সে অনেকদিন আগের কথা।
নিউইয়র্কের ঈদগুলো ছিল অন্য প্রতিটি দিনের মতোই। রোজকার নিয়মেই ব্যস্ততম দিনের শুরু এবং শেষ হত। শুধু আমাদের কারো কারো দিনটি ভিন্ন হত। লেহেঙ্গা কিংবা সেলোয়ার-কামিজ পড়ে, সাজুগুজু করে বন্ধুদের বাসায় বেড়াতে যেতাম। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ভিনদেশী কেউ কেউ অবাক হয়ে দেখত। অস্বস্তি বোধ হত তখনই যখন কেউ কেউ জানতে চাইত, "তুমি কি ইন্ডিয়ান ? বলতাম, "আমি বাংলাদেশী"। তাঁরা বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইত, বাংলাদেশ কোথায় ? এটি কি ইন্ডিয়ায় ? কিংবা ইন্ডিয়ার পাশের কোন দেশ ? বলতাম, বাংলাদেশ এশিয়ার একটি দেশ, স্বাধীন সার্বভৌম দেশ।
সময় গড়িয়েছে অনেক।
এখন চাঁদ রাতে জ্যাকসন হাইটসে রাস্তার দু'ধারে মেহেদী উৎসব হয় রাতভর। গ্রোসারীগুলোতে ভিড়, জামাকাপড়ের দোকানগুলোতে ভিড়। সর্বত্র ঈদের আমেজ। ঈদের দিন নিউইয়র্কের এখানে ওখানে দলে দলে পাঞ্জাবি-পায়জামা, টুপি পরিহিত মানুষ জায়নামাজ হাতে ঈদের নামাজে যায়। মসজিদে স্থান সংকুলান হয় না বিধায় কোথাও কোথাও রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখে ঈদের নামাজ হয় দফায় দফায়। দিনব্যপী এখানে ওখানে দলে দলে শাড়ি, সেলোয়ার-কামিজ পরিহিতা নারীদের বেড়াতে যেতে দেখা যায়। সবচেয়ে বড় আনন্দের এবং স্বস্তিদায়ক বিষয়টি হচ্ছে, মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবের দিন দুটি'তে নিউইয়র্কের স্কুলগুলো বন্ধ থাকছে। যত্রতত্র পশু জবাইয়ের অনুমতি নেই, বিধায় নিউজার্সি, প্যানসিলভেনিয়া সহ একটু দূরের শহরে কিংবা ফার্মে গিয়ে অনেকেই কুরবানি দিয়ে থাকেন।
আজ কেনাকাটা শেষে বাড়ি ফিরবার সময়টাতে কেবলই আমার দেশে থাকাকালীন ঈদগুলো ভেসে উঠছিলো চোখের সামনে। খুব ছোটবেলার ঈদগুলো কেটেছে গ্রামে, দাদার বাড়ি। বড় হবার পর শহরেই। আর ইডেনে পড়ার সময় হোস্টেল থেকে ঈদে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি ছিল অন্যরকম এক অনুভূতি। খরচ বাঁচিয়ে নিউমার্কেট আর গাওসিয়া মার্কেট ঘুরে ঘুরে দর দাম করে কেনাকাটার অনুভূতি ভুলার নয়। এমন কি ঘরের কাজে সহায়তাকারী ছেলেটি কিংবা মেয়েটির জন্য নতুন জামা কেনাও বাদ যেতো না। অতঃপর ভিড় ভাট্টা ঠেলে চাঁদপুরগামী লঞ্চ "ঈগল" এ উঠা। ভেতরে তিল পরিমান জায়গা নেই, তবুও পুরোটা পথ কেবিনের বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাড়ি ফেরাও অপার আনন্দের ছিল। এতোসব ঝাক্কি পেরিয়ে লাগেজ টেনে বাড়ির কলাপ্সিবল গেটে পৌঁছে বেল দেয়া, আম্মা, আব্বার ছুটে আসা, কতো স্মৃতি ! আম্মার দৃষ্টি জুড়ে আকাশসম মায়া। আব্বার দৃষ্টিতে বিষাদের ছায়া। প্রশ্নের পর প্রশ্ন__ " পথে কষ্ট হয় নাই তো ? লাগেজগুলি কে চেঁচাইসে, তুই ? "
এখন নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে দীর্ঘ সময় চরকার মতন ঘুরতে ঘুরতে, জ্যাম ঠেলে গাড়ি পার্ক করি। দোকানে ভিড়ের মাঝে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে মাংস অর্ডার দেই। অতঃপর ঝাক্কি পেরিয়ে বাজারের ব্যাগ টেনেটুনে বাড়ির দরজায় পৌঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে একটু জিরিয়ে নেই। হেডফোনে বার কয়েক একই গান শুনি___ "স্বপ্ন টানে দিলাম পাড়ি, অচিন পথে আপন ছাড়ি... পেছন ফেলে উঠান বাড়ি, প্রিয়মুখ আর স্মৃতির সারি...... "
একজোড়া বিষণ্ণ চোখ সামনে এসে দাঁড়িয়ে অবিরত প্রশ্ন করে না__ " পথে কষ্ট হয় নাই তো ? এইগুলা কে চেঁচাইসে, তুই ? "
সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
১১টি মন্তব্য
লীলাবতী
ভীর ঠেলে, ভীরের মাঝে বাড়িতে আত্মীয়দের মাঝে ঈদ করার আনন্দের সাথে অন্য কিছুর তুলনা হয়না। একমাত্র বাংলাদেশ ব্যাতীত অন্য কোন দেশের মানুষ এই আনন্দ, আবেগ বুঝবেনা।
আপনাকেও ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক -{@
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। তবে এখন এই নিউইয়র্কের অবস্থা বদলেছে অনেক। বাংলাদেশি বেড়েছে। ঈদের দু’দিন আগেই বাঙ্গালি অধ্যুষিত জায়গাগুলোয় রাস্তায় জ্যাম লেগে থাকে। দোকানগুলোতেও প্রচুর ভিড় লেগে থাকে। ঈদ ঈদ আমেজ থাকে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
অসাধারণ স্মৃতিচারণে বাংলাদেশের চিত্র ফুটে উঠেছে।
রিমি রুম্মান
আপনাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা । -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক রিমি আপু।
একটা সময় আসে কেউ বলার থাকেনা আপু। সেদিন ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, এখানে সেটা কপি করে দিচ্ছি।
“জীবনের একটা সময়ে এসে কেউ এসব প্রশ্ন করেনা, “কি করছো?/কেমন আছো?/ঘুমাওনি কেন?/শরীর কেমন?” ইত্যাদি আবেগীয় প্রশ্ন——–তখনই বুঝে নিতে হয় কেয়ার করার আর কেউ নেই এ পৃথিবীতে। তাই যতোদিন পারা যায় এসব প্রশ্নের কাছে নিজের বিতৃষ্ণা না রেখে আবেগটুকু দিয়ে আগলে নেয়া উচিৎ।”
ভালো রেখে ভালো রাখো। -{@
রিমি রুম্মান
ঈদের শুভেচ্ছা নীলা’দি।
কিছুই থেমে নেই। আমরা ঈদ আনন্দ করছি। ঘুরছি, ফিরছি। কিন্তু অবচেতন মনেই সেইসব দিনগুলোয় হারিয়ে যাই।
ভাল থেকো ভালোবাসায়। -{@
ছাইরাছ হেলাল
না থেমে থাকা জীবনে এই অনিত্য আনন্দময় স্মৃতিটুকুই একমাত্র সম্বল।
ঈদের শুভেচ্ছা আপনাকেও।
রিমি রুম্মান
শুভেচ্ছা … -{@
ব্লগার সজীব
এমন স্মৃতিই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, আমাদের প্রেরণা যোগায়। বাবা মার শ্নেহের এমন প্রশ্ন বড় বেশি মনে থাকে, হাহাকার হলেও এমন স্মৃতি অত্যন্ত মধুর। লেখার সাথে গানটি সুন্দর মিলে গিয়েছে আপু। ঈদ মোবারক রুম্মনাপু -{@
রিমি রুম্মান
হ্যাঁ , গানটি যে কতবার শুনেছি, তার ইয়াত্তা নেই। শুনে শুনে হারিয়ে গিয়েছি নিজের ফেলে আসা দিনগুলোয় ।
শুভেচ্ছা… -{@
প্রজন্ম ৭১
শত কষ্টের পরেও আমরা ঈদে বাড়ি ফিরে যাই শিকড়ের টানে। (y)