আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও! শ্রদ্ধেয় ব্লগার নাসির সারওয়ার ভাইয়ের লেখা এমন অদ্ভুত আদুরেপনা ডায়লগটি তৌহিদ গত দু'দিন থেকে নিজের মনে আউড়িয়ে যাচ্ছে। তার নাকি এই বাক্যটি খুব মনে ধরেছে এবং সে সময়ে অসময়ে এটিকে তসবি গোনার মত মুখে জপছে। আমি যতই বিরক্তিভাব নিয়ে তার দিকে তাকাইনা কেন সে যে বিষয়টিকে উপভোগ করছে তা বলাই বাহুল্য।

বললাম ঢং! এসব ভীমরতি বাদ দেন। সিনেমা দেখতে যাবার কথা সেটা কি ভুলে গেছেন? নাকি আজ আবারো বলবেন- আমার বড্ড ক্লান্ত লাগছে! একথা শুনে তার গতানুগতিক একই উত্তর - আরে নাহ! কি যে বলো। হোম মিনিস্টারকে চেতিয়ে তার মুড অফ করতে চাইনা। এখন সিনেপ্লেক্সে যে সিনামাই চলছে সেটাই দেখবো চলো।

বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্স এ আসার পরে লিফটে পা রাখতেই সাবিনা আপু এবং বন্যা লিপি আপুর সাথে দেখা। হঠাৎ দেখা হওয়াতে সবাই সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। তারপরে একসাথে ফিক করে হেসে দিলাম আমরা সবাই। সাবিনা আপুতো আমাদের দেখে মহা খুশি! বন্যা আপুকে দেখার ইচ্ছেটাও এতদিনে পূরণ হলো আমার। আপুরা দু'জনেই নাকি সিনেমা দেখতে এসেছেন। সিনেমার নাম- বেদের মেয়ে জোসনা টু!

সাবিনা আপু একটি বিস্ময়কর তথ্য দিলেন। গোপন সূত্রে তিনি খবর পেয়েছেন- হেলাল ভাই, জিসান দাদা, ইঞ্জা ভাই এবং মমি ভাই প্ল্যান করে এই সিনেমা দেখতে আসছেন। তারা একা একা সিনেমা দেখার মজা নেবেন আর আমরা কি বাসায় ললিপপ খাবো?
বললাম, মোটেই না।

বন্যা আপু বললেন- সবাই মিলেই না হয় দেখতাম, তারা আমাদের ফাঁকি দিয়েছেন কেন? তাই পিছু নিয়ে এসেছি, চলেন আজ তাদের ধরতেই হবে। নিশ্চই এটি মজার একটি সিনেমা। এই সিনেমা আজ দেখতেই হবে, সিনিয়র ব্লগারদের সাথে সিনেমা দেখাটা কিছুতেই মিস করা যাবেনা।

সিনেমা শুরু হতে তখনো দেরী আছে কিছুটা। বললাম চলুন আপুরা আগে পেটপুজা করে মাথা ঠাণ্ডা করি। ফুডকোর্টে এসে দেখি রেহানা আপু এবং দুলাভাই দু'জনে পাশাপাশি বসে কফির চুমুকে চুমুকে গুটুরমুটুর ফিসফাস কানাকানির মাখামাখিতে গল্প করছিলেন। এনাদের দেখলেই বোঝা যায় দাম্পত্য প্রেম কত মধুর!

রেহানা আপু আর দুলাভাই মধুর হাসি দিয়ে আমাদেরকে তাদের টেবিলে আমন্ত্রণ জানালেন। দুলাভাইয়ের শত আপত্তিকে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে তৌহিদ খাবারের বিল পরিশোধ করে দিলো। কথায় কথায় জানাগেলো দুলাভাই আপু এনারাও বেদের মেয়ে জোসনা টু দেখতে এসেছেন। আচ্ছা সবাই কি বুদ্ধি করেই এসেছেন নাকি?

আমরা সিনেপ্লেক্সের দরজার কাছে এসে দেখি ক্যাপ মাথায় হেলাল ভাইয়া, জিসান দাদা এবং ইঞ্জা ভাই সবাই মমি ভাইয়ের অপেক্ষা করছেন। আমাদের দেখে হকচকিয়ে ইঞ্জা ভাই জিজ্ঞেস করলেন- আপু আপনারাও কি সিনেমা দেখতে এসেছেন?

সাবিনা আপু বললেন- না ইঞ্জা ভাই, আমরা এখানে আপনাদের পিছু পিছু ক্রিকেট খেলতে এসেছি। জিসান দাদা বললেন দেখলেনতো! আমি আগেই বলেছিলাম এই খবর গোপন থাকবেনা, ঠিকই প্রকাশ হবে।

হেলাল ভাই গুরুগম্ভীর মানুষ। সিনেপ্লেক্সের দেয়ালে বেদের মেয়ে জোসনার লাইটিং পোষ্টার তার চোখে পড়লো। নায়ক ট্রাম্পেট হাতে বেদের স্টাইলে বীণ বাজাচ্ছে আর নায়িকার মাথায় এলইডি বাল্বের মত উজ্জ্বল সাপের মণি টাইপ কিছু একটা শোভা পাচ্ছে। পোষ্টারে নাগিনীর এমন রুপ দেখে হেলাল ভাই কবিতার ছন্দে বলে উঠলেন-

"মস্তকে মণিধারী ডিজিটাল জোসনা
বনলতা নয় সে বিষধারী নাগিনা ..."

মহারাজ কবিতা ছাড়েন, আগে বলেন এই সিনেমার কথা আমাদের জানাননি কেন? তৌহিদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতেই সাবিনা আপু বললেন- থাক আপনাকে আর সাফাই গাইতে হবেনা তৌহিদ ভাই। নিজেরা নিজেরা আপনারা ঠিক। আপনিও জানতেন এনারা সিনেমা দেখতে আসবেন তাইনা?

সাবিনা আপুর এমন হম্বিতম্বিতে অসহায় ভাব নিয়ে আমাদের সবার জন্য টিকেট কিনলেন জিসান দাদা। ইঞ্জা ভাই কিনলেন পপকর্ণ আর চিপস। তবে তাকে চকলেট কিনতেও দেখলাম। নিশ্চই ভাবীর জন্য! রেহানা আপু এবং দুলাভাই এসব কান্ড দেখে যে মজাই পাচ্ছিলেন তাদের হাসিতেই বোঝা গেলো।

সিনেমা শুরু হয়েছে অথচ মমি ভাই নাকি জ্যামের কারনে আটকা পড়েছেন রাস্তায়! এসবের মাঝখানে বন্যা আপুর ফোন বেজে উঠতেই বিরক্তিভাব নিয়ে তিনি কাকে যেনো বললেন- যা রান্না করা আছে তাই খাও। আমি আর সাবিনা সবার সাথে সিনেমা দেখে ফিরবো একথা বলে সিনেমার দিকে নজর দিলেন।

সিনেমায় কোটিপতি চৌধুরীর ছেলে নায়ক ফরহাদকে জঙ্গলে বেদের মেয়ে জোসনা সাপে কাটার হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে এক চুটকিতেই তাদের মন দেয়া নেয়া হয়ে যায়। কিন্তু বাঁধ সেজেছে চৌধুরী। অন্যদিকে নায়কের প্রতিপক্ষ হচ্ছে জোসনার বাবা বেদে সর্দারের ডানহাত ভবিষ্যৎ কাবিলা প্রধান গালকাটা ম্যাক্স ভাই।

গাল কাটা ম্যাক্স বলছে- জোসনা তুই শুধু আমার! আজ তোকে আমার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবেনা। হি হি হি হা হআআ হা..

জোসনা- শয়তান! এই জীবন থাকতে তুই আমাকে কোনদিনও পাবিনা। তোর সব কথা আমি পিতাজিকে বলে দেবো।

চৌধুরী- জোসনা তুমি সামান্য বেদের মেয়ে হয়ে চৌধুরী পরিবারের বউ হবার স্বপ্ন দেখছো! তুমি জানো তোমাদের মতো বেদের মেয়েদেরকে আমি এক চুটকীতেই নাগিন ড্যান্স দেয়াতে পারি?

বেদে সর্দার- চৌধুরী সাহেব, আমরা বেদে হতে পারি কিন্তু লোভী নই। টাকার নেশায় আপনি অন্ধ হয়ে গিয়েছেন। মনে রাখবেন আমরা বিষাক্ত নাগ নিয়ে খেলা করি। বিষের আগুনে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবেন। আর সে আগুন নেভানোর শক্তি আপনার নেই!

ইতিমধ্যেই সিনেমা জমে উঠেছে। সবার মনোযোগ বিশাল পর্দার দিকে। হঠাৎ সিনেমাহলের দরজা খুলে যাওয়ায় দর্শকদের অনেকেই বিরক্তিভাব নিয়ে সেদিকে তাকাচ্ছে- কে এলো! দেখি লেট লতিফের মতো মমি ভাই অন্ধকারে হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে টিকেট চেকারের সাথে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন।

মমিভাই সিটে বসতেই কে যেনো উরে মা! বলে চিৎকার করে উঠলো। কি হলো! কি হলো! মমি ভাই ভুল করে নিজের সিটে না বসে কার যেনো কোলে বসে পড়েছেন। মমি ভাই যতই বলছেন স্যরি! স্যরি! ততই আমাদের কানে অন্যজনের বাংলিশ টাইপ কিছু উদ্ভট খিস্তি ভেসে আসছে। ভোলাভালা মমি ভাইয়ের মনের অবস্থা চিন্তা করে আমি আর সাবিনা আপুর হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরলো।

নায়ক- আমার বাবার কথায় তুমি কিছু মনে করোনা জোসনা। আমি চাইনা বাবার টাকা। আমি তোমাকে চাই জোসনা, শুধু তোমাকে চাই।

তবে নায়িকার শর্ত একটাই, নায়ককে তিন মাসের মধ্যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। জোসনা! পৃথিবীর কোন শক্তি আমাদের আলাদা করতে পারবেনা। ফরহাদ! জোসনা! ফরহাদ! জোসনা! এসব ডায়লগ কানে আসতেই গান শুরু হলো -

"বেদের মেয়ে জোসনা আমায় প্রমিজ করেছে
ফেসবুকেতে প্রেম দেখাইয়া ফাঁকি দিয়েছে..."

গান শুনে কে যেন শিটি বাজালো। দর্শকের হাততালি সেই সাথে সিনেমার মধ্যবিরতি শেষে কিছুক্ষণ পরে আবার সিনেমা শুরু হতেই দেখাগেলো নায়ককে তার বাবা চৌধুরী সাহেব বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন। নায়ক নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য নায়িকার মামাতো বোন এঞ্জেল জড়িনার সাহায্যে এখন সাপের খেলা দেখানোর লক্ষ্য নিয়ে সাপদের পোষ মানানো শিখছে। যার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে বীণ বাজানোর ব্যর্থ প্রয়াস নায়কের।

এদিকে সাপ কিছুতেই পোষ মানছেনা। নায়ক যখনই ট্রাম্পেটে ফুঁ দেয় তখন বীণের সুরের বদলে ভোঁ ও ও ও করে আওয়াজ বেরোতে থাকে। নায়কের এই অন্তপ্রাণ চেষ্টা দেখে জড়িনা বিগলিত হয়ে নিজেও দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে নায়কের প্রেমে পড়ে যায়। হঠাৎ জরিনার মনে হয়- এতো পাপ! ঘোর অন্যায়! তার বোন জোসনাও যে ভালোবাসে ফরহাদকে।

বিবেকের দংশনে এঞ্জেল জড়িনা সিদ্ধান্ত নেয় যেভাবেই হোক নায়ককে সে তার মনের মানুষের সাথে মিলিয়ে দেবে। একসময় তিন মাসের মধ্যে নায়ক লাখপতির তালিকায় নিজের নাম উঠাতে সক্ষম হয়। পূর্বের দেয়া কথামতো জোসনাকে বিয়ে করে নায়ক চৌধুরী সাহেবের সামনে আসতেই দোনলা বন্দুক নয়, পকেট থেকে চাইনিজ পিস্তল বের করে চিৎকার করে বলে- জোসনা আজই তোর শেষ দিন!

আচমকা চৌধুরী দেখতে পায় একটা সাপ তার পায়ের কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিচ্ছু সাপটি চৌধুরীকে ফস্ করে ছোবল মারে! ভয়ে কান্ডজ্ঞান লোপ পেয়ে চৌধুরী গুলি করে বসে। পিস্তলের নিশানা ছুটে গিয়ে ফরহাদের বুক রক্তাক্ত করার মুহূর্তেই এঞ্জেল জড়িনা তার গোপন প্রেমিক ফরহাদকে বাঁচাতে ফরহা আ আ আ দ! বলে চিৎকার দিয়ে গুলিটিকে নিজের বুকে পেতে নেয়।

মৃত্যুপথযাত্রী শ্বশুরকে বাঁচাতে শরীর থেকে বিষ নামাতে সিদ্ধহস্ত ডিজিটাল নায়িকা জোসনা মুখ দিয়ে নয় সবাইকে অবাক করে সাকসেশন পাম্প দিয়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে চৌধুরীর পা থেকে সাপের বিষ টেনে বের করে চৌধুরীকে নতুন জীবন দান করে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে চৌধুরী জোসনাকে বুকে টেনে নেয়।

গালকাটা ম্যাক্স সেখানে পৌঁছালে ম্যাক্সের সাথে নায়কের মারমার কাটকাট এবং অনেক নাটকীয়তার পরে ম্যাক্স তার ভুল বুঝতে পারে। গালকাটা ম্যাক্সকে জোসনার বাবা নতুন কাবিলা সর্দার ঘোষণা করে। অতঃপর তারা সুখে শান্তিতে দিন পার করতে লাগলো। সিনেমা শেষে দর্শকরা সজোরে হাততালি দিতে থাকে।

আনন্দে আমিও জোরেশোরেই হাততালি দিচ্ছিলাম। পাশ থেকে তৌহিদ রাগান্বিত স্বরে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো ইশ! কি করছো! ঘুম ভেঙে গেলো আমার। চোখ খুলে পিটপিট করে তাকিয়ে দেখি স্বপ্নের ঘোরে এতক্ষণ তালি দেয়ার ছন্দে আসলে তার পিঠে কিল মারছিলাম। পিঠের অংশটুকু লাল হয়ে গিয়েছে!

রবিবারের #স্বপ্ন  দেরীতে হলেও নাকি ফলে! আহ! পিঠে কিল মারার এমন স্বপ্ন বাস্তবে রুপ নেবে অচিরেই একথা মনে আসতেই খুব হাসি পেলো। সে বেচারা আমার দিকে অসহায়ের মত তাকিয়ে আছে।

স্বপ্ন || ১৪ (ব্লগারদের সম্মিলিত গল্প)

0 Shares

১১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ