হারিয়ে যাওয়া ইউরোপের প্রথম ইসলামী সাম্রাজ্য স্পেন

 

‘জিব্রালটার’ আমরা সবায় চিনি,  কারন  এই নামে এখানে প্রণালীটি  থাকার জন্য। যে প্রণালী আটলান্টিক মহাসাগর এবং ভূমধ্য সাগর কে সংযোগ করেছে। 

এই নামের সাথেই জড়িয়ে আছে আছে ইসলামী সভ্যতার  আর একটি গৌরবময় ইতিহাস। 'তারিক ইবনে জাইদ' থেকে 'জিব্রালটার' নামের উৎপত্তি । 

‘ তারিক ইবনে জাইদ ’  একজন মুসলিম বারবার কম্যান্ডার প্রথম এখানে অবতরণ করেন ইসলামী রাজ্য স্থাপনের জন্য। হজরত মুহাম্মাদ ( সাঃ আঃ ) জন্মের মাত্র দুইশত বছরের মধ্যেই এখানে এই শক্তি শালী  রাজ্য  টি গোড়ে উঠেছিল ।'বারবার' একটি গোত্রের নাম।

 তারিক ইবনে জাইদ 

আর তাঁর নাম অনুযায়ী এই স্থানের নামকরণ হয় ‘জিব্রালটার' অর্থাৎ ‘ জাবিল ইবনে  তারিক’ ।তিনি ছিলেন অসীম সাহসী বীর যোদ্ধা।  

গোল্ডেন এরা 

আব্দুল আল রহমান ( এক,)   প্রথম  আমীর অব আনদালুসিয়া স্পেনের সোনালি যুগের আমীর

সময়টি ৭১১ সাল থেকে ১৪৯২ সাল পর্যন্ত ।মাত্র সাত বছরের মধ্যেই পুরো আন্দালুসিয়া মুসলমানদের অধিকারে আসে।  প্রায় ৮০০ বছরের তাদের  ইসলামী রাজত্ব ছিল এখানে। তারপর এখানে আর্ট এবং কালচারের এক অভুতপুর্ব সভ্যতার উৎপত্তি হয়। সময়টি  ছিল ‘মেডিভ্যাল ইয়োরোপ’  । কিন্তু ইসলামী রাজত্ব ছিল সময়ের তুলনায় অনেক অগ্রগামী। এবং তারা সেখানে একটি সেকুল্যার সমাজ গোড়ে তুলে ।

রোমান সাম্রাজ্যের পতন হয় ৪ শতাব্দী থেকে ৫ শতাব্দীর মধ্যে।সেই সময়টিকে বলা হয় ইউরোপের ইতিহাসের ‘ডার্ক এজ’। ‘ডার্ক এজ’ এই জন্যই বলা হয় কারন  তখন তাদের কোনো সভ্যতা ছিলোনা। অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। ছিলোনা কোনো উন্নয়ন। ৯৯% জনসাধারণ ছিল অক্ষর জ্ঞান হীন। এমনকি তাদের রাজাও লেখতে পড়তে পারতো না ।

 ইউরোপে সভ্যতা এসেছে উত্তর আফ্রিকার মুসলমান মুরস দের মাধ্যমে। ইউরোপের রাস্তায় ফুটপাথ বা লাইট তো দূরের কথা রাস্তাই  ছিল না।   কিন্তু ইসলামী স্পেনে রাস্তা , ফুটপাথ এবং রাস্তার লাইট সব ছিল।এদের আরও একশত বছর পরে  লন্ডনে এবং প্যারিস শহরে রাস্তায়  আলো আসে। পাবলিক বাথ ছিল ৯০০ টি।সমস্ত ইউরোপে মাত্র দুইটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল কিন্তু ইসলামী স্পেনে করোডোভা,আলমেরিয়া, গ্রানাডা,জুএন,মালাগা,টলেডো এবং সেভিলে ছিল  ৭০ টি বিশ্ববিদ্যালয়। ইউরোপে কোন লাইব্রেরী ছিলোনা কিন্তু ইসলামী  স্পেনে ছিল ৭০এর বেশি লাইব্রেরী।  চীন এবং পাক ভারত উপমহাদেশের জ্ঞান বিজ্ঞ্যান এর‍্যাব মুরস দের মাধ্যমে স্পেনে আসে এবং পরে  তা  ইউরোপে গিয়াছিল। উদাহরণ স্বরূপ চীনের ‘কমপাস ’ যা এখানে আগে আসে পরে  তা  ইউরোপে যায়। কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক পানি সেচের ব্যাবহার এবং সিল্ক বস্ত্রের কারখানা এখানে ইসলামী সভ্যতাই এনেছিল। এখানে ছিল ৫০ টি হাসপাতাল।

 সব ধর্মের সহ অবস্থানঃ 

     

যেখানে সব ধর্মের মানুষ শান্তিপুর্ন ভাবে সহ অবস্থান করতো।বেসিল ডেভিডসন ( Basil Devidson) নামক একজন  নামকরা ইতিহাসবিদ তার গবেষণায় বলেছেন ‘জনসাধারনের একটা আরাম দায়ক জীবন ছিল’   

আধুনিক আর্কিটেকট 

করডোভা মসজিদ 

সে আমলের তাদের শক্তিশালী রাজত্বের প্রচুর স্থাপনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে করোডোভা,গ্রানাডা, সেলভি এবং মালাগায়।   এইসব দেখলে বোঝা যায় তারা কতখানি শক্তিশালী ছিল এবং কত অগ্রগামী ছিল চিন্তা চেতনায় । ‘আন্দালুসিয়া’  শব্দটি আসে আরবি শব্দ থেকে। আন্দালুসিয়ার রাজধানী করোডোভায় ‘The Great Mosque’,  এর আর্কিটেকচারের জন্য  বিখ্যাত । যার আছে ১০০০ টি মার্বেল পাথরের কলাম। আছে হাজার হাজার পিতল এবং সিলভারের ল্যাম্প।

তার গবেষণায় দেখা যায় ,একমাত্র করোডোভায় অর্ধেক মিলিওন মানুষে জন্য ১১৩০০০ বাড়ি ঘর ছিল । ৭০০ মসজিদ, ৩০০ পাবলিক বাথ, বইয়ের দোকান এবং ৭০ টি  লাইব্রেরী ছিল।’Alhambra' Unesco World Heritage site হিসেবে নাম পেয়েছে। 

 গ্রানাডা মসজিদের অসম্ভব সুন্দর ডিজাইন 

রাজ্য স্থাপনঃ 

সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামী রাজত্ব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আরব দেশ,এশিয়া মাইনর, পারস্য, আফ্রিকার উত্তর দিকে যেমন সিরিয়া, মরক্কো, তিউনেসিয়া, আলজেরিয়া এবং  মিশরে  ইসলামী রাজ্যের বিস্তার ঘটে । উত্তর আফ্রিকায় আধিপত্য বিস্তারের পর তারা ইউরোপের দক্ষিণে আধিপত্য বিস্তারে করে ।কারন স্পেন এবং উত্তর আফ্রিকা খুবই কাছাকাছি। সব চেয়ে  কম ব্যাবধান মাত্র নয় মাইল এবং মরক্কোর এটলাস পর্বত মালা স্পেনের জিব্রালটার থেকেই দেখা যায়। 

কথিত আছে ( BBC সূত্র ) ‘জুলিয়ান’ নামক একজন খ্রিস্টান প্রধান যে কিনা ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত ছিল তিনি উত্তর আফ্রিকার গভর্নর মুসা বিন নাসিরের কাছে গিয়ে সে সময়ের ভিসিগথ ( visigoth) শাসক রডারিক এর কাছ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সাহায্য চায়।  

উত্তর আফ্রিকার মুসলমান গভর্নর ‘মুসা বিন  নাশীর’ কে বলা হয় স্পেনে রাজ্য বিস্তারের ব্যাপারে।  ৭০০০ হাজার  আর্মির এক বিরাট বাহিনী সহ  ‘তারিক ইবনে জাইদ ’ এর নেতৃত্বে স্পেনের দক্ষিণে বর্তমানের জিব্রালটার এ অবতরণ করে। 

খ্রিস্টান নেতা এবং রাজা রোডারিক  সে সময় ব্যাস্ত ছিল অন্য সব দখলদারিদের  পরাজিত  করার কাজে । 

‘Battle Of Guadalete’ যুদ্ধে রোডারিক এবং তারিক এর মাঝে যুদ্ধ হয় এবং মাত্র এক মাসের মধ্যে তারিকের সৈন্য সামন্ত রোডারিক কে হারিয়ে দিয়ে স্পেনের মধ্যভাগ পর্যন্ত চলে যায়। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তারিক সমস্থ ভিসিগাথিক রাজত্ব নিজেদের কন্ট্রোলে আনে।

স্পেনের ইসলামী যুগ এবং উঁচু মানের  আর্ট এবং ডিজাইন   

মুসলমানরা এখানে নূতন এক সভ্যতা নিয়ে আসে। খ্রিস্টান দের আধিপত্য সরিয়ে একটা সর্ব ধর্মের সহ অবস্থান নিয়ে আসে। যার ফলে এখানে সব ধর্মের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারতো এবং একটা সমৃদ্ধ জাতী আর সভ্যতা গোড়ে উঠেছিল । স্কুলকলেজ, চিকিৎসা বিজ্ঞান, বিজ্ঞান, আর্ট ,আর্কিটেক্ট, ডিজাইন ,দর্শন, ম্যাথেমেটিকস এবং কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়াশুনা হতো। সব  কিছুতেই সময়ের অনেক আগে ছিল সেই সভ্যতা।স্পেনের ইসলামী সভ্যতা ছিল উচ্চমানের  আর্ট এবং কালচারে পূর্ণ । যাকে তুলনা করা যায় সমসাময়িক রোমান সাম্রাজ্যের ইতালিয়ান রেনেসাঁর সাথে।প্রথম দিকের শাসক রা এসে ছিল সিরিয়া থেকে এবং এই জন্য তাদের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বাইজেনটাইন সভ্যতার প্রভাব পড়ে ছিল।  এই জন্য স্পেনের ইসলামী যুগেকে ‘গোল্ডেন এরা’ বলা হয়।

 

সেখানে আব্দুল আল রহমান , মাতৃভূমি সিরিয়া এবং বাইজেনটাইনের আদলে  অনেক বিল্ডিং বানান। পুরো করোডোভার বিভিন্ন মসজিদ এবং বিল্ডিং এ তার প্রভাব দেখা যায়। ‘ আব্দুল -আল- রহমান ৩’ ( ৯১২- ৬১) নিজেকে খলিফা  ঘোষণা করেন পুরো আন্দালুসের। 

‘আব্দুল-আল-রহমান’ করোডোভা কে রাজধানী শহর গোড়ে তুলে সেখানে লাইব্রেরী স্কুল, ওয়ারকশপ সহ শত শত বিল্ডিং স্থাপন করেন। এইসব বিখ্যাত সব বিল্ডিং এর কলাম বানানোর জন্য নর্থ আফ্রিকা , বাইজেনটাইন এবং সিরিয়া থেকে মার্বেল পাথর আনেন। ফাউনটেন বানান।  জিওম্যাত্রিক্যাল নকশা, Smetrical ডিজাইন দেখা যায় বিভিন্ন মসজিদ, প্যালেস, রাজপ্রাসাদে । যে আর্ট গুলো সিরিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে লক্ষ করা যায়। হাতির দাঁতের ব্যাবহার  এবং কুরআনের বানী সুন্দর ভাবে আর্ট করে ডিজাইন শোভা পায়   বিভিন্ন স্থাপনায় । 

গ্রীক  দর্শনের চর্চাঃ   ' সব ধর্মের মানুষেই এক সৃষ্টি কর্তার দ্বারা সৃষ্টি ' 

মুসলমান পণ্ডিতগণ  গ্রীক দর্শন নিয়ে চর্চা করতেন  এবং সেই দর্শনের বিষয়বস্তু গবেষণার মাধ্যমে নিজ ধর্মে প্রতিফলন করতেন। চিন্তা চেতনায় মননে এবং মানসিকতায় তাদের দর্শন ব্যাবহার করতেন। মুসলমানরাই প্রথম যাদের মাধ্যমে পশ্চিম ইউরোপে এই দর্শনের বিস্তার হয়। মুসলমান এবং খ্রিস্টান শাসক সবসময় একে অপরের কাছ থেকে চিন্তা, দর্শন এবং জ্ঞানের আদান প্রদান করতেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, EI- Cid নামক একজন খ্রিস্টান যোদ্ধা মুসলমানদের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। 

কারা বসবাস করতো এখানেঃ  

যখন সেখানে ইসলামী সাম্র্যাজ্জ্য স্থাপন হয় তখন সেখানে আরব থেকে আসা খুব কম মানুষই  ছিল ।  অনেক ধরনের জাতী ,বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মিলন মেলা ছিল সেখানে। মুরস ( মরক্কের একটি স্থানীয় মুসলান  গোত্র ) , জুইস, বারবার, আফ্রিকান, খ্রিস্টান, মজার‍্যাব, আর‍্যাবিও খ্রিস্টান এবং ইউরোপের মারসেনাজিরা সেখানকার স্থানীয় ছিল। আরব থেকে কোন মুসলমান তারা নিয়ে আসেনি এবং তারা আসেওনি। 

 প্রথমদিকে মুসলমান শাসকরা অমুসলমান মেজরিটি জনসাধারনকে শাসন করতো। 

bbc সূত্র অনুযায়ী সেখানে মাল্টি কালচারাল সোসাইটি ছিল এবং  তিনটি ধর্ম খ্রিস্টান, মুসলমান এবং জুইস এক সাথে শান্তিতে বসবাস করতো।সাহিত্য, কবিতা, মিউজিক উন্নয়নের পেছনে সব শ্রেণীর সমান অবদান ছিল। 

তারপর ধীরে ধীরে দশসো   শতাব্দীর দিকে বেশির ভাগ বসবাসকারী মুসলমান এসেছিল বারবার সম্প্রদায় থেকে।’বারবার’ হল মরক্কের একটা গোত্র ।স্প্যানিশ রা সকলকেই ‘এর‍্যাব বারবার’  বলতো ।    তবে বেশির ভাগ অঞ্চলেই সব ধর্মের মানুষ শান্তিতে সহবস্থান করতেন। 

কারা ছিল এই শাসক শ্রেণিঃ 

স্পেনে একই শাসক সব সময় থাকেনায় । যে শাসক শ্রেণী ক্রমাগত ভাবে এসেছেন তারা হলেন ,

১) ডিপেনডডেট অব আমিরাত, (৭১১-৭৫৬) 

২) স্বাধীন আমিরাত ( ৭৫৬-৯২৯) 

৩) খালিপাত ( ৯২৯- ১০৩১) 

৪) আল মরাভিদ ( ১০৩১-১১৩০) 

৫) নিন্মমুখি পতনের দিকে যাওয়া (১১৩০-১৪৯২) 

উমাইয়া বংশের আমলে সবচেয়ে সমৃদ্ধি ছিল দক্ষিণ স্পেন। 

মুসলমানদের ক্রিতকার্জ হওয়ার পেছনের  কারনঃ 

স্পেনে ইসলামী রাজত্ব ছিল প্রায় ৮০০ বছর। কোন সময় পুরো স্পেন ছিল তাদের দখলে কোন সময় দক্ষিণ স্পেন। কৃতকার্জের পেছনে ছিল ১) ‘সুদ্রিহ সহ অবস্থান সব ধর্মের মানুষে সাথে।”

 ২) ইসলামী শাসন আমলে সরকার জনসাধারণের উপরে কড়াকড়ি আদেশ নির্দেশ দায়নি কর প্রদানের উপরে। ৩) জোরপূর্বক বা জোর জবরদস্থি শাসন যাকে বলা হয় ডিক্টেটর তা ছিলোনা। ৪) সব ধর্মকে মূল্যায়ন করা হয়ে ছিলো। ৫) মানুষ কে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হতো। ৬) সকল গোত্র থেকে লোক  নিয়োগ দেয়া হতো আর্মি গঠনের  ব্যাপারে বা শাসন কার্জ চালনার ব্যাপারে। যার ফলে সরকারের উপরে কোন চাপ ছিলোনা শাসন করার ব্যাপারে। 

এই শান্তিপূর্ণ দেশ চালনার জন্য ক্রেডিট দিতে হবে আমির আবদুল্লাহ আল রহমান কে । যিনি ‘Emirate of korodova’ প্রথিসটা করেন । যিনি সবায়কে নিয়ে দেশ শাসন করেছিলেন । উচ্চ শ্রেণীর ভিসিগথ দের বেশিরভাগ ইচ্ছাকৃত ভাবে ইসলামধর্মে কনভার্ট হয় এবং বড়ো বড়ো পদ গুলোর দায়িত্ব নায়। 

 

এই সাম্রাজ্যের পতন এবং এর কারন 

৯৭৬ সালে খলিফা আল রহমানের পুত্র আল হাকিমের মৃত্যু হয়। তাঁর পুত্র হিসাম ২, মাত্র ১০বছর বয়সে সিংহাসনে বসে। বয়স কম থাকায় শাসনকার্য চালানো তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। এই সুযোগে মন্ত্রী মুহাম্মাদ ইবনে আবি আমিরাল আল মনসুর দেশ চালানোর দায়িত্ব নায়। সে সময় রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দায়। এবং রাজ্য ২৩টি  অংশে ভাগ হয়ে যায়। যেটি ছিল মুসলমানদের ক্ষমতা হারানোর প্রথম ধাপ। 

সে সময় রাজা জেমস যার রাজ্য এরিগন ক্রমান্বয়ে বড়ো হতে থাকে এবং মুসলমান দের রাজ্য দক্ষিণে ছোট হতে থাকে। 

 

করোডোভার উমাইয়া খলিফার মধ্যে ভাঙ্গন প্রমাণ করে আন্দালুসিয়ার  (স্পেন) ইসলামী শাসনের শেষ হওয়ার আরম্ভ। অর্থাৎ তখন থেকেই ইসলামী শাসন ভেঙ্গে পড়তে থাকে।

 এর কারন গুলো হল ১) নেতৃত্বের অভাব, ২) ক্ষমতা সেন্টারে না রেখে ভাগাভাগি করে দেয়া, ৩) নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শের  বিবাদ, ৪) নৈতিক অবক্ষয়, ৫) কার্জকলাপ বিজ্ঞান ভিত্তিক ছিলোনা, ৬) বুদ্ধিবৃত্তির অবনতি,   ৭)  ধর্ম নিয়ে বাড়া বাড়ি  ৮) আক্রমণের হাত থেকে স্পেনের জনসাধারণকে নিয়ে সেনাবাহিনী না করে মরক্কো থেকে আর্মি আনা।  

ইসলামী রাজত্বের পতনের কারন শুধুমাত্র খ্রিস্টান দের ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় করা  এবং তা  ব্যাবহার করে এগিয়ে যেয়ে দখল করা নয়, মুসলিম শাসক দের মধ্যে বিভেদ  এবং  ভেদাভেদ সৃষ্টি এবং একতা না থাকায়  এর পতনকে তরান্বিত করে। 

১৩ শতাব্দী থেকে ১৫ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার ভাঙ্গন দেখা যায় এবং উম্মাদের মধ্যেও   কোনো  একতা  ছিলোনা।

‘বারবার’ গোত্রের   রিভোল্ট বা বিদ্রোহ 

উমাইয়া খলিফা আর বেশি দিন তাদের সাফল্য ধরে রাখতে পারিনি। ১০১০ সালে ‘মাদিনাত আল যাহারা’ ধ্বংস হয়ে যায় । এর পেছনের কারন হল একজন বারবারের রিভোল্ট। যার ফল স্বরূপ উমাইয়া শাসন কাল শেষ হয়ে যায়। গৃহযুদ্ধের ফলে উমাইয়া বংশের শাসন শেষ হয়ে যায় ১০৩১সালে। উত্তর স্পেনের খ্রিস্টান শক্তি বারে বারে আক্রমণ চালাতে থাকে। 

ভেঙ্গে যাওয়া মুসলিম রাজ্যের শেষ ভাঙ্গার যতটুকু অবশিষ্ট ছিল তারা করোডোবায় এসে জড়ো হয়। বাকি রাজ্য এক এক করে চলে যায়। 

শক্তিশালী নেতৃত্বের অভাব, ক্ষমতার কেন্দ্রিকরন না থাকা এবং আভ্যন্তরীণ রাজ্যগুলোর রাজনৈতিক গণ্ডগোল স্পেনের মুসলিম রাজ্য পরাজিত হতে থাকে। 

স্পেনের উত্তরের খ্রিস্টান সম্প্রদায় অপেক্ষা করছিল ঠিক এই ভাঙ্গনের সময়টির জন্য।

 আল-মরাভিদস এবং আল-মহাদেস ( দুটি ইসলামিক গ্রুপ) 

নিজেদেরকে উদ্ধার করার জন্য আন্দালুসের মুসলিম রাজা উত্তর আফ্রিকার মুসলমান আলমোরাভিদস দের কাছে সাহায্য চাইলো । ১০৮০ সালে মুসলমান দের দুর্বল রাজ্য টিকে পুনউদ্ধার করার জন্য এগিয়ে আসে।

তলেডো ( Toledo) ছিল একটি বৃহৎ ইসলামিক সিটি। সেটার যখন পতন হয় তখন আফ্রিকার জেনারেল ইউসুফ বিন তাসফিন খ্রিস্টানদের পরাজিত করে।

 ১০৮৬সাল থেকে ১১০২ সালের মধ্যে আবার আন্দালুস দখলে আনে।   তারা শুধু ইসলামী রাজ্যটিকে পুনরুদ্ধার করলো তাই  নয়  তারা কেন্দ্রীয় শক্তিকেও ক্ষমতাবান করেছে এবং খ্রিস্টানদের অগ্রসরকে বাধাগ্রস্থ করেছে। ১১১০ সালে মুসলমান দের সমস্ত টেরিটোরি নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে নায় । 

১১১০ সালে প্রিন্সেস অফ মুসলিম তায়াফকে জোরপূর্বক সরিয়ে আলমরাভিদ সমস্ত রাজ্য নিজেদের দখলে নিয়ে নায়।   

 ১১০৬ সালে ইউসুফ বিন তাসফিন  এর মৃত্যুর পর মুসলমান শাসক রা নিজেদের মধ্যে মারামারি আরম্ভ করে । একজন ইতিহাসবিদ এভাবে লিখেছেন ‘ Rulars of muslim states began cutting each other throats again”। ১১৪৪ থেকে ১১৪৫ এর মধ্যে সমস্ত একতা চলে গেল ।  মুসলিম প্রিন্স কে জোরপূর্বক সরিয়ে আলমরাভিদ সমস্ত রাজ্য নিজেদের দখলে নিয়ে নায়। কিন্তু তা বেশিদিন ধরে রাখতে পারিনি। এর‍্যাগন্সের রাজা খ্রিস্টধর্মী ‘আলফন্স বাটলার’  মুসলমানদের আক্রমণ করে। 

আল-মহাদেস

 

সে সময় উত্তর আফ্রিকার আর একটা মুসলিম গ্রুপ ‘আল মহাদস ‘ শক্তি সঞ্চয় করে এবং আল মরাভিদ্দেরকে  সরিয়ে নিজেরা ক্ষমতা নায়। তারা মুসলমানদের ক্ষমতা  কেন্দ্রিকরনের চেষ্টা করে কিন্তু তা তারা বেশি দিন ধরে রাখতে পারিনি। ১২৪৮ সালে মুসলমানদের পরাজয় হয় ,  শুধু মাত্র গ্রানাডা ছাড়া। 

নাগ্রিদ ডাইনেশটিঃ 

  

গ্রানাডায় আবু আব্দুল্লাহর নাগরিড ডাইনেসটির উত্থান হয় এবং একই সময় খালিপাতের পতন হয় । সমস্ত মুসলমান গ্রানাডায় এসে জমা হয়। নাগ্রিদ ডাইনেসটি  ছিল লাস্ট  ডাইনেসটি । গ্রানাডায় তারা ১২৩০ থেকে ১৪৯২ পর্যন্ত মোট  ২৩ জন আমিরেতের অধীনে ছিল। 

দুটো বিষয় লক্ষণীয় ১) নাগ্রিদ কি ভাবে শাসন কাজ চালাতে চিন্তা করছে এবং ২)  খ্রিস্টান শাসকরা কি ভাবে প্রত্যুত্তর দিচ্ছে। 

নিজের আত্মরক্ষার জন্য এবং  প্রতিরক্ষা পাওয়ার জন্য খ্রিস্টান রাজাদের সাথে হাত মেলায় নাগ্রিদ  টাকা দেয়ার বদলে। কিন্তু টাকা দেয়ার সক্ষমতা না থাকার জন্য প্রতিরক্ষা তো পাইনি বরং  তারা তখন আক্রমণ চালায় কিন্তু আর্থিক ভাবে দুর্বল থাকার জন্য পাল্টা আক্রমণও  চালাতে পারিনি। 

ক্যাস্ত্রিল এবং এর‍্যাগন সবচেয়ে বড়ো দুটো রাজ্য,  যার রাজা ছিল ফারডিনেনড এবং এসাবেলা। তাদের মধ্যে বিয়ে হওয়ার ফলে দুই রাজ্য এক সঙ্গে এক বৃহৎ রাজ্যে পরিণত হয়। যার ফলে তারা মিলিত ভাবে গ্রানাডা দখল করে । 

শেষ সুলতান মুহাম্মাদ আলী , তাঁর মায়ের আক্ষেপ 'মেয়েদের মতো কেঁদে কি লাভ , পুরুষের মতো সাহস নিয়ে প্রতিহত করতে পারনি'

সর্ব শেষ মুসলমান সুলতান আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ আলী । মুহাম্মাদ  বিদায় নেয়ার সময় গ্রানাডার দিকে মুখ ঘুরিয়ে শেষ দেখার সময় চোখ অশ্রু সিক্ত হলে তাঁর মা আয়েশা বলেছিলেন ‘মেয়েদের মতো কেঁদে এখন কি লাভ, পুরুষের মতো সাহস নিয়ে প্রতিহত করতে তো পারনি’ ।  

মারিনিদিসঃ 

উত্তর আফ্রিকার আর এক গ্রুপ বারবার মারিনিদিস আর্মি পাঠিয়ে কোন সাহায্য করতে চাইনি কারন তারা ‘ব্যাল্যান্স অব পাওয়ার’  চেয়েছিল । 

আট শত বছরের দীর্ঘ শাসনের অবসান হয় এই ভাবে। ১৪৯২ সালে মুসলমানদের সমস্ত ক্ষমতা চলে যায়।  

১৫০২ সালে খ্রিস্টান শাসক ঘোষণা দায় হয় মুসলমানদের কনভার্ট হতে হবে । যখন এটা কাজ করেনি তখন খ্রিস্টান শাসক মুসলমানদের উপরে নিষ্ঠুর এবং নির্দয় হয়। অনেক মুসলমান কে হত্যা করা হয়, অনেক মুসলমান দেশ ত্যাগ করে মরক্কো চলে যায়। আর এভাবেই শেষ হয়ে যায় ইউরোপে ইসলামী রাজত্বের  যুগ ।  

তথ্য সূত্রঃ bbc Muslim Spain (711-1492) 

When black men ruled Europe 

Spain Under Muslim Rule Fact and details ,Past and patterns 

The Spainish Umayyads 711- 1031

Fall Of Muslim Rule in Spain ,Past and Patterns

স্পেন থেকে ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু যোগ

ফটো ক্রেডিট  , উইকিপেডিয়া

লেখক ও  গবেষকঃ হুসনুন নাহার নার্গিস   

 

 

0 Shares

৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ