বুক রিভিউঃ দিকশূন্যপুর
লেখকঃ মাহবুব ময়ূখ রিশাদ
প্রচ্ছদঃ কারুতিতাস
প্রকাশনীঃ অনিন্দ্য প্রকাশ

দিকশূন্যপুর
দিকশূন্যপুর

নামকরণঃ শুরু করি নামকরণ নিয়ে-
“দিকশূন্যপুর” একটি গল্প সংকলন গ্রন্থের নাম। ‘দিকশূন্যপুর নাম দেখেই যদি মনে হয় চেনা ধাঁচের গল্প তবে ভুল, তরুণ লেখক মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এই শিরোনাম দিয়েও প্রথম গল্প রেখেছেন কিন্তু; তিনি যে দিকশূন্য করার জন্যই এমন নাম দিয়েছেন তা এই গ্রন্থের একে একে ‘দোতারা’, ‘ঝড়ের জাদুঘর’, ‘মৃত্যুস্পর্শী রোদ’ ‘লাঠি’ ‘রক্তাক্ত শহর’, ‘কেবিন নাম্বার এগারো’, ‘নন্দিনী, নন্দিনী’, ‘কাঁটাচামচের ভুল যাত্রা’, ‘সাইকেলের ডানা’ এবং সবশেষে ‘ডেলফিনার কবুতর’এ এসে পরিষ্কার ফুটে উঠেছে।

প্রচ্ছদঃ আজকাল গল্প, উপন্যাস, কবিতার বইয়ের উপর ভিত্ত করে প্রচ্ছদ হয় খুবই কম, বই হাতে নিলেই সবাই চোখ বুলাই প্রচ্ছদে, ব্যতিক্রম আমিও নই। প্রচ্ছদ আর শিরোনাম দেখে প্রচ্ছদের মধ্যেই গল্প খুঁজে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা আমরা অনেকেই করি। কিন্তু “দিকশূন্যপুর” নাম দেখে প্রচ্ছদে নির্দ্বিধায় সবাই এমন একটা ‘পুর’ বা ‘নগর’ খুঁজে নিতে চাইবেন নিশ্চিত। যদি তাই খুঁজতে চান তবে সব গল্পই আপনাকে পড়তে হবে এবং শেষ গল্পটি শেষ করার পরে যখন প্রচ্ছদে আবার চোখ বুলাবেন তখন ঠিকই ধরতে পারবেন প্রচ্ছদে কি বলা আছে (আমি আমার মতো দেখেছি, সবাই সবার মতো করেই দেখুক তাই আমার দেখাটা দেখালাম না এখানে)।

গল্পগুলিঃ ‘মন’ এমন এক অস্তিত্ব যার কোন কূল কিনারা নেই। “দিকশূন্যপুর” হাতে পড়া শুরু পর থেকেই একটা ঘোর লাগা শুরু হবে, মনে হবে আপনি জাদুবলে এমন এক আবহের মধ্যে ঢুকে গিয়েছেন যেখানে শরীর নেই; আছে অনেকগুলো বা এক মনের অনেকগুলো ভাবনা ও তার আনুমানিক কাহিনী যার শেষ যে যার মতো করে দেখে নিতে চায়। তরুণ লেখক মাহবুব ময়ূখ রিশাদের এই “দিকশূন্যপুর” গল্পে শুরুতেই একটি দৃশ্যত অবাস্তব নগরের সন্ধান দিয়েছেন এবং সেই সাথে দ্রুতই সেই জাদুময় অবাস্তব নগর হতে বাস্তবের দিকভ্রান্ত জীবনের মানসিক দ্বন্ধের পেছনের কারণগুলো বা মানসিকতার এমন একটি শূন্যদিক দেখিয়েছেন যা পাঠক মাত্রই নিজের মনের ভেতরে নিজেকে দেখতে চাইবে। Spoiler দোষে দুষ্ট করতে চাই না বলেই “দিকশ্যূনপুর” এর কোন আভাস দিচ্ছি না।

পাঠক মতামতঃ বানান বিভ্রাট নেই গল্পের কোথাও, একেবারে ১০/১০ মার্কস। এই কাজটি তরুণ কুমার মহলানবীশ করেছেন বলে তাঁকে ধন্যবাদ জানাই তাই। গল্পে সাধারণত অনেকেই খেই হারিয়ে ফেলেন, জমাট বাঁধতে বাঁধতেই ছুটে যায় জমজমাট ভাবটি। এই জায়গায় লেখক বেশীর ভাগ গল্পের দারুণ দক্ষতা দেখিয়েছেন; বিশেষ করে ‘দিকশূন্যপুর’ ও ডেলফিনার কবুতর’ গল্পে গল্পের নারী চরিত্র ও পুরুষ চরিত্রের মুহুর্মুহু পরিবর্তনেও পাঠক হিসেবে আমাকে ভ্রান্ত হতে হয়নি যে কোন কথা কে বলছে বা কে কখন এসেছে, যখনই যে চরিত্র এসেছে নিজেকে সেই চরিত্রের মনে হয়েছে তৎক্ষণাৎ এবং লেখকের লেখনীর জাদুতে কোন চরিত্রকেই মনোজগতের আদলে দেখা মানুষ হিসেবে দেখেছি; নয় কিছুতেই চেনা বা অচেনা মানুষের আদলে! একেই বোধহয় বলে জাদু; লেখনীর জাদু!

সমালোচনাঃ “দিকশূন্যপুর” এর ফোনেটিক ইংলিশ বানানে ভুলটা দৃষ্টিকটূ ঠেকেছে। ‘দিকশূন্যপুর’ ও ‘ডেলফিনার কবুতর’ গল্পদু’টি ছাড়া বাকি গল্পগুলোতে লেখক যতবার মানুষের মনের ভেতরে ঢুকেছেন ততোবারই মনে হয়েছে এতো বিষাদ কেন! আমরা এতো বিষাদমাখা জীবনের গল্পই পড়তে চাই? নাকি এটাই বাস্তবতা যে চেতন বা অবচেতন যেভাবেই হোক না কেন আমরা আমাদের জীবনের বিষাদকে এভাবেই চোখের সামনে আলোতে পড়তে চাই না! প্রতিটি গল্পেই ভীষণ রক্কম ধাক্কা ছিল, সেই ধাক্কা কখনো হাসপাতালের বারান্দায় ঠাঁই পাওয়া মৃত্যু নিশ্চিত বৃদ্ধ রোগীর, আবার কখনো সেই রোগীর ছেলের তো কখনো স্বয়ং কোন এক ডাক্তারের, সেই ধাক্কা কখনো নিশ্চিত মৃত্যূর দিন গুনতে থাকা এক পিতার চাইতে এক স্বামীর আক্ষেপের চিৎকার, কখনো আবার বন্ধুত্বের বিশ্বাসে অবিশ্বাস তো কখনো শুধু মাত্র নিজের বিশ্বাসের কারণে খুন হয়ে যাওয়া মেধাবী সেই লেখক! এই বিষাদের ধাক্কাগুলো কি আমরা এভাবেই দেখতে চাই? একটি গল্প সংকলনের গ্রন্থের শুরু ও শেষের গল্প বাদ দিয়ে বাকি সব গল্পে এমন করে তীব্র বিষাদের ধাক্কা সামলে পাঠক কতটুকু সেই দুই গল্পে ঢুকতে পারবেন তা নিয়ে দিকভ্রান্ত হয়ে গেলাম নিজেই। তবে এই বিষাদের সমালোচনার অন্য রূপ হচ্ছে এই প্রথম ও শেষের দুই গল্পই মানুষের মনের আশার আলো জাগাতে পারে আবার। লেখক মাত্রই নিজের লেখনী শৈলীতে পাঠকের মন নিয়ে খেলবেন, এটাই তাঁর উদ্দেশ্য। এই “দিকশূন্যপুর”এর সব গল্পই তাই সেই খেলার উপকরণ। গল্পগুলোর ধারিবাহিক উপস্থাপনাতেও লেখক দক্ষতা দেখিয়েছেন। এই তরুণ লেখকের গল্পগুলো পড়ার পর আশার আলো দেখতে পাই এই ভেবে যে ‘মানুষের নিত্য মানসিক টানাপোড়েনের বলা না বলা কথাগুলো নিয়ে নতুন করে যারাই লেখনীতে বলতে এসেছেন তাঁদের প্রায় সবাই একতা প্রচলিত গৎবাঁধা ধারাতেই লিখেছেন, কিন্তু “দিকশূন্যপুর”এ তা একেবারেই অনুপস্থিতি। লেখক তাঁর স্বকীয় দক্ষতাতেই পুরো সময়জুড়ে আমার মনের ভেতর ঢুকেছেন একেবারেই আমার মতো করে।’

এই গল্প সংকলন গ্রন্থের দু’টো ভিন্ন গল্পের দু’টো লাইন আমি এপিগ্রাম হিসেবে পেলাম জীবন বোধের উপলব্দি হিসেবেঃ
১। ‘যেদিন প্রয়োজন থাকে না অতটা সেদিন রিকশার অপ্রয়োজনীয় টিং টিং শব্দে ছোট্ট গলিটি আরও ছোট হয়ে আসে।’- ‘দিকশূন্যপুর’
২। ‘সুস্থ মানুষের চোখ কথা বলে আর অসুস্থ মানুষের সমস্ত দেহ কান্না করে।’- ‘মৃত্যুস্পর্শী রোদ’

শেষ করার আগে বলতে চাই- পাঠক মাত্রই নিজের মতো করে লেখকের সৃষ্টিকে উপলব্দি করতে চায়, কারণ লেখককে পাঠকের পাঠ করার স্বাধীনতা দিতে হয়। যদি করতে পারেন তবে লেখক হিসেবে তিনি সফল। শুধু “দিকশূন্যপুর” নিয়ে নয়, লেখক তাঁর নতুন ও আগের সব লেখনী দিয়েই দীর্ঘকাল আমাদের মাঝে অবস্থান তৈরী করে নিচ্ছেন-এ’ আমি বেশ বলে দিতে পারি।

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ