যমুনার পাড়ের দূরবর্তী কোল ঘেষে ধূ ধূ মাঠে শ্মশান। চারিদিকে কোনো জনবসতি নেই। শ্মশানের মাঝে একটা প্রাচীন পাকুড় গাছ বৃহৎ ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে একা। পাশেই বহমান প্রমত্ত যমুনা। পাকুড়  গাছটির ডানে পুরোনো শিবমন্দির। মন্দিরের বামে অনতিদূরে একটা ছোট্ট নিঃসঙ্গ শনের ঘর। জনবসতির সাথে সে ঘরের কোনো সংশ্রব নেই। সে শনের ঘরে একা বাস করে রমেশ চণ্ডাল। সারাদিন-রাত গাঁজার নেশায় পড়ে হয়ে থাকে। প্রতিদিন দাহ করা মরদেহ তার প্রতিদিনের সঞ্চিত এক একটি নতুন অভিজ্ঞতা। কোনো মরা স্বাভাবিক, কোনোটা অস্বাভাবিক বীভৎস। জীবনের শুরু থেকে কতো জাতের-অজাতের মরা সে ভস্ম  করেছে তার হিসেব রমেশ চণ্ডালের মনে নেই। রাতে ঘরের উঠানে ঊনুনের পাশে মাঝে মাঝে বহু বছর আগের দাহ করা আত্মারা ভীড় করে। সেখানে বসে সে নেশার ঘোরে বহুদূর অতীতের সে সব আত্মাদের সাথে গল্পে মশগুল হয়ে ওঠে। কুতুবপুর বাজারের চায়ের দোকানে বসে মাঝে মধ্যেই  সে লোকজনের সাথে এমন গল্প ফেঁদে বসে। তাই কুতুবপুর বাজারের সাধারণ মানুষের কাছে রমেশ চণ্ডাল আদি ভৌতিক। তাই সন্ধ্যা লাগার আগেই বাজারে আসা মানুষ রমেশকে এড়িয়ে চলে কিংবা তাকে দেখলেই পালিয়ে যায়।

হরি বোল মুখে নিয়ে শ্মশান বন্ধুদের সাথে নিয়ে নারাছু ডোমের মরদেহ শ্মশানে এসে পৌঁছায়। মানুষের দেহের সমান মাপের আয়তক্ষেত্রের চারদিকে চারটি লোহার শিক মাটিতে গাড়ে রমেশ, তারপর রমেশ চণ্ডালসহ সব শ্মশান বন্ধুরা মিলে আম কাঠের লাকড়ি দিয়ে পরপারের চিরনিদ্রার বিছানা বানায়, তার উপর দিয়ে আবার একস্তর লাকড়ি দিয়ে শুধু মুখের জায়গাটুকু খালি রাখা হয়। নারাছু ডোম নিঃসন্তান ছিলো। স্ত্রী বিয়োগের পর রাম্বাকে বিয়ে না করা অবধি জীবনের এতোগুলো দিন ডোমপাড়ার নারী আর দাসী-বাদীদের সাথে বন্ধনহীন নানান সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে কেটে গেছে তার সুদীর্ঘ জীবন। তাছাড়া মুখাগ্নি করার মতো এই দুনিয়ায় তার অবশিষ্ট আর কেউই বেঁচে নেই। নারাছু ডোমকে মন্দিরের পাশে একটা নলখাগড়া দিয়ে ঘেরা জায়গায় ব্রাহ্মণ পুরোহিত গোসল করায়। তারপর তাকে শাদা কাপড়ে ঢেকে চিতার বিছানায় শোয়ানো হয়। ধনী কিন্তু অভিজাত নয় বলে প্রচুর কেরোসিন ছিটানো হয় লাকড়ি আর নারাছু ডোমের মৃতদেহে।

এরই মধ্যে ডোমপাড়ায় খবর রটে যায় রাম্বার সতীদাহ হবে। সেই খবর শুনে রামদাসের বউসহ ডোমপাড়ার সব বিবাহিত স্বাস্থ্যবতী তামাটে ডোম নারীরা সাজুগুজু করে উলুধ্বনি দিতে দিতে শ্মশানে হাজির হয়। তাদের ডালিতে রাখা ফুলের পাঁপড়ি রাম্বার গায়ে ছুড়ে দিতে থাকে। নারাছু ডোমের মুখাগ্নি করার মতো কেউ না থাকায় রাম্বার উপর মুখাগ্নি করার ভার পড়ে। শ্রীপদ রাম্বাকে আদেশ করে, ‘রাম্বা তোহার আদমি নারাছু ডোমকে মুখে আগ দে।’ রাম্বার কপাল আর সিঁথির সিঁদুর মৃত নারাছু ডোমের পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মুছে দেওয়া হয়। রাম্বার হাতের শাখা চাপাটি দিয়ে বারি মেরে ভেঙ্গে দিয়ে চিতায় নিক্ষেপ করে শ্রীপদ। এতোক্ষণ নিশ্চুপ রাম্বা হঠাৎ কি এক অজানা ব্যাথায় ক্ষণেক বিলাপের স্বরে কাঁদে। তবে কি সূর্যাই মৃত এ বিষয়ে সে নিশ্চিত হয়ে গেছে? নাকি মন্ত্র পাঠ করে বিয়ে করা পতি নারাছু ডোমের প্রতি মনের দরুণ গভীরে অগোচরেই নারীসুলভ কোনো কোমল মমতা জন্মেছিলো এই সনাতন ডোম নারীর? মন্দিরের ব্রাহ্মণ পুরোহিত পঞ্চভূতের  বন্ধনাপূর্বক রাম্বার হাতে একটা জ্বলন্ত চলা ধরিয়ে দেয়। রাম্বা নারাছু ডোমের মুখে অগ্নি স্পর্শ করানোর সাথে সাথে রমেশ চণ্ডালসহ সব শ্মশান বন্ধুরা চারদিক থেকে চিতায় আগুন দেয়। দাউদাউ করে জ্বলে আগুন। গায়ের চামড়া পুড়ে ঝলসে পায়ের গীরায় এসে জমা হয়। কিঞ্চিৎ ঘৃতাগ্নি করা হয় কয়েকবার। ধূপ, কর্পূর ছিটিয়ে দেয়া হয় কিছুক্ষণ পর পর। তবু পোড়া মানুষের মৃতদেহের উৎকট দূর্গন্ধ শ্মশানের বাতাস ভারী করে ফেলে। মদ্যপানে বেহুশ শ্মশান বন্ধুদের কণ্ঠে রোল ওঠে, ‘বলো হরি, হরি বোল!’

নারাছু ডোমের চিতা থেকে অনতিদূরে রাম্বাকে সহমরণের জন্য প্রস্তুত করা হয়। রাম্বাকে প্রচুর মদ্যপান করায় শ্রীপদ। ডোমপাড়ার পতিভক্ত নারীরা সতী হবার মঙ্গল বাসনায় রাম্বার কপালে, সিঁথিতে লেপ্টে থাকা অবশিষ্ট সিঁদুর মুছে নিয়ে নিজেদের সিঁথি এবং কপালে লেপন করে। রাম্বার শরীরে ফুলের পাঁপড়ির বৃষ্টি ঝরায় আর উলুধ্বনি করে। রাম্বা সহমরণে যাবার জন্য প্রস্তুত। শ্রীপদের পাথর চোয়াল থেকে ওহি নাজেল হয়, ‘রাম্বা তর আদমিকে সঙ্গে চিতামে চালা যাও। আদমি বলিয়ে শ্রীপদ ডোমকে বহিন রাম্বা সতী ও সাচ্চা রক্ষা করেবায়।’

(..................................................চলবে)

আগের পর্বগুলোর লিংক:

১. http://www.sonelablog.com/archives/12440

২. http://www.sonelablog.com/archives/12475

৩. http://www.sonelablog.com/archives/12531

৪. http://www.sonelablog.com/archives/12788

৫. http://www.sonelablog.com/archives/12859

৬. http://www.sonelablog.com/archives/12944

৭. http://www.sonelablog.com/archives/13003

৮. http://www.sonelablog.com/archives/13126

৯. http://www.sonelablog.com/archives/13269

১০. http://www.sonelablog.com/archives/13617

১১. http://www.sonelablog.com/archives/14926

১২. http://www.sonelablog.com/archives/17125

১৩. http://www.sonelablog.com/archives/17164

১৪. http://www.sonelablog.com/archives/17210

১৫. http://www.sonelablog.com/archives/17308

১৬. http://www.sonelablog.com/archives/17837       

১৭. http://www.sonelablog.com/archives/17968

১৮. http://www.sonelablog.com/archives/18263

১৯. http://www.sonelablog.com/archives/18396

২০. http://www.sonelablog.com/archives/18643

২১. http://www.sonelablog.com/archives/19993  

২২. http://www.sonelablog.com/archives/20171

0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ