
রাত বারোটায় ফোন এসেছে “সুজানার স্বামী আত্মহত্যা করেছেন” সুজানও তখনও উপন্যাসের পাতা উল্টাচ্ছিলেন। এমনকী যখন তার মা তটস্থ হয়ে দৌড়ে এসে বললেন, “শুনেছিস সুজানা তোর স্বামী আত্মহত্যা করেছেন” সুজানার মা তখন কাঁপছিলেন গলাকাটা কবুতরের মতো, তার কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিলো ভয়ের মতো আতঙ্ক জল।
প্রচণ্ড রোদে পুড়ে যাওয়া কালো মুখের চেয়ে বিষন্ন কালো হয়েছে সুজানার মায়ের মুখ। কিন্তু সুজানা কথাটা শুনেও যেন শুনেননি, তাই সে তখনও উপন্যাসের পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছেন। একপর্যায়ে তার মা গায়ে ধাক্কা দিয়ে বললেন কীরে! তুই কী শুনেছিস আমি কী বলেছি? সুজানা বন্দি পাখির মতো গাঢ় ঘুরিয়ে তাকায়।
তার চোখেও যে জল টলমল করছে। মুখটা কেমন গোমড়া হয়ে আছে গোলা জলের মতো হয়েছে তার রঙ। সুজানা তার মা’কে প্রশ্ন করে “আমার কী যেতে হবে? ” মেয়ের এমন প্রশ্ন শুনে মা নির্বাক হয়ে যান, মনে মনে ভাবেন এটা হতেও পারে নির্বাক পরিস্থিতি অথবা অধিক শোকে মানুষ কখনও কখনও স্তব্ধ হয়ে যায়। আর সেই স্তব্ধতার নানান রূপ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রকাশ পায়। সুজানার মা তখন বললেন , তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে তোর বাবা গাড়ি ঠিক করতে গেছেন।
প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে থানা শহরে সোহাগের বাড়ি। এখন পৌষ মাস কনকনে শীত। ঘরে ভেতরেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। কিন্তু এই শীতের রাতেই তাদেরকে যেতে হবে। সুজানার মনে পড়ে এমনই এক শীতের রাতে সুজানা সোহাগের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিলেন বিয়ের আসর থেকে। কিছু কিছু বর্ণমালা এতোটাই অনিবার্য হয়ে উঠে কিন্তু একান্ত গভীর অনুভূতি ছাড়া সে বর্ণমালাগুলো অনাবিষ্কৃত থেকেই যায়। তার প্রকাশ শুধু অনুভূতিতেই হয় অনুভূতিই প্রবল ঢেউয়ের চেয়ে বড়ো কোন ঢেউ সমুদ্রেও নেই। তাই সুজান সে কথা সে কোনদিন ভুলতে পারে না।
জোছনার আলোয় মোমের মতো গড়িয়ে পড়ছিলো সাদা সাদা কুয়াশার লাভা। বরফের মতো ভারী কুয়াশার ফোটা মাথায় পড়ছিলো বৃষ্টির মতো। যেন পৃথিবীটা হাতের তালুতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো তারা। জলীয় বাতাসের তীব্র হুঙ্কারে ওঠে আসছিলো
সদ্য হাতে লাগা মেহেদী রঙ ছিলে যাওয়া চামড়ার মতো। সুজানা সেদিন কাঁপতে কাঁপতে গলে যাচ্ছিলো আইসক্রিমের মতো। সোহাগ দাঁড়িয়ে ছিলো একটি বৈদ্যুতিক খুঁটির মতো শক্ত হয়ে। সোহাগ তাকে এমনভাবে বুকে জড়িয়ে রেখেছিলো যেভাবে জড়িয়ে রাখে মুরগী তার বাচ্চাকে।
সুজানার বাবা আহমেদ সাফি একজন স্কুল শিক্ষক। মেয়ের পলায়নে বরপক্ষের কাছে অপমানিত হয়ে স্ট্রোক করেছিলেন। সুজানাও সেদিন আত্মহত্যা করতে পারতেন যদি না সোহাগ এসে সেদিন তাকে নিয়ে যেতো। তাই তার চলে যাওয়াটা সেদিন ছিলো তার পিতামাতার কাছে তার আত্মহত্যারই শামিল। কারণ সেদিন সুজানা মনে মনে স্থির করেছিলেন এ-ই মুখ নিয়ে সে কোনদিন আর বাবা-মায়ের সামনে আসবেন না। বিসর্জনের বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সেদিন তারা শীতের তীব্রতাকে সাথী করে সোহাগের বাড়িতে উঠেছিলেন।
তারপর বাবা সেড়ে ওঠার কিছুদিন পর একমাত্র আদুরে মেয়েকে নিতে জামাই বাড়িতে আসেন। মেয়ে ও বাবাকে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কিন্তু সুজানা তার বাবাকে বুঝিয়ে বলেন, “আমি ভালো আছি বাবা, তুমি বাড়ি যাও আমি পড়ে আসব। এর পরের বছর শীতে সুজানার ঘরে আসে এক ফুটফুটে কণ্যা সন্তান। সন্তান হওয়ার পর তার ঘর যেন আরও আলোয় আলোকিত হয়। বাবা মায়ের কথা খুব মনে পড়ে সুজানার কিন্তু লজ্জা আর প্রতিজ্ঞার জন্য সে তাদের কাছে যেতে চায় না।
আবার তীব্র শীত পড়েছে। জানালার বাইরে চান্দের আলোয় চিকচিক করছে কুয়াশার ফুল। এ-ই কুয়াশার ফুল দেখলে সুজানার সবকিছু উৎসব-উৎসব লাগে। সুজানার মনে পড়ে যায় তার গ্রামের মাঠে তীব্র শীতে ওয়াজমাহফিলের প্যান্ডেল বক্তার রসিক কণ্ঠ এককোণে চাদর মোড়ে দাঁড়িয়ে মহিলাদের ওয়াজ শোনা সহ আরও কতো মধুর স্মৃতি।
৫টি মন্তব্য
ফয়জুল মহী
বাহ
দারুণ একটি লেখা উপহার দিয়েছেন ভাই
দালান জাহান
ধন্যবাদ কবি শুভেচ্ছা
রোকসানা খন্দকার রুকু
অসাধারণ ভাই! চলতে থাকুক।
শুভ কামনা।
দালান জাহান
ধন্যবাদ ভালো থাকুন সবসময়
আলমগীর সরকার লিটন
খুব সুন্দর লেখেছেন গল্প পড়ে ভাল লাগল জাহান দা