সেই সময় প্রতিটি মুহূর্ত মনে হতো দীর্ঘ, কারণ দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে বা যাবে একেবারেই অস্পষ্ট ছিল । একদিন (তারিখ মনে নেই ) হয়তো ২ -৩ মার্চ হবে, আমি এবং আমার বিশাল রাজনৈতিক সচেতন বন্ধু মহলকে নিয়ে আমার এক বন্ধুর বাসায় মিলিত হলাম কেমন করে না বলে ঢাকায় যাওয়া যায় ৭ ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেখবার ও শুনবার জন্য কারণ পরিবার অনুমতি দেবে না । কিন্তু আমাদের সকলের একই কথা ছিল যা হবার হবে আমরা যাবো এবং যাবই । বন্ধুর বাসায় থাকবো বলে চলে এলাম সবাই একই কথা বলে ঢাকায় । ভাষণ শুনলাম । জনতার ঢল মনে হল বিশাল সমুদ্র যার কোন কুল দেখা যায় না শুধু উপলব্ধি করা যায় এবং পুরো জাতী অপেক্ষা করছিলো চূড়ান্ত এবং নির্ভর যোগ্য সমাধানের বাণী শুনবার জন্য । কিন্তু আমার মনে হয়েছিলো সেই সময় শেষ একটি সিদ্ধান্ত বা চূড়ান্ত এবং নির্ভর যোগ্য উচ্চারণ সম্ভব ছিল না এবং ঐতিহাসিক ভাষণ শেষ করলেন শেখ সাহেব এবং সঠিক ভাবেই শেষ করলেন কিন্তু অযথা এই নিয়ে এখনও আমরা বিতর্কে লিপ্ত যা জাতির জন্য কোনমতেই কাম্য নয় । যাই হোক, ফিরে আসলাম চট্টগ্রামে । এরপর শুরু হল সংলাপ আর সংলাপ এবং সংলাপের প্রয়োজন ও ছিল কারণ সুস্থ সমাধান সব সময়ই আগামী পথ চলার জন্য সঠিক এবং মর্যাদা পূর্ণ । হরতাল আর অসহযোগ জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত এবং সম্মানের পালন করতে লাগলো । অনবরত প্রতিবাদ সভা, মিছিল, রোষ ও ক্ষোভের প্রকাশ করতে লাগলো বাঙ্গালি জাতী, সেখানে আমি ও আমার বিশাল বন্ধু মহল সবসময় উপস্থিত থাকতাম । একদিনের কথা মনে আছে আমাদের বাসায় একজন জার্মানির লেখক ভদ্র লোকের নাম হরসট আড়ডমান । উনি আমার বাবাকে বললেন তোমাদের দেশে সর্বত্র ক্ষোভের প্রকাশ দেখছি , আরও বললেন মনে হচ্ছে সম্মুখেই কোন বিপ্লবের সম্ভাবনা আছে । আমার বাবা তাঁকে বললেন ঠিক আমি ও বুঝতে পারছি না কি হবে শেষ পর্যন্ত । জার্মান লেখক বললেন ব্রিটিশরা যে ভাবে আলোচনার মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তে এসেছিলো , পশ্চিম পাকিস্তানীদের সে রকম আলোচনা হতে পারে কি ? কবি সৈয়দ আলি আহসান বললেন এটা হবার নয়, দেশ বিভাগের পর থেকেই আমরা দেখে আসছি পাকিস্তানের উভয় অংশের সঙ্গে সংলাপ রচিত হয়নি । তারা যে ভাবে কথা বলে আমরা সে ভাবে বলি না । তাদের মানসিকতা এবং আমাদের বিস্ময়কর ভাবে ভিন্ন । আমরা স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী কিন্তু তারা একধরণের একাত্মে বিশ্বাসী । আমি এই কথাগুলো শুনে আমার সাহস আরও বেড়ে গেল কিন্তু সাথে অস্থিরতাও বেড়ে গেল । কি হবে বা কি হতে পারে ? !!!!
১০ই মার্চ ১৯৭১, ১০ই বা ১১ই মার্চ, সঠিক তারিখটি মনে নেই কিন্তু এই দুইদিনের যে কোন একদিন আমি এবং বন্ধুমহল একটি সভার আয়োজন করেছিলাম জামালখান রোডে আমার বন্ধুর বাসায়। বাড়িটি একটু ভিতরে এবং মাঝারি আকারের একটি উঠান ছিল এবং ওর পরিবারের কোন আপত্তি ছিল না। তাই আমাদের কোন অসুবিধা হয় নি । সময় রাত ১১ টায় । আমরা সবাই ছিলাম কিন্তু গর্বে আমার বুক ভরে গিয়েছিলো সেই সভায় প্রায় ৩০০র উপর মানুষ যোগদান করেছিলেন বাহিরের , তারা কোন কোন ভাবে জানতে পেরে গিয়েছিলো সম্মিলিত হতে হবে তাই তারা আমাদের সমর্থন আছে জানাতে এসে ছিলেন । এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল আমি কিন্তু কোন রাজনৈতিক দলের লিখিত ও অলিখিত সদস্য ছিলাম না । আমি রাজনৈতিক সচেতন নাগরিক ছিলাম । দিনের বেলায় সভার আয়োজন না করবার কারণই ছিল হরতাল আর অসহযোগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মুখোশ আমার এবং আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো । তারা আমাদের বিজয়ে শঙ্কিত তাই অনবরত টাল বাহানা করছিল শুধু সময় নিচ্ছিল কি ভাবে আমাদের বিজয়কে প্রতিহত করা যায় । ঢাকার উত্তপ্ত বাতাস অসম্ভব ভাবে প্রভাব ফেলেছিল চট্টগ্রাম সহ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে । আমাদের সভায় কোন সভাপতি বা প্রধান অতিথি কেউ ছিল না কারণ আমরা আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত নেবার জন্যই এই সভার আয়োজন করেছিলাম এবং আলোচনা শেষে আমরা একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলাম আমাদের বিজয়ের, বিজয়ের স্বাদ আমরা গ্রহণ করবো, করবই যে কোন মূল্যে ।
ইতিহাস এবং আমার বাবার আলোচনা আমাকে সচেতন করেছিলো পাকিস্তানের মনোভাব ১৯৪৭এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পর পশ্চিম পাকিস্তানের মুখোশ ধীরে ধীরে কি ভাবে উন্মোচিত হতে লাগলো । এখানে আমি পিছনে যাবো না শুধু এই টুকু বুঝতে পেরেছিলাম পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের সকল অঞ্চলের সম্প্রীতি এবং বিশ্বাস অর্থাৎ ঐক্য তারা রক্ষা করতে দেয়নি । তাই সেই সভায় আমরা আরও একটি সিদ্ধান্তে ঐক্যবদ্ধ হলাম পশ্চিম পাকিস্তানের ঔদ্ধত্য এবং অহমিকা যেমন করেই হোক প্রতিহত করতে হবে প্রতিবাদের চরম পর্যায়ও যদি আমাদের যেতে হয় এবং বঙ্গবন্ধু যা বলবেন করতে আমরা তাই করবো । আমরা অপেক্ষায় রইলাম সেই দিন থেকে তাঁর চূড়ান্ত উচ্চারণের অপেক্ষায় ৭ই মার্চের পর থেকেই ।
৬টি মন্তব্য
নীহারিকা
আপনি অনেক ভাগ্যবান যে জাতীর পিতাকে স্বচক্ষে দেখেছেন, তার ঐতিহাসিক ভাষণ শুনেছেন।
আপনার মাধ্যমে আরো জানতে চাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে।
ইঞ্জা
রক্তটা ছলাত করে উঠলো, ইচ্ছে করছে সব কথা আজই শুনে ফেলি, তাড়াতাড়ি লিখুন ভাই, অপেক্ষায় রইলাম।
জিসান শা ইকরাম
খুব ছোট হলেও দেখেছি মানুষের আবেগকে ঐ সময়ে।
মানুষ কিভাবে একজন নেতার আহ্বানে সবকিছু মান্য করে চলেছেন।
ঘরে ঘরে দুর্গ গরে তোলো – এই নির্দেশের পরে আর কিছুকি বাকি থাকে?
লেখুন নিয়মিত, আপনার চোখে ঐ সময়কে দেখি আমরা।
ছাইরাছ হেলাল
সে সময়টি সত্যি অন্যরকম ছিল, একাত্তরের জানুয়ারীতে ঢাকার মিছিলের কথা এখনও
চোখে ভাসছে,
লিখুন নিয়মিত,
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা আপনার কাছে এমন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সরাসরি একজন মুক্তিযুদ্ধাই লিখছেন ভাবতেই কেমন যেন স্বপ্ন মনে হয়।আপনার মতো আর সব জীবিত মুক্তি যুদ্ধারা যদি তাদের নিজস্ব যুদ্ধের ঘটনাগুলো এভাবে কোথাও লিখত তবে মুক্তি যুদ্ধের তথ্য ভান্ডার আরো সমৃদ্ধি হতো।চলুক -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার। আপনি উনাকে দেখেছেন, কত্তো ভাগ্যবান আপনি!
লিখুন, একাত্তরকে দেখে নেই আপনার লিখনীতে।