মৈমনসিংহ গীতিকা : চন্দ্রাবতী (প্রথম পর্ব)

(৪) বংশীর শিবপূজা, কন্যার জন্য বরকামনা

পুষ্পপাত বান্ধি কন্যা আপন অঞ্চলে।
দেবের মন্দির কন্যা ধোয় গঙ্গার জলে।।
সম্মুখে রাখিল কন্যা পূজার আসন।
ঘসিয়া লইল কন্যা সুগন্ধি চন্দন।।
পুষ্পপাতে রাখে কন্যা শিবপূজার ফুল।
আসিয়া বসিল ঠাকুর আসন উপর।।

পূজা করে বংশীবদন শঙ্করে ভাবিয়া। *
চিন্তা করে মনে মনে নিজ কন্যার বিয়া।।
“এত বড় হইল কন্যা না আসিল বর।
কন্যার মঙ্গল কর অনাদি শঙ্কর।।
বনফুলে মনফুলে পূজিব তোমায়।
বর দিয়া পশুপতি ঘুচাও কন্যাদায়।।
সম্মুখে সুন্দরী কন্যা আমি যে কাঙ্গাল।
সহায়-সঙ্গতি নাই দরিদ্রের হাল।।”

এক পুষ্প দিল বাপে শিবের চরণে।
ঘটক আইবে শীঘ্র বিয়ার কারণে।।
আর পুষ্প দিল বাপ বড়ঘরের বর।
“আমার কন্যার স্বামী হউক দেব পুরন্দর।।”
আর ফুল দিল বাল কুলশীল পাইতে।
বংশ বড় ভট্টাচার্য্য খ্যাতি রাখিতে।।
বর মাগে বংশীদার ভূমিতে পড়িয়া।
“ভাল ঘরে ভাল বরে কন্যার হউক বিয়া।।”

* বংশীবদন : সম্ভবত বংশীদাসের সম্পূর্ণ নাম ছিল বংশীবদন।

(৫) চন্দ্রার নির্জ্জনে পত্রপাঠ

পূজার যোগার দিয়া কন্যা নিরালায় বসিল।
জয়ানন্দের পুষ্পপাত যতনে খুলিল।।
পত্র পইড়ে চন্দ্রাবতীর চক্ষে বয়ে পানি।
কিবা উত্তর দিব কন্যা কিছুই না জানি।।
আর বর পড়ে পত্র চক্ষে বয় ধারা।
“এমন কেন হইল মন শুকের পিঞ্জরা।।
দেখি শুনি সেই ডাল ফুল তুল্যা আনি।
বয়স হইছে এখন হইলাম অরক্ষীনি।।
জৈবন আইল দেহে জোয়ারের পানি।
কেমনে লিখিব পত্র প্রাণের কাহিনী।।
কিমতে লিখিব পত্র বাপ আছে ঘরে।
ফুল তুলে জয়ানন্দ ভালবাসি তারে।।
ছোট হইতে দেখি তারে প্রাণের দোসর।”
সেই ভাবে লেখে কন্যা পত্রের উত্তর।।
“ঘরে মোর আছে বাপ আমি কিবা জানি।
আমি কেমনে দেই উত্তর অবলা কামিনী।।”

যত না মনের কথা রাখিল গোপনে।
পত্রখানি লেখে কন্যা অতি সাবধানে।।
চন্দ্রসূর্য্য সাক্ষী করি মনের দিকে চাইয়া।
জয়ানন্দ মাগে বর ধর্ম্ম সাক্ষী দিয়া।। *
শিবের চরণে কন্যা উদ্দেশে করে নতি।
পত্র পাঠাইয়া দিল কন্যা চন্দ্রাবতী।।
পুষ্প তুলিতে কন্যা আর নাহি যায়।
এই মতে সুখে দুঃখে দিন বইয়া যায়।।

* জয়ানন্দ মাগে বর : জয়ানন্দকে বরস্বরুপ পেতে প্রার্থনা করল।

(৬) নীরবে হৃদয় দান

বাড়ীর আগে ফুট্যা রইছে চম্পা-নাগেশ্বর।
পুষ্প তুলিতে কন্যা আইল একেশ্বর।।
“তোমারে দেখিব আমি নয়ন ভরিয়া।
তোমারে লইব আমি হৃদয়ে তুলিয়া।।
বাড়ীর আগে ফুট্যা আছে মালতী-বকুল।
আঞ্চল ভরিয়া তুলব তোমার মালার ফুল।।
বাড়ীর আগে ফুট্যা রইছে রক্তজবা-সারি।
তোমারে করিব পূজা প্রাণে আশা করি।।
বাড়ীর আগে ফুট্যা রইছে মল্লিকা-মালতী।
জন্মে জন্মে পাই যেন তোমার মতন পতি।।
বাড়ীর আগে ফুট্যা রইছে কেতকী-দুস্তর।
কি জানি লেখ্যাছে বিধি কপালে আমার।।”
এইরূপে কান্দে কন্যা নিরালা বসিয়া।
মন দিয়া শুন কথা চন্দ্রাবতীর বিয়া।।

(৭) বিবাহের প্রস্তাব ও সম্মতি

একদিন ত না ঘটক আইল ভট্টাচার্য্যের বাড়ী।
“তোমার ফহরে আছে কন্যা পরমা সুন্দরী।।
কুলে শীলে তুমি ঠাকুর চন্দ্রের সমান।
না দেখি এমন বংশ এথায় বিদ্যমান।।
বয়স হইল কন্যা রূপে বিদ্যাধরী।
ভাল বরে দেও বিয়া ঘটকালি করি।।”
“কেবা বর কিবা ঘর কহ বিবরণ।
পছন্দ হইলে দিব মনের মতন।।”
ঘটক কহিল “সুন্ধ্যা” গ্রামে ঘর। *
চক্রবর্ত্তী বংশে খ্যাতি কুলিনের ঘর।।
জয়ানন্দ নাম তাঁর কাত্তিক কুমার।
সুন্দর তোমার কন্যা যোগ্য বর তার।।
দেখিতে সুন্দর কুমার পড়ুয়া পণ্ডিত।
নানা শাস্ত্র জানে বর অতি সুপণ্ডিত।।
সূর্য্যের সমান রূপ বংশের দুলাল।
সুখেতে থাকিব কন্যা জানি চিরকাল।।
পশ্চিমাল বাতাসে দেখ শীতে লাগে কাটা।
এখন ধইরাছে দেখ মধ্যি গাঙ্গে ভাটা।।
আম আগছে নয়া পাতা ধরিয়াছে বউল।
এই মাসে বিয়া দিতে নাহি গণ্ডগোল।।

করকুষ্টি বিচারিয়া সম্বন্ধ মিলায়।
ভালা বরে কন্যা বিয়া দেওয়া বড় দায়।।
কুষ্টি বিচারি কৈল “সর্ব্ব সুলক্ষণ।
বরকন্যার এমন মিল ঘটে কদাচন।। **
কুষ্টিতে মিলিছে ভাল যখন এই বরে।
এই বরে কন্যাদান করিব সুস্থরে।।” ***

* সুন্ধ্যা : সুন্ধা নদীর তীরের গ্রাম
** কদাচন : কদাচিৎ
*** সুস্থরে : নিশ্চয়

(চলবে)

0 Shares

১১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ