অনুবাদ গল্পঃ আনন্দ আর দুঃখবোধ

অলিভার ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬, শুক্রবার, ০৬:০০:০১পূর্বাহ্ন গল্প ৬ মন্তব্য

 

চমৎকার এক বাগান বাড়ির মালিক ছিলেন এক লোক। রুচি আর সাধ্যের সংমিশ্রণে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন তার সাধের বাড়িটিকে। শুধুমাত্র চমৎকার উপমা দিলে হয়তো বাড়িটির প্রশংসায় ভাটা পড়বে, তাই বাড়িটির সৌন্দর্যের সম্মানার্থে একে অপূর্ব আলয় বলা যেতে পারে।

গ্রামের অনেকেই ঐ বাগান বাড়িটি মালিকানায় পাবার জন্যে বেশ আগ্রহী ছিল। শুধু যে ঐ গ্রামের লোকেরাই আগ্রহী ছিল তাও নয়, বরং আগ্রহীদের তালিকায় ছিল দূর দূরান্তের অনেক নামী-দামী আর প্রভাবশালী লোকেরাও। কিন্তু বাড়ির মালিক বাড়িটিকে এত ভালোবাসতেন যে সকল আগ্রহীদের সব ধরণের প্রস্তাব সে বারংবারই নাকচ করে আসছিলেন অনেক লম্বা সময় ধরে।

একবার এক বিশেষ কাজে তাকে দিন কয়েকের জন্যে যেতে হল শহরে। শহরের কাজ শেষে দিন কয়েক বাদে ফিরছিলেন নিজ নিবাসে। পথিমধ্যে শুনতে পেলেন তার শখের বাগান বাড়িটিতে কিভাবে যেন আগুন লেগে গেছে। আর সে খবর শুনে সকলকেই ছুটতে দেখলেন সেদিকে। সখের বাড়িটিতে আগুন লাগবার খবর শোনামাত্র লোকটি যেন উড়ে চলল বাড়ির দিকে।

বাগান বাড়ির কাছাকাছি পৌছে দেখলেন শ'য়ে শ'য়ে লোক ভীর করেছে বাড়িটিকে ঘেরাও করে। কিন্তু কারোই এখন আর কিছু করার নেই, আগুন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বাড়িময়। সত্যি বলতে সবই মিলে যদি এখন হাতও লাগায় তবুও বাড়িটিকে আর উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। সকলের চেষ্টার বিপরীতেও মিলবে পোড়া বাড়ি আর জ্বলে-পুড়ে ভস্ম হয়ে যাওয়া আসবাব পত্র। টুকরো কোন বস্তুই ঐ বাড়ি থেকে আর অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। আর সেটা বুঝতে পেরেই সকলে তাদের অহেতুক চেষ্টা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছে।

জ্বলতে থাকা বাড়িটির দিকে নিঃস্বের মত তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই যেন করার থাকল না। বাকি সবার মত সেও দাড়িয়ে দাড়িয়ে তিলে তিলে গড়ে তোলা নিজের স্বপ্ন কুটিরটির পুড়ে যাওয়া দেখতে লাগলেন।

এরই মাঝে লোকটির বড় ছেলেকে দৌড়ে তার দিকে আসতে দেখলেন। দৌড়ে আসার কারণে ঠিক মত কথাও বলতে পারছিল না ছেলেটি। কোনরকমে বাবার কাছে পৌঁছে বলতে লাগল- "আব্বা, আপনি বাড়িটার জন্যে মোটেই মনে কোন কষ্ট নেবেন না। আপনি চলে যাবার পর এক ভদ্রলোক এসেছিলেন বাড়িটি কেনার জন্যে। অন্য সকলের তুলনায় প্রায় চার গুন দাম বলেছিলেন তিনি। এ বাজারে এত দাম দিয়ে অন্য কেউ বাড়িটিকে কেনার কথা চিন্তাও করবে না। তাই আর আপনার ফিরে আসার অপেক্ষা না করে ঝটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে বাড়িটি আমি তার কাছে বিক্রি করে দেই। আমি মনে করছিলাম ফিরে এসে আপনি এ কথা শুনে রাগ করলেও আমাকে আমার এমন সিদ্ধান্তের জন্যে ক্ষমা করবেন।"

বড় ছেলের এমন কথায় বাবা যেন আপন স্বস্তির নাগাল খুঁজে পেলেন। একটু চুপ থেকে বললেন, "খোদাকে ধন্যবাদ, তোমাকে এমন উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করার জন্যে!" স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আবারও তিনি বাড়িটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার সাধের বাড়িটি এখনো পুড়েই চলেছে।

অল্প কিছু সময় পরই দেখলেন তার মেঝ ছেলে আরেক দিক থেকে দৌড়ে আসছে তার দিকে। কাছে এসেই আক্ষেপ আর কর্তৃত্ব মিশ্রিত কণ্ঠে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল, "আব্বা, আপনি কি করছেন? বাড়িটি পুড়ে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে আর আপনি এখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছেন? আপনি না প্রায়ই বলেন যে এ বাড়িটিকে আপনি আমাদের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন; তাহলে এমন নির্বাক হয়ে কিভাবে আপনি বসে থাকছেন বলেন তো শুনি?"

বাবা যেন মেঝ ছেলের এমন কথায় কিছুটা কৌতুক খুঁজে পেয়েছেন এমন করে একটু হাসলেন। তারপর বললেন, "আরে বোকা, তুমি কি জানো না যে গতকালই তোমার বড় ভাই এই বাড়িটি বিক্রি করে দিয়েছে?" বাবার উত্তর শুনে মেঝ ছেলে বলল, "সে ব্যাপারে জানি, কিন্তু বাড়িটি কিন্তু এখনো পুরোপুরি বিক্রি হয়ে যায় নি। বড় ভাই আপনার সিদ্ধান্ত নেবার জন্যে বাড়িটি ঐ ভদ্রলোকের কাছে বিক্রি করার আশ্বাস দিয়েছে মাত্র। আর বড় ভাইয়ের আশ্বাসের প্রতিরূপে লোকটি কেবল কিছু অগ্রিম টাকা দিয়ে বাড়িটির বিক্রয় চুক্তি নিশ্চিত করে রেখেছেন। বিক্রির পুরো টাকা এখনো আমাদের হাতে আসে নি! কিন্তু এখন তো এখানে ছাই ছাড়া আর কিছুই মিলবে না, ভদ্রলোক নিশ্চই কেবলমাত্র এই মূল্যহীন ছাই কেনবার জন্যে এতগুলি টাকা পরিশোধ করবেন না!"

যে কান্না শুরু হবার আগেই থেমে গিয়েছিল, এসব শোনার পর তা যেন জলোচ্ছ্বাসের রূপ নিলো। স্বস্তির সাথে হৃদয়টাও যেন টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ল চারিদিকে। ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি; যতটা না বাড়িটিতে আগুন লাগবার শোকে, তারচেয়ে বেশি বাড়ি মূল্য আর আপন স্বস্তি খুইয়ে ফেলবার দুঃখে আর্তনাদ করে কাঁদতে লাগলেন। আশে পাশে লোকজনও যেন এবারে লোকটির এমন কান্না দেখে স্বস্তি খুঁজে পেল। কেউ কেউ দূর থেকেই সান্ত্বনা বাক্য ছুড়ে দেবার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছিল। কিন্তু এবারে যে আগুনের কারণে কান্নার সৃষ্টি তা আর সান্ত্বনা বাক্যে বন্ধ হবার নয়।

এরই মাঝে লোকজনের ভিড় ছেলে উদয় হল লোকটির ছোট ছেলে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "আব্বা, এভাবে কাঁদবেন না। আর বাড়িটির জন্যেও দুঃখ করবেন না। বাড়িটি সত্যিই আর আর আমাদের নয়"। ছোট ছেলে ছেলে সান্ত্বনা দিচ্ছে ভেবে লোকটি বললেন, "নারে বোকা! আমাদের বাড়িটিই পুড়ছে তোমার চোখের সামনে। আর পোড়া বাড়ি কখনোই বিক্রি হয় না। বাড়ির এমন দশা দেখে অগ্রিম টাকাও নিশ্চিত ফিরিয়ে নিতে আসবেন ঐ ভদ্রলোক।"

ফের ছোট ছেলে বলল, "আব্বা, আপনি ভুল বুঝছেন। আপনি এখনো আমার পুরো কথাটি শোনেন নি। বাড়িতে আগুন লাগবার ঘটনা শুনে ভদ্রলোক কিছুক্ষন পূর্বে আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন। তিনি তার দেয়া কথা রাখবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন আমায়। বলেছেন- 'আগুন লাগুক কিংবা না লাগুক ঐ বাড়ির মালিকানা কেবলই আমার, এবং আমি অবশ্যই চুক্তি অনুযায়ী বাড়ির ক্রয়মূল্য তোমাদের পরিশোধ করব। ভাগ্যের ব্যপারে কারও কোন হাত থাকে না, বরং তা ওপর-ওয়ালাই নির্ধারন করে দেন। আমি কিংবা তোমরা কেউই আগে থেকে জানতাম না ঐ বাড়ির ভাগ্যে কি রয়েছিল। যেহেতু চুক্তির পর বাড়িটি আগুনের স্পর্শ পেয়েছে, অতএব সে আগুনে পুড়ে যাওয়া বাড়ির মালিকানাও আমার ভাগেই পড়ে। তাই তোমরা ঐ দুর্ঘটনা নিয়ে মোটেও কোন চিন্তা করো না। আমি যথা-দ্রুত সম্ভব বাড়িটির মূল্য পরিশোধ করব'।"

কথা শুনে লোকটির জলোচ্ছ্বাস থামলেও অশ্রু যেন আর বাধে আটকে রাখা যাচ্ছিল না। অশ্রুসিক্ত নয়নেই বোকার মত দাড়িয়ে কেবল বাড়িটির পুড়ে যাওয়া দেখতে লাগল সকলে মিলে।

⚍⚌⚎  নীতিনিষ্ঠ মূল্যায়ন  ⚎⚌⚍

মনব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য নিরূপণ দারুণ এক জটিল কাজ। গল্পের বাগান বাড়ির মালিক যদিও তার সন্তানদের তুলনায় তার বাড়িটিকে অধিকতর ভালোবাসতেন, তবুও তিনি স্বস্তি খুঁজে পেয়েছিলেন এই জেনে যে বাড়িটির মালিকানার ভার এখন আর তার নেই। যদিও পূর্বে কোনভাবেই তিনি বাড়িটিকে বিক্রি করতে সম্মত ছিলেন না। কিন্তু যখন চোখের সামনে বাড়িটির সৌন্দর্য ধীরে ধীরে হারাতে লাগল, তখন তিনি ভালোবাসা আগলে রেখে কেবল বাড়ি বিক্রির অর্থের দিকে চেয়ে সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু পরমুহুর্তে যখন জানতে পারলেন বাড়ির সৌন্দর্য আর মূল্য দুটোই তিনি হারাচ্ছেন তখন আর নিজের দুঃখের লাগাম টেনে ধরতে পারেন নি, ভেঙ্গে পড়েছিলেন নিমিষেই। এরপর যখন আবারও ছোট ছেলের কাছ থেকে পরবর্তি ঘটনা জানলেন তখন দুঃখ, সান্ত্বনা এবং কৃতজ্ঞতা বোধ সবই তার উপর ভর করে ছিল।

গল্পের মতই মানুষের আনন্দ আর দুঃখবোধ সময় আর ঘটনা প্রবাহের সাথে পরিবর্তিত হয়। ভালোবাসার অধিকার অর্জন আর হারানোর অনুপাতের দাঁড়িপাল্লায় হিসেব করে প্রকাশ পায় এক এক জনের অনুভূতি। গুরুত্বের পানসি জোয়ার-ভাটার টানে ঘুরে বেড়ায়, এগিয়ে যায়, পিছিয়ে যায় কিংবা থেমে থাকে নিজের জায়গায় নোঙ্গর ফেলে। একই ঘটনা ঘটে আত্মীয়তা আর বন্ধুত্বের সম্পর্কে।

তাই কারও আচরণ দেখে বিচার করবার আগেই ভাবতে হবে তার আচরণের পেছনে ঘটে যাওয়া বা ঘটতে থাকা কারণ গুলো নিয়ে। বুঝতে হবে তার উচ্ছাস কিংবা নিস্তব্দতার কারণ। আর এরপরই কেবল একজন মানুষের আচরণের বিপরীতে তার প্রকৃত মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে।

 

 

 

 

 

0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ