বাঙালি বাবুদের প্রতি ডোমদের ক্ষোভ      

রামদাসের বাড়ির উঠান। রামদাসসহ ডোমপাড়ার কয়েকজন একসাথে গোল হয়ে বসে জুয়া খেলছে। সামনেই সান বাঁধানো বটগাছ তলায় একটা শিব মন্দির। সেখানে একটা শিব লিঙ্গ এবং ঘট আছে। কল্কি ঘুরে ঘুরে সিদ্ধি খাওয়া চলছে। রামদাসের ছোট্ট ছেলে গণেশ এস বাবা রামদাসের কাঁধে চড়ে বসে।

রামদাস: আস্তে কারকে ধর বেটা চোট লাগোতেতো। আজ স্কুলমে গারেহে বেটা?
গণেশ: না মাই বলেছ্ হামনিককে ছোটজাত হোলি। লেখাপড়া করকে কা হই। হামনিককে তো আর সাহেব না হকোব।
রামদাস: তোর মাই বলেছ্ আর তুই স্কুলমে না গয়ে। নাম শুয়োরকে বাচ্চা ঘাড়কে।

গণেশ তাড়াহুড়া করে বাপের ঘাড় থেকে নামে। রামদাস কষে এক চড় মারে। গণেশ মাথা নীচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

হরি: আহ্ তো খালি খালি বেটাঠোকে মারোত রে। ওকেরকা দোষ। আর বিমলা ভৌজি তো ঠিকই বলেবায়। হামনিককে তো ছোট জাত হোলি। সমাজমে হামনেককে কেউ দাম না দেল। হামসেককে লেইকা ফেইকা কার সাহেব হকোসোকি। চিন্তা করকে দেখ রামদাস, আট-দশগো আদমিকে এইসন হামনিককেও নাক বায়, আক বায়, মু বায়। সবকে এইসব হামনিককেও খুনকে রঙ লাল। সবকইকে হামনিককে আদমি এইসন ভাবোল। হামনিককে শালা ময়লা পরিষ্কার করোলি, লাশ কাটোলি। আর হামনিককে দেখেছে আদমি দূরছে হটোল।
কানাই: হারে শালা হামনিককে যদি কামনা করোলি তব তুনিককে রবে কেইছে? কোনো শালা লাশ কাটি, কোনো শালা ময়লা পরিস্কার করি? সারা দুনিয়া ময়লাছে ভরযায়ি। ই বাত কা কেউ একবারো চিন্তা কারকে দেখেবায়। শালা বাঙালি!
রামদাস: তুনিককে যাই বোল হামার বেটা দুনোকে হাম লেখাপড়া শিখায়েব, সাহেব বানায়েব। সাহেব লোকও আদমি হামনিককেও আদমি। উনিককে লেইকা ফেইকা লেখপড়া শিখে সখে ত হামনিককে লেইকা ফেইকা শিখেশখি। যো বেটা মাইকনে যো। গরুকে দুধ পানাকে রাখোবানি। যো বেটা।

গণেশ বাবার আদরে খুশি হয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে চলে যায়।

হরি: ভগমান হামনিককে ছোটকা জাত কারকে বানায়েবায়। শালাকে ভগবানও বাঙালি সাহেবকে দলমে রহল। ভগবানই যব আদমিকে বিতর এতনা আলাদা করদিয়েবায় তো সাহেব লোককে আর দোষ কা। হামনিককে ছোটকা জাত। কুত্তা বিলাই হকে জনম লিয়াবানি, কুত্তা বিলাই হকেই দুনিয়া ছোড়কে চালা যাইব্। এইঠো ত হামনিককে তদবির। আমাগো ছোটজাত কইরা বানাইছে।
রামদাস: তো নিককে এই ভাগ্য হাম না মানলি। জিন্দেঙ্গী ভর হামনেককা ছোটজাত রযায়েব। হামনেককে জাতকে কেউকা সাহেব না হই।
হরি: রামদাসকে  মাথা বিগড়গায়ে। আরো এক ছিলিম তামাকু বানাও। তামাকু পিয়ছে খাইলে  মাথা ঠাণ্ডা হোযায়ি।

সবাই হেসে ওঠে। হরি কেনো যেনো চুপসে যায়। কিছুক্ষু নিশ্চুপ থেকে হরি অকস্মাৎ হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে।

হরি: হামনিককে অবস্থা কা চিরদিন একই রকম রযায়ি। হামনিককে কোনোদিন বড়কা জাত হকেনা সকোব। হায়রে ভগমান  হামনিককে আদমি করকে বানায়বারো কিন্তু আদমিকে ইজ্জত কাহে না দিয়ো। শালাকে ভগমান, ভগমানো শালা বড় বড় জাতকে দলমে।
রামদাস: আহ্ হরি থাম ত। ঠাণ্ডা হ।

হরি কল্কিতে কষে মারে এক টান। কল্কি ঠাস্ করে ফুটে চৌচির হয়ে যায়। সে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে।

রামদাস: কাহা যাতেরে হরি?
হরি: আইজ মহাদেবকে মূর্তি তোড় দেব... তোড় দেব শিবকা লিঙ্গ... সব তোড় দেব, সব!

নিতাই ও রামদাস হরিকে থামায়।

নিতাই: ঠাণ্ডা হ হরি... ঠাণ্ডা হ...।

হরি: কা থিকে ঠাণ্ডা হকো। ঠাণ্ডা রকে হামনিককে কা লাভবায়? হামনিককে তো কেউ কেউকে কোনো ক্ষতি না করলি তবু বড়কা জাতকা আদমিকূল, ওই সাহেবকূল কাহে হামনিককে উপরে খিসিয়াওল, কাহে হামনিককে বঞ্চিৎ করোল, কাহে হামনিককে খাটনিককে ন্যায্য দাম না দেল। সব দুষ ওই ভগমানকে। কাহে জাতকে আদমি মুসলমান হোজাল  কিসের শান্ত হমু। ছোড় দে হামরেকে। ছোড় আজ শিবকে ঠাকুর আজ তুড় দেব। সব দুষ ওই ভগমানকে। আজ ভগমানকে উপ্রে হাম প্রতিশোধ লেব্। তুড় দেব্ শিবকে লিঙ্গ।

সবাই হরিকে জাপটে ধরে থামায়। কানাই চিৎকার করে উঠে।

কানাই: হরি অধরম করিয়ে মত। ভগমানকে উপড়ে কাহে খিসিয়ায়োতেরে। ভগমানই হামনেকে শেষ ঠিকানা হ। ভগমান যদি হামনিককে না দেখে তাইলে কাহা যাইবে। ঠাণ্ডা হ...।

হরি শান্ত হয়। রামদাসকে জড়িয়ে ধরে হু হু কাঁদে।

হরি: রামদা ভগবান এতনা পাষণ্ড কাহে। হামনিককে ভগমান কেনে কা অপরাধ করেবানি, যে হামনিককে জাতগুষ্ঠিকে ছোটক জাতকে যন্ত্রণালেকে বাঁচকে রহেহই। ভগমান কাহে হামনিককে জাতঠোকে এক্কেবারে ধ্বংস কাহেনা করদেল। কাহে হামনিককে বাঁচাকে রক্কে কষ্ট দেল্। ইঠো ভগমানকে কেইসন খেলা।

রামু: এই খাতির শালা বাঙালিকে গরু বিষ দেকে র্মালি। শালাকুল হামনিককে খাটনিকে ঠিকছে দাম না দেল। হামনিককে লেকে তামাসা করোল। কাল রাতিকে মনকে ঝাল মিটায়া খাতির হারিস মন্ডলকে...।
কৃষ্ণা: থামে কাহে। হিয়া কেউ বাঙালি নেইখে। সবকই হামনিককে জাতমে আদমি। মন খুলকে বোল।
রামু: কাল রাতিকে হারিস মন্ডলকে গরুকে হাম আর কৃষ্ণা চিমল  খিয়াকে মারেবানি। একের পর মরা গরুকে লেকে ভাগাড়মে বিগ দিয়া বলেছ্। হামনিককে ভাগাড়মে গরু লেকে চাম ছিলোকে বেচদিয়া। এ দেখ নগদ ৩০০ রূপিয়া।
কৃষ্ণা: কারে তর হাতমে দেখোতিন ১০০ রূপিয়া। কাহে দুপুরমে যে বিদেশী দারু পিয়ে ওগা ভুলে গয়ে।
রামু: ও হ তাইতো...।

হরি আবার কাঁদে। হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে রামদাসের বড় ছেলে পার্থ হাজির হয়। রামদাস দৌড়ে উঠে যায়। সবাই হতভম্ব হয়ে পার্থর দিকে তাকিয়ে থাকে।

রামদাস: কাভায় বেটা!
পার্থ: বাবা আইজ হামরেকে হেডস্যার ইস্কুলছে নিকল দিয়া বায়।
হরি : কাহে ইস্কুলকা হেডস্যারকা বাপকে হ। এ ইস্কুল জমিদার নিখিল বাবু বানাকে গিয়া। হেডস্যার বলেছেইভা।
রামদাস: হেডস্যার কাহে তোরকে ইস্কুলমে যায়া খাতির মানা কারেবায় বেটা? তেকা কোনো অন্যায় করে বায়?

পার্থ চুপ করে থাকে কোনো কথা বলে না।

হরি: কারে চুপ করকে কাহেবারে। বাত বোল।

পার্থ কেঁদে ফেলে। রামদাস ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে।

রামদাস: আজ হাম হেডস্যারকে খুনছে নিহায়েব। জিন্দোগী ভর মরা কাটেবানি আজ জিন্দা জিন্দা আদতি কাটোব। বোল কা ভায়?
পার্থ: হেডস্যার আজ কেলাসমে আকে সবকে ঘোড়াকে ইংলিশ পুছেবায়। যে নিককে সখে নেইখে উনিক সবকইকে হাইবেঞ্চকে উপ্রে খাড়ায় বোলেবায়। হাম সকোলি এ খাতির বৈঠারিহা।
হরি: একের পর।
পার্থ: হেডস্যার হামরেকে বলেছ্ কারে তে কাহে বৈঠাবারে? হাম বোলা, স্যার হাম ঘোড়াকে ইংলিশ সকলি হর্স। আমারে কইলো, হর্স মানে ঘোড়া। হেডস্যার বলেছ্ বৈঠ।
হরি: সাবাস! একের পর।
পার্থ: একের পর হেডস্যার এগো কঞ্চিকে বেত দেকে সবকে পিটানি শুরু করেছ্। মারকে চোটে হামনিককে ইংলিশ সারকে লেকা সতীশ ছড়ছড় করকে মুত দিয়েছ্। হেডস্যার পিটওয়া বন করকে হামরেকে সতীশকে মুত সাফ করে বলেছ্। হাম রাজি না হই। বোলা হামার বাপ হামরেকে ইকাম করে খাতির মান করেবায়।
রামদাস: একের পর?
পার্থ: হেডস্যার তব হামরেকে বলেছ্ এতনা বড়কা সাহস, ছোটকা জাতকে মুখে বড়কা বড়কা বাত। আরে তর বাপ-দাদা চৌদ্দগুষ্ঠি ইকাম করোল। তে আবার নবাব কবহকে?  যো স্কুলছে নিকোল যো। কালছে তোরকে জানি আর ইস্কুলমে না দেখলি।

রামদাস হরিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।

রামদাস: হরি! হাম কা করোব। হামনিককে ই ছোটকা জাতকে এ কলঙ্কা কোনোদিন না যায়ি। হামনিককে কা জিন্দেগীভর ছোটকা জাত রযায়েব। হামনিককে লেইকা ফেইকা কোনো দিন কা শিক্ষিত না হই? সাহেব না হই?

হরি: রুয়ো মত্ রামদা। পার্থকে অফমান হামনিকনে জাতকে অফমান। ই অফমান হামনিককে না মানোব। একের উচিত জবাব দিয়োহই।

হরি দৌড়ে গিয়ে গিয়ে বেড়ায় গোঁজা চাপাতিটি টান দিয়ে হাতে নেয়। এই প্রথম ডোমপাড়ার ছোটজাতের মানুষেরা বিদ্রোহে ফেটে পড়ে। হরি চাপাতিটি হাতে নিতেই ডোমপাড়ার অবহেলিত মানুষগুলি নেশায় বুদ হয়ে মানুষের রক্তে প্রতিশোধ নিতে চায়। টগবগ করে ওঠে রক্ত প্রতিশোধের নেশায়।

হরি: চলতো সককোই। এইছে হামনিককে মরকে বানি হামনিককে আর মরেকে ডরকা। মরকোও ইজ্জতবায় হামনিককে ইজ্জতও নেইখে। চলতো সককোই আজ ইস্কুল ঘেরাও দেব্।

(...............................................চলবে)

 

আগের পর্বগুলোর লিংক:

১. http://www.sonelablog.com/archives/12440

২. http://www.sonelablog.com/archives/12475

৩. http://www.sonelablog.com/archives/12531

৪. http://www.sonelablog.com/archives/12788

৫. http://www.sonelablog.com/archives/12859

৬. http://www.sonelablog.com/archives/12944

0 Shares

৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ