সিদ্ধান্ত

সাবিনা ইয়াসমিন ৬ অক্টোবর ২০২০, মঙ্গলবার, ০৭:৩০:৩৫অপরাহ্ন গল্প ১৪ মন্তব্য

এক বোতল ইঁদুরের বিষ কেনার টাকা হাতে পেতেই মজিদ সাহেব দম নিলেন। হ্যা, এবার শুধু দোকানে গিয়ে কিনে নিলেই হবে। এই জীবন আর ভালো লাগছে না তার। অভাব-অনটনকে নিত্য সাথি করে কোনরকম চলে যাচ্ছিলো তার দিনগুলো। কিন্তু এখন আর সে অবস্থায়ও নেই। করোনা আসার পরে স্কুলের চাকরিটা গেছে। অনলাইনে পড়িয়ে দু'পয়সা রোজগারের আশাও নেই। নেট খরচার সাথে একটা ভালো মানের মোবাইল দরকার। তার সেসব যোগাড় করার সামর্থ নেই। ওসব তো দূরের কথা, দীর্ঘদিনের ব্যবহৃত বাটন ফোনটাও বিক্রি করে দিয়েছেন বহু আগে। কিভাবে কি করবে? সকালে বেরিয়েছিলেন স্ত্রীর সাথে খুব ঝগড়ার পর। ঘরে একমুঠো চাল নেই, বাচ্চারা সারারাত কিছুই খেতে পায়নি। নিজেও অভুক্ত ছিলেন, এরমধ্যে ঝগড়াঝাটি কার ভালো লাগে? সিদ্ধান্তটা তখনই নিয়েছেন, তিনি আত্মহত্যা করবেন।

গলায় ফাঁস দেয়ার ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছে অনেকক্ষণ।  নাহ, সব ভেবে এই পন্থা তার ভালো লাগলো না। গলায় ফাঁস দেয়া আত্মহত্যাকারী কে দেখতে খুব ভয়ংকর লাগে। এভাবে মরলে তার বাচ্চাদের ভয় লাগতে পারে। ভর দুপুরে গ্রামের কোন ঘেঁষা এক পরিত্যক্ত পুকুরের পাড়ে বসে বসে এটাই ভাবছিলেন।

পুকুরের চারপাশ ভরে আছে নানারকম জলজ গাছ-গাছালিতে। কতরকম শাক! এক সময় সে সব শাকের নামও ঠিকঠাক মতো জানতো না। স্কুলে পড়ানোর সুবাদে এখন ওগুলোর নাম সহ পুষ্টিগুণ সম্পর্কেও সব জেনে গেছেন। জেনেছেন হরেকরকম ঔষধি গাছ সম্পর্কেও। এইতো একটু আগে ওপাড়ার মোতালেব এর মায়ের বাতের ব্যাথা নামানোর জন্য মোতালেব যেই গাছটি খুঁজে পাচ্ছিল না, সেইতো তাকে খুঁজে দিলো! আর মোতালেব খুশি হয়ে তার হাতে  আস্ত একটা নোট রেখে গেলো। এটা দিয়ে সে খুব ভালো মানের বিষ কিনতে পারবে। বেলা গড়ালে মজিদ সাহেব হাটা দিলেন গ্রামের একমাত্র বাজারের দিকে।

আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত, আর উপায় কনফার্ম করার পর আজ সবকিছু অন্যরকম লাগছে তার কাছে। মাথার উপর ধুধু আকাশ, সবুজে ছাওয়া নিজের গ্রাম, এই মাটির গন্ধ সব যেনো তাকে পরম মমতায় বিদায় জানাচ্ছে। আজ তার বাবা-মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে, মরার আগে যদি মায়ের সাথে একবার দেখা হতো! অথবা ছোটবেলার মতো বাবার কড়ে আঙুল ধরে আরেকবার ঐ বাজারের গিয়ে ঘুরতে পারতো, তাহলে সে মরেও শান্তি পেতো।
“ ধুর, কি ভাবছি এসব?  মা বাবা জান্নাতে আছেন, আর আমি আত্মহত্যা করে চিরকাল নরকবাসী হতে যাচ্ছি। দেখা হবেনা, মাগো, বাবা তোমরা আমায় ক্ষমা করে দিও। মরন ছাড়া আমার আর কোনো পথ নেই,,

ঐতো রমিজ মিয়ার দোকান! তার দোকানে সব বিক্রি হয়। চাল, তেল,আলু, নুন, বিস্কুট, মশলাপাতি, গরুর দুধের চা সবই পাওয়া যায়। সাথে ইঁদুর মারার ওষুধ।

কড়া লিকার দিয়ে তৈরী গরুর দুধের চা অনেকবার খেয়েছে এখানে এসে।  প্রতিবারই চায়ের স্বাদটা মুখে লেগে থাকে অনেকক্ষণ। মরার আগে এককাপ চা অন্তত  খাওয়া উচিৎ ভেবে দোকানের বেঞ্চিতে বসে পড়লো।

আগুন গরম চায়ে ছোট ছোট চুমুক দিয়ে মনভরে দেখে নিচ্ছে চিরচেনা আশপাশ।

কি হবে যখন সবাই কাল সকালে তার আত্মহত্যার খবর পাবে?

সে দেখতে পায়, তার মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত গ্রামে। তার লাশ রাখা হয়েছে বাড়ির মধ্য-উঠোনে।

আত্মীয়/ অনাত্মীয়, পাড়া-পড়শীর ভীড়ে তার বাড়ির উঠোনে দাঁড়াবার মতো এক ইঞ্চি জায়গা খালি নেই। এসেছে দূর-দূরান্ত হতে অনেক মানুষ, এসেছে তার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা। তাদের মনে প্রশ্ন, চোখে সীমাহীন ঔৎসুক্য, কেন আত্মহত্যা করলো সদা শান্ত মজিদ স্যার? যিনি তার সন্তান সম শিক্ষার্থীদের আলোর পথ দেখাতেন, সেই তিনিই কেন নিজের মৃত্যুকে অন্ধকার করে দিলেন!

সে আরও দেখতে পায়, তার পুষ্টিহীন নাবালক ছেলেটা কাঁদছে, দিনের পর দিন ক্ষুধার কষ্ট বয়ে বেড়ানো ছেলেটি খুব জোরে চিৎকার করে কাঁদতে পারছে না।

তার কিশোরী মেয়েটি ভাইয়ের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ভাইটাকে বুকে জড়িয়ে তার কণ্ঠের আর্তনাদ সবার চোখ ভিজিয়ে দিচ্ছে।

মজিদ সাহেবের চোখ দুটো একজনকে খুঁজে বেড়ায়, সে এখানে নেই! যার জন্য সে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিলো, সে-ই তাকে এক নজর দেখতে আসছে না!

মজিদ সাহেব হঠাৎ শূন্যে ভেসে উঠে। পার্থিব দেহটা লাশবাহী খাটিয়ায় তেমনি পড়ে থাকে। তিনি ঘরের ভিতরে প্রবেশ করেন। তার স্ত্রীর চুল সহ সমস্ত শরীর ভেজা, মলিন জীর্ণ-ছিন্ন শাড়িটি লেপ্টে আছে তার শরীরে। ঘন-ঘন মূর্ছিত হয়ে পড়ছিলেন দেখে ঘরের অন্যান্য নারীরা তার গায়ে-মাথায় পানি ঢালছেন। মজিদ সাহেব এর এখন খুব মায়া হচ্ছে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে। কখনো একটা ভালো শাড়ি কিনে দিতে পারেনি, অলংকার কি জিনিস তার বউ কখনো জানতে পায়নি। একটা নাকফুল, হাতে দুগাছি পিতলের চুড়ি, এতটুকুই। আর কখনো কিছু দেয়া হয়নি তাকে।

উহু, দিয়েছে অভাব, আর কটুবাক্য। মজিদ আর সহ্য করতে পারে না। চুপচাপ খাটিয়ায় রাখা দেহের ভেতরে ঢুকে পড়ে।

এর মাঝে লাশ সৎকার করার তাড়া আসে। এলাকাবাসী বলাবলি করতে থাকে আত্মহত্যাকারীর নামাজের জানাজার ব্যাপারে। যদিও তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন, কিন্তু মরার সময়তো তিনি ধর্মীয় নিয়ম-নীতি মানেনি, তাহলে?

সব শেষে আসে লাশ দাফনের পালা। সাদা কাফনে মুড়ে তাকে আবার নেয়া হয় তার বাড়ির উঠোনে। এবার মজিদ সাহেব আর স্থির থাকতে পারেন না, তিনি কাঁদছেন। তার ইচ্ছে করছে সব ছুড়ে ফেলে নিজের  ঘরে গিয়ে ঘুমাতে। কিন্তু জীবিতদের ইচ্ছা তাকে কবরস্থানের পেছনে নিয়ে সমাহিত করার।

তাকে শেষবার দেখার জন্য তার স্ত্রী-সন্তানদের ডাকা হলো। ছেলে-মেয়ে দুটি এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

একটু সময় নিয়ে দুই নারীর কাধে ভর দিয়ে আলুথালু বেশে তার স্ত্রী এলো। তার চোখে পানি নেই, শুষ্ক চোখ গুলো তাকে আরও অনেক রুক্ষ বানিয়ে রেখেছে। কিন্তু তবুও, এমন রুপ এমন পরিশুদ্ধ সৌন্দর্য মজিদ সাহেবের দৃষ্টি ধাঁধিয়ে দিলো। চোখ ফিরিয়ে সে অন্যান্যদের দিকে তাকালো......... এখন সবার চোখ তার যুবতী স্ত্রীর দিকে। শত ছিন্ন শাড়ি ভেদ করে, মজিদ সাহেব এর মৃত্যু-ঘটমান শোক ভুলে আরো অনেকের দৃষ্টিই মুগ্ধ হচ্ছিলো সদ্য স্বামীহারা নারীটির প্রতি। মজিদ সাহেব চমকে উঠেন, নাহ,, এমন লোলুপ দৃষ্টি এমন অসভ্য দৃশ্য তিনি সইতে পারছেন না। এই বীভৎস সমাজে তার ফুলের মতো বউটা কেমন করে  লড়বে একা একা?

মজিদ সাহেব এর ঘোর কেটে যায়। সে দোকান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দ্রুতপায়ে বাড়ির পথে রওয়ানা দেয়। সে এখন জানে তাকে কি করতে হবে, কিভাবে আগলে রাখবে স্ত্রী সন্তানদের। তার মনের সবটুকু কৃতজ্ঞতায় রয়েছেন সৃষ্টিকর্তা, স্ত্রী, জল-সাজে সজ্জিত সেই পুকুর পাড়ের জলোদ্যাণ .....।

 

 

★ ছবি- নেট থেকে।

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ