্রধান নির্বাহী কর্মকতা নিয়োগ দিবেন। এই পদে থেকে বাঙলার বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা সহজ হবে ভেবেই দেশবন্ধু প্রধান নির্বাহী পদে সুভাষ বসুকে নিয়োগ প্রধান করেন।

কর্পোরেশনের দায়িত্ব নেয়ার কয়েক মাস যেতে না যেতেই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৮১৮ সালের ৩নং ধারার বলে ১৯২৪ সালের অক্টোবর মাসে সুভাষকে বন্দি করা হয়। পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তরের নথিপত্র থেকে জানা যায়:

‘১৯২৪ সালে স্বরাজ্য দলের বিপ্লবী সদস্যগণ কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী পদের জন্য সুভাষ বসুকে সমর্থন করেছিলেন এবং এটা লক্ষ্যণীয় যে, তাঁর ওই পদের নিয়োগের পর কর্পোরেশনে অগণিত বিপ্লবীদের চাকুরি দেয়া হয়েছিলো। এই সময় সুভাষ বসু ও বিপ্লবীদের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিলো যে, সুভাষ তাঁর নির্দেশ মতো বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস পরিচালনা করবেন।’[৬]

বিপ্লবীদের সঙ্গে সুভাষের এই ঘনিষ্ঠতার কিভাবে সেদিন পুলিশের পক্ষে জানা সম্ভব হয়েছিলো তাও পুলিশের গোপন নথিতে উল্লেখ করা আছে:

‘১৯২৪ সালের প্রথম দিকে কংগ্রেসের একজন বিখ্যাত নেতা জনৈক উচ্চপদস্থ এক সরকারি কর্মকর্তার কাছে স্বীকার করেছিলেন যে, বাংলাদেশে একটি বৈপ্লবিক আন্দোলনের অস্তিত্ব আছে, যারা স্বরাজ্য দলের মুখোশ পড়ে রয়েছেন। ওই সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের পুরো নিয়ন্ত্রণ করছেন সুভাষ বসু।’[৭]

এর পূর্বেই ১৯২৩ সালে বিখ্যাত বিপ্লবী হরিকুমার চক্রবর্তী, সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ ও ভূপেন্দ্র কুমার দত্তসহ কয়েকজন বিপ্লবীকে একই কারণে গ্রেফতার করা হয়। এই সময় আটককৃত অন্যান্য বিপ্লবীদের সাথে সুভাষ বসুকে বার্মার (বর্তমান মায়ানমার) মান্দালয় জেলে প্রেরণ করা হয়।

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ সুভাষ বসু ও অন্যান্য বিপ্লবী নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ও মুক্তির দাবিতে তাঁর বাড়িতে নিখিল ভারত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির একটি সভা আহ্বান করেন। এই সভায় দেশবন্ধু তীব্র কণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন:

‘If love of country is crime, i am a criminal. If Mr. Subhas Chndra Bose is criminal, i am a criminal, not only the chief executive officer of the corporation, but the mayor of this corporation is equally guilty.’[৮]

তথ্যপঞ্জি:

৩.    যুবকদের প্রতি সুভাষ বসুর লিফলেট, মে ১৯২২
৪.    আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ ডিসেম্বর ১৯২২
৫.    আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ ডিসেম্বর ১৯২৪
৬.    ব্রিটিশ পুলিশের গোপন নথি, কোলকাতা ১৯২৪
৭.    ব্রিটিশ পুলিশের গোপন নথি, কোলকাতা ১৯২৪
৮.    নেতাজী সঙ্গ-প্রসঙ্গ, নরেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী, আনন্দ পাবলিশার্স, কোলকাতা ১৯৭৩

(.................................................................................চলবে)

আগের পর্বগুলোর লিংক:

অনন্য সুভাষ (১) http://www.sonelablog.com/archives/24619

অনন্য সুভাষ (২) http://www.sonelablog.com/archives/24727

 

0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ