প্রজম্মের ঋণ শোধ০৪

মনির হোসেন মমি ৫ আগস্ট ২০১৪, মঙ্গলবার, ১২:০৫:৪১অপরাহ্ন গল্প, মুক্তিযুদ্ধ ১৬ মন্তব্য

পটকা ফুটানো ছেলে পোলেদের প্রচন্ড ফুটানো পটকার শব্দে হঠাৎ মা বলে চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে সূর্য্য রাত তখন দুটো ঢাকা শহরের প্রতি পাড়ায় পাড়ায় চলছে বিজয় দিবসকে বরণ করে নেবার আয়োজন।সূর্য্য রোজীর এক মাত্র বাপ হারানো মুক্তি যোদ্ধার সন্তান।আজ বিজয় দিবস ১৬ই ডিসেম্ভর তাইতো গত রাত হতেই উৎসবে মাতাল দেশ, দেশের নতুন প্রজম্মরা।কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হবে জাতীয় কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান যেখানে উপস্হিত থাকবেন দেশের প্রধান মন্ত্রীসহ দেশ বরেণ্য নেতা কবি সাহিত্যিকরা।সূর্য্য সেই কুচকাওয়াজে যোগ দিতেই যাচ্ছিলেন পায়ে হেটে পথে এক ভিক্ষারী ভিক্ষার থালা নিয়ে ধারে ধারে ভিক্ষে করে বেড়ায় বয়স অনুমানিক পঞ্চাশের বেশী গরিবী তাকে যেন বৃদ্ধের কাছে নিয়ে যাচ্ছে।সূর্য্য চেয়ে দেখে সে যে রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে সেই রাস্তার দু পাশে ছোট ছোট স্কুলের ছেলে মেয়েরা প্রচন্ড রৌদ্রে ঠায় দাড়িয়ে কেউ দাড়িয়ে হাতের খাতা দিয়েই নিজেকে গরমের অতিষ্ট থেকে বাচতে বাতাস করছে কেউবা ক্লান্ত দেহে হঠাৎ বসে পড়েছে, বসে পড়ার ফলে তাকে মাষ্টারের কড়া শাষণের চোখ রাঙ্গানীও দেখতে হয়েছে।হয়তো কোন মন্ত্রী মিনিষ্টার এই রাস্তা দিয়ে আসবেন তাকে স্বাগত জানাতেই এত আয়োজন।বৃদ্ধ লোকটি সুর্য্যের কাছে হাত পাতে কিছু ভিক্ষা চেয়ে সূর্য্য আশ্চর্য হয় আজকের এই দিনে ভিক্ষারী এলো কোন্থেকে।

-বাবা তুমি কোথায় থাকো?

-বাড়ী ঘর নেই।

-কেনো?

-আমি হিন্দু যুদ্ধের পর পর সব সম্পত্তি তোমাদের মুসলমান কর্ণধাররা ভোগ দখল করছে।

-আপনি মামলা করেননি?

-করে কি লাভ, এ সকল সম্পত্তিতো এখন রাজনিতীর নেতাগো নেতাগিরীর মূলধন।ঐ সব জিগাইয়া লাভ নাই কিছু দেয়োনের অলে দেন।

কিছু দেবার জন্য সূর্য্য পকেটে হাত দেন এমন সময় গাড়ীর হর্ণের শব্দ আর আইনশৃংখ্ঙলা বাহিনীর বাশির শব্দে দু'কান দু আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরেন মনে হয় এতক্ষনে সেই কাঙ্গিত ব্যাক্তিটি যাচ্ছেন।বৃদ্ধ ভিক্ষারীটি দেশের মানচিত্র লাগালো চলে যাওয়া গাড়ীটি দেখে হাসছেন অবাক দৃষ্টি দিয়ে সূর্য্য চেয়ে রইল ভিক্ষারীর দিকে ভিক্ষারী হাসতে হাসতে এক সময় কান্নার রুলে চলে যায়।

-কি ব্যাপার আপনি হাসলেন আবার কাদঁছেন?
-দেখছি,দেখেছি এই সবুজ বাংলায় ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতায় কারা ভোগ করছে…..ঐ যে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া পতাকা লাগানো এসি গাড়ীটিতে আরামে বীর দর্পে বসে আছে একাত্তের আসল ঘাতক নিজামী সে এখন এ দেশের শিল্পমন্ত্রী।আবারও ভিক্ষারীর হাসি এলো।কচি কাচাঁ স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের ঘামে ভেজা যেন শহীদের রক্তকেও হার মানায় সেই উত্তরসরীদের তোমরা কি শিক্ষা দিচ্ছো একজন দাগী রাজাকার আজ দেশপ্রেমিকের ন্যায় নিরাপত্তার পতাকার তলে আশ্রয় দিয়েছ।এর চেয়ে বড় পরাজয় আমাদের আর কি হতে পারে…বলো।
-আপনি কি মুক্তিযোদ্ধা?
-কি ভাবে বলব,আমার যে সেই কাগুজে সার্টিফিকেট খানি নেই।
ভিক্ষারীর চোখে পানি এসে যায় এক হাতে লাঠিতে ভর দিয়ে অন্য হাতে চোখের জল মুছে…দাও দাও আমার ভিক্ষাটা দাও।

সূর্য্য পকেট থেকে একটি নোট বের করে ভিক্ষুকটির হাতে দিলে সে জয় বাংলা বলতে বলতে প্রস্হান নেন।সূর্য্যের সামনে দিকে এগিয়ে জাতীয় কুচকাওয়াজ দেখার ইচ্ছে আর নেই, ভিক্ষারীর তিক্ত সরল উক্তি তাকে সেখানে যেতে নিরাশ করল।ঘামে একাকার পড়নে তার সাদা পাঞ্জাবীটি, হাতে রাখা শহীদদের স্বরণে উৎসর্গিত ফুলটিও নেতিয়ে পড়েছে, যেন সব কিছুই ফ্যাকাসে অসার সব কেমন যেন উলোট পালোট চলছে।
একটু বিশ্রাম হলে মন্দ নয় কিন্তু কোথায় খুজঁবেন শীতল ছায়া একটু পাশেই একটি বাউন্ডারীতে ছোট্র একটি বটবৃক্ষের নীচে ছোট্র একটা টংয়ের চায়ের দোকান সেখানে একটু ছায়া দেখা যায় দোকান এরিয়ার তিন ভাগের এক ভাগ,ভাগ্যিস সেই সময় সেখানে লোকজন নেই তাই সেখানে একটু আরাম করেই বসলেন সূর্য্য পেশায় এক জন দৈনিক পত্রিকার স্টাফ সিনিয়র রিপোর্টার সাথে ছোট্র একটি কুটির শিল্প, প্রায় লোকজনকে সে আকৃষ্ট করতে গিয়ে বলত কুঠির শিল্প নাকি আমাদের বাঙ্গালীদের অস্তিস্হ ঐতিহয্য।এখনও সে কোন ঘর বাধেননি পঞ্চাশর্ধো বৃদ্ধ মা কে নিয়েই বেশ চলছিল তাদের জীবন।

265010_469206049781821_1580853200_nঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির একটি পোষ্টার চোখে পড়ে সূর্য্যে ভাবনায় মগ্ন হায়রে বাংলার অভাগী মা, তোমাদের এ ঋণ শোধ করব কি ভাবে আমাদের এই নতুন প্রজম্মরা।আমাদের শত্রু,আমরাই দুধ কলা দিয়ে পুষে আমরাইতো পরোক্ষ ভাবে তাদের অন্যায়ের ভার কাধে তুলে নিয়েছি।চায়ের কাপে চুমোক দিয়ে এক চুমোকেই পাচঁ টাকা শেষ তার উপর লিগারের লেশ নেই কাপের তলায় রয়ে যায় অগলিত দুধ চিনি....এরই নাম বাংলাদেশ ভাবনার গভীরতা নেই কোন কিছুতেই, ধরো মারো ছাড়ো অবস্হা।

নাহঃ আজ আর মন ভালো নেই সূর্য্যের।যখন সূর্য্যের মন খারাপ হয় তখন সে ঘন্টা খানিক  কারো সাথেই কোন রকম কথা বলেন না এমন কি মায়ের সাথেও।মা রোজী ছেলেকে গর্ভে নিয়ে ইন্ডিয়ায় আশ্রয় নেয় দেশ স্বাধীন হবার পর বাবা কেরামত মাওলা মেয়েকে নিজ দেশে নিয়ে আসেন তার কয়েক দিনের মধ্যে বাবা মুক্তিযোদ্ধা কেরামত মাওলা নিখোজঁ হন।সেই যে নিখোজঁ আর আসেননি সে মরে কি বেচে কে কার খোজঁ রাখেন।বাঙ্গালী স্বাধীন দেশ পেয়ে পড়নের কাপড় যেন মাথায় তুলে দৌড়াচ্ছিল,কে কি দখল করবে কে কোন ক্ষমতায় যাবে, তাছাড়া তখনও কিছু মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র জমা দেননি রাষ্ট্রীয় ভান্ডারে আর অনবরত পাকদের রেখে যাওয়া এক এক গাড়ী বোঝাই অস্ত্র-সস্ত্র ভারতের অভিমুখে ছুটছিল।অবশ্য যুদ্ধে ভারতীয় অস্ত্রও ছিল।চারদিকে এক বিশৃংখলা পরিবেশ ছিল যুদ্ধ শেষ হলেও মানুষের মনে আতংক কমেনি।

রোজী যেন বাবাকে না পেয়ে ছোট শিশু সন্তান সূ্য্যকে নিয়ে মহা বিপদে পড়ল অবশেষে সাহার্য্যের হাত বাড়িয়ে দেন তার বাবার এক নিকটতম বন্ধু,সে স-পরিবারে ঢাকায় ছিল যুদ্ধের পর গ্রাম দেখতে এসে এতিম রোজী আর শিশুটির মায়ার বাধনে আটকে যান।ঢাকায় তার দশ বছর সংসারে কোন  সন্তানাদি ছিল না বলে সূর্য্যকে নিজের সন্তানের মতন উচ্চ শিক্ষিত হিসাবে গড়ে তুলেন কথায় আছে যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছেন।

মা রোজী ছেলের এমন ভাব সে বুঝতে পারেন বুঝতে পারেন বলেই মা ছেলের গোমরা মুখে ছেলের মাথায় হাত রাখতেই যেন সূর্য্যের মনে সকল কু-ভাবনাগুলো পালালো দল বেধে।

-কি রে এখন কেমন লাগছে?

সূর্য্যে মায়ের কুলে মাথা রেখে মাকে কিছু প্রশ্ন করে।

-মা,তোমার হাতের স্পর্শে কি যাদু আছে!

-কে নো বলতো?

-এতক্ষণ আমার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা ছিল যেই তুমি ছুয়ে দিলে ওরা পালালো।

মা মুচকি হাসেন।

-নারে...আমার মতন জগতের সব মায়ের স্পর্শই ছেলে মেয়েদের জন্য প্রশান্তি এনে দেয়।

-ঠিক আছে...তবে আর একটা পশ্ন...স্বাধীনতার যুদ্ধে আমরা কি পেলাম?

-একটি স্বাধীন দেশ, একটি স্বাধীন পতাকা....একটি নতুন রাষ্ট্র হিসাবে বিস্ব মানচিত্রে স্হান পাওয়া।

-শুধুই কি এর জন্য ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত দান!নাকি আরো কিছু আছে যা পাবার জন্য আবারও যুদ্ধ করতে হবে?

ছেলের যখন এমন উল্টো সিধে কথা উঠে তখন প্রতিবারই মা পাশ কেটে অন্য কথায় চলে যান।এবার তা পারেননি ছেলের আবারও প্রশ্ন।

42331-জানি মা তুমি কোন উত্তর দিতে পারবে না এর উত্তর আমাদেরই খুজে বের করতে।যেমনটি করেছিলাম 'নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতনের গণ আন্দোলন করেছিলাম সকল অপশক্তির সাথে ঘরোয়া যুদ্ধ।পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জয় লাভ করেন তারা সরকার গঠন করেন। ১৯৯৩ সালে সর্বপ্রথম জামায়াত এবং তারপর আওয়ামী লীগ সংসদ সচিবালয়ে পরবর্তী নির্বাচনগুলোকে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য তত্বাবধাক সরকার বিল পেশ করে। অথচ তৎকালীন খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার এই দাবি মেনে নেয় নি। কমনওয়েলথ ও অন্যান্য সংস্থা সরকার ও বিরোধীদলগুলোর সাথে সমঝোতার চেষ্ঠা করে ব্যার্থ হন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সহিংস ঘটনার মধ্যে এবং বিরোধীদল আমাদের প্রবল প্রতিবাদ ও দফা দফায় আন্দোলনে নির্বাচন বর্জনের পরও ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে কতগুলো সাধারন জনতার ঘামে ভেজা অর্জিত অর্থের অপচয় ঘটায়। ২৪, ২৫২৬ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দলের আহ্বানে দেশব্যাপী অসহযোগ পালিত হয়৷ ৩ মার্চ জাতির উদ্দেশে ভাষণে খালেদা জিয়া ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল আনার ঘোষণা দেন৷

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে ৩০ মার্চ রাষ্ট্রপতি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয় এবং খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন৷ রাষ্ট্রপতি সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করেন৷ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভোটের বড় ব্যাবধানে নির্বাচীত হয়ে সরকার গঠন করেন।তারপর যা হবার তাই কিছু দিন ঠিক ঠাক মতন তারপর শুরু হয় সাইন বোর্ড পাল্টানো আর ভূখো কুকুরদের আহার সংগ্রহে সংগ্রাম গুণোধর রাজনিতীবিদদের।

মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে সূর্য্য হাফিয়ে উঠেন---

-এত ত্যাগ তিথিক্ষার পরও যদি নিজেকে স্বাধীন মনে করতে না পারি তবে এর চেয়ে দূর্ভাগা জাতী আর কে হতে পারেন।

-আমি জানি সবই জানি, আমি '৬৯,'৭১,'৯০ সবই দেখেছি,কষ্ট আর শোককে বুকে চেপে এখনও আশার প্রদীপ জ্বেলে রেখেছি এক দিন এই জাতী এই তোমরাই সকল অন্যায় অত্যাচার আর যুদ্ধাপরাধীদের বিপক্ষে রুখে দাড়াবে।

সহযোগিতায়:উইকিপিয়া এবং অনলাইন।

প্রজম্মের ঋণ শোধ০৩

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ