শ্রীপুরের বড়ি

মাহবুবুল আলম ২২ জুলাই ২০১৯, সোমবার, ০১:০৩:১০অপরাহ্ন গল্প ৯ মন্তব্য

 

মাহবুবুল আলম

রাত এগারটা পর্যন্ত পোঁটলা পুঁটলি গোছগাছ করে মশারির ভেতর ঢুকে হাসেম আলী। আগামী-কাল সকাল সকাল বাড়িতে রওয়ানা দিবে সে। আশুলিয়ার গনকবাড়ি এলাকায় ছিট কাপড় ফেরি করে বিক্রি করে হাসেম আলী। আজ কয়েকদিন ধরে তার শরীরটা বেশ বেতাল। বাড়ি যাওয়ার জন্য মনটা তার ছটফট করে। বাড়িতে দুই মেয়ে এক ছেলে নিয়ে হাসেম আলীর সংসার। মা-বাবা থাকলেও তারা আলাদা থাকেন। পাঁচ ভাইয়ে মিলে মা-বাবার সংসারের খরচাপাতি চালায়। মাসে প্রত্যেকের ভাগে পড়ে ছয় কেজি চাল আর বাজার খরচের জন্য এক’শ করে টাকা।এতে বুড়ো-বুড়ির এক রকম চলে যায়। তবে এই নিয়ে প্রতি মাসে একবার দু’বার ঝগড়া ঝাটি অবধারিত। আর বউদের কম কথা ও শুনতে হয়না বুড়ো-বুড়িকে।

হাসেম আলী পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয়। তাকে ছাড়া বাকিরা মাটি কেটে, নৌকা বেয়ে বা রোজ কামলাগিরি করে কোনো মতে সংসার চালায়। হাসেম আলী ও আগে মাটি কামলার কাজ করত। কিন্তু মাটি কাটার মতো মেহনতের কাজ তার শরীরে সহ্য হতোনা বলে বেশ কয়েক বছর আগে সে সব কাজ ছেড়ে দিয়ে ঢাকা শহরে চলে আসে হাসেম আলী। ঢাকা এসেই এক ফেরিওয়ালার সাথে পরিচয়ের সূত্রে পেয়ে যায় সেই ফেরিওয়ালার গাট্রি বহার কাজ। এ ভাবে দুই তিন বছর কাজটা শিখে নিজেই শুরু করে এই সিট কাপড়ের ব্যবসা। তার আর গাট্রি বহার জন্য আলাদা মুটে নেই। নিজেই মালিক। নিজেই মুটে।

সকালে ঘুম থেকে ওঠে খানাপিনা শেষ করে বেরিয়ে পড়ে হাসেম আলী। এখানে সেখানে ঘুরে ঘুরে সিট কাপড় বিক্রি করে ফিরে আসে সেই সদ্ধ্যাবেলা। গাট্রি বয়ে ফেরির কাজ করা কষ্টের হলেও ঢাকা শহর বলে কথা। এখানকার মজাই আলাদা। তাই কষ্টকে কষ্ট বলেই মনে হয়না তার কাছে। ব্যবসাটাও খারাপ না। স্বাধীন ব্যবসা। মন চাইলে কাজ করলাম;না করলে না। এ জন্য কারো ধমক-ধামক তুচ্ছতাচ্ছিল্য শোনার কোনো বালাই নেই।

গনকবাড়ির আসমত মিয়ার বস্তিতে এক খুপড়ি ঘরে থাকে হাসেম আলী। নিজেই কেরসিনের চুলায় রান্না করে খায়। কাজ কারবার করে হাতে যখন কিছু পয়সা জমে, তখন তিন চার মাস পরপর বাড়ি যাওয়ার জন্য মনের মধ্যে ছটফটানী শুরু হয় তার। বাড়ি গেলে আবার একমাস দেড়মাস। ঢাকা আসতে তখন আর মন চায়না। শুরু হয় পরিবারে অভাব অনটন। কিন্তু শীত, গ্রীষ্ম-বর্ষায় মাথায় বিরাট কাপড়ের গাট নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কষ্টের কথা মনে হলেই ঢাকা আসতে কিছুতেই মন চায়না।তখন শুরু হয় অজু-ফার খেটখেটানি। তাই আবার চলে আসতে হয় হাসেম আলীকে।

তেল চিটচিটে মশারির ভেতর শুয়ে কত কিছু ভাবে হাসেম আলী। রাত গভীর হয়ে গেলেও এক রত্তিও ঘুম আসছেনা তার। শুধু এপাশ ওপাশ করছে। সঙ্গে সঙ্গে বুড়ো দাঁতের মতো খটকটে চৌকিটাও মটমটিয়ে দোলে ওঠে। তার ওপর ছারপোকার উৎপাত। কত বছর যাবত যে কাঁথা-বালিস চাদর ধোয় না বা রৌদ্রে দেয়না তা এখন মনে করতে পারছেনা হাসেম আলী। আর এসব নোংরা বিছানা পেয়ে ছারপোকারা মহা ধুমধামে বংশ বিস্তার করে চলেছে। সারাদিনের পরিশ্রমের পর একবার ঘুম আসলে ও সব ছারপোকার কামড় তখন তুচ্ছ মনে হয়। কিন্তু যে দিন মনে অস্তিরতা থাকে সে দিন বুঝা যায় ছারপোকার উৎপাত কি জিনিস। মেরে মোরে ও শেষ করা যায়না , আন্ডা-বাচ্চা নিয়ে শত শত ছারপোকা এসে আক্রমন করে।

কাল বাড়ি যাবে, তাই আজ কিছুতেই হাসেম আলীর ঘুম আসছে না। সব সময়ই বাড়ি যাওয়ার আগের দিন তার এমন হয়। অনেক চেষ্টা করে ও ঘুম আসছেনা। এই সুযোগে নানা জৈবিক চিন্তারা এসে মাথায় ঘুরঘুর করছে। এমুহূর্তে এমন সব ভাবনা তাকে নাকাল করে তোলেছে। অনেক ভেবে চিন্তে একবার লুঙ্গির ভেতর হাত ঢুকিয়েছিল হাসেম আলী। কিন্তু পুঁজি বাট্রার কথা ভেবে হাত সরিয়ে নিয়ে আসে।

তার এ সিট কাপড়ের ব্যবসায় নব্বই ভাগ ক্রেতাই মহিলা। ফেরি করতে করতে কত রকম মহিলার দর্শন মিলে তার । ব্যবসার খাতিরে কারো কারো সঙ্গে কিছুটা ভাব ও হয়ে যায় হাসেম আলীর। আবার রাস্তা ঘাটের অনেক খারাপ মেয়ে ছেলের সঙ্গে ভাবের আদান প্রদান হয়। রাতে বিছানায় শুয়ে ও সব মহিলাকে নিয়ে আদি-রসাত্মক চর্চায় বিভোর হয় মাঝে মাঝে। এতে দিনদিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে তার শরীর। এই নিয়ে হাসেম আলীর চিন্তার অন্ত নেই।

বেশী চিন্তায় থাকে বাড়ি যাবার সময় হলেই। কারণ তার বউ অজুফা শরীরে গতরে তার প্রায় দ্বিগুণ। সবাই বলে অজুফা নাকি হস্তিনী টাইপের মেয়েছেলে। নানান কারণে মাঝে মাঝে বাড়িতেই যেতে ইচ্ছা করে না হাসেম আলীর। তবু সংসারের মায়ায় বাড়িতে না গিয়ে থাকতে পারে না সে। তাই প্রায় দুই তিন মাস পরপর একবার বাড়ি যায় হাসেম আলী।

বাড়ি যাওয়ার পথে প্রায় সব সময়ই বিভিন্ন বাসষ্টপেজে শ্রীপুরের বড়ি বিক্রির ক্যানভাসারেরা বাসে ওঠে যৌনশক্তি বর্ধনের বড়ি বিক্রির জন্য নানা ধরনের অশ্লীল কথাবার্তা বলে প্যাসেজ্ঞারদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। কিন্তু এতদিন হাসেম আলী ওইসব ক্যানভাসারদের কথা আমলে নেয়নি। কিন্তু এবার বাড়ি যাওয়ার পথে কিছু বড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবে হাসেম আলী। এ মুহূর্তে তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে গত যাত্রার শেষ রাতের অজুফার অপমান জনক কথাটা।

এখন অজুফার সে রাতের সেই অগ্নিমূর্তিটা হাসেম আলীর চোখের সামনে ঘড়ির পেন্ডুলামের মত দোলে। এসব ভাবতে ভাবতেই সে কেমন চুপসে যায়। বাড়ি গেলে অজুফাকে নিয়ে নানাজন নানা কথা বলে। তার বউ নাকি তার অনুপস্থিতিতে তাদের দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই কালামের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে। নিজের দূর্বলতার কারণে ভাল করে শাসন ও করতে পারে না। হাসেম আলী ভাবে অজুফারই বা  দোষ কী। সোমত্তা মেয়ে মানুষ। তাই যেন হাসেম আলী দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। এমন তর রাজ্যের নানা ভাবনা ভাবতে ভাবতে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ছারপোকার কুটকুট কামড়ানী ও তখন তার কাছে খুবই গৌন বলে মনে হয়।

নিজে নিজে একটা অশ্রাব্য গালি দিয়ে ঘুম ভেঙ্গে বিছানায় ওঠে বসে হাসেম আলী। চোখেমুখে চরম বিরক্তি নিয়ে সে যখন তার ভিজা লুঙ্গি সামলাতে ব্যস্ত তখনই ফজরের নামাজের আযান শুরু হয়। বিরক্তি নিয়ে কিছু সময় বিছানায় বসে থেকে শেষে ওঠে কলতলায় যায়। গোসল সেরে নামাজ পড়েই হাসেম আলী রওয়ানা দেয় বাসষ্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে।

বাসে ওঠে সুবিধামত জানালার পাশে একটা সিট ও পেয়ে যায় সে। বাস ছাড়তে এখনো আধ ঘন্টা বাকি। এ অপসিজনে গাড়ি ভরতে ও সময় লাগবে। হাসেম আলী তার পোঁটলা পুঁটলী সামলিয়ে আরাম করে বসে। একটা বনরুটি ও দুইটা সাগর কলা খেয়েই সকালের নাস্তাটা সেরে নেয় সে। একজন পান বিড়ি ওয়ালা ডেকে একটা মশলাদার পান মুখে পোরে একটা সস্তা দামের সিগারেটে আগুন ধরায়। এ মুহূর্তে নিজের কাছে হাসেম, আলীকে বেশ বড়লোক বড়লোক বলে মনে হয়। পান চিবুতে চিবুতে সিগারেটের ধোঁয়ায় ডুবে কি যেন একটা মনে হয় হাসেম আলীর। সিগারেটটা ঠোঁটে ভেজিয়েই লুঙ্গির ভেতর হাত ঢুকায় সে। না, ঠিক আছে। আন্ডারওয়ারের পকেটে রাখা টাকা পয়সা যথাস্থানেই আছে। তার চোখে মুখে একটা খুশির ঝিলিক চমকায়।

এরই মধ্যে প্যাসেজ্ঞারে বাসের ভিতর প্রায় ভরে ওঠেছে। তবু বাসের হেলপার অসাইন্যা আসাই-ন্যা বলে হাঁক ছাড়ছে। লোকাল গাড়ি । গলা পর্যন্ত পেট না ভরলে গাড়ি ছাড়বে না। হাসেম আলী পানের পিক ফেলে। সিগারেটে সুখটান দিয়ে তা ফেলে দিয়ে বাইরে দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎই ক্যানভাসারের হাঁকে দৃষ্টি ফিরায় হাসেম আলী। কাছের ও দূরের যত যাত্রি সাধারণ। মুসলমান ভাইদের আমার সালাম হিন্দু ভাইদের আদাব। চুরি চামারি না করে মাঝে মাঝে গাড়িতে আপনাদের বিরক্ত করে এই গরীবের পেট চালাই । আপনারা যারা এ পথের রেগুলার পেসেঞ্জার সবাই এই গরীবকে চিনেন।আমি শ্রীপুরের বিখ্যাত যৌনবর্ধক বটিকা বিক্রি করে নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্য ও আপনাদের সুখ ফিরিয়ে আনি। আর আমার বাল বাচ্চার মুখে খাবার তুলে দেই। একটু থেমে সে আবার বলতে শুরু করে-

ভাইসব! আমার বেয়াদবি নেবেন না। যে সব ভাই নিজের স্ত্রীকে সুখ দিতে পারেনা, তাদের পুরুষ হিসাবে বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে দাড়ায়...।

জব্বর আলীর এসব কথা শুনে কিছু কিছু পেসেজ্ঞার মচকী হাসে। মহিলা যাত্রিরা বিব্রত হয়ে লজ্জায় বাইরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। ক্যানভাসারের কথা শুনে হাসেম আলীর মনে উত্তেজনার ঢেউ জাগে।জব্বার আলীর হাঁকে হাসেম আলী ফিরে তাকায়-ভাইসব এখানে এমন অনেকে আছেন ,যারা দুই মাস তিন মাস পর বাড়ি যাইতাছেন।কিন্তু বাড়ি গিয়ে স্ত্রীর সামনে দাড়াতে ভয় লাগে। বলেন দেখি কী অপমান! কী যন্ত্রনা! কিন্তু এখন থেকে আর কোনো চিন্তা নেই।আপনারা বলতে পারেন কি ভাবে ? হ্যা ভাই সব আপনাদের এমন অপমানের হাত থেকে বাঁচাতে পারে একমাত্র এই শ্রীপুরের বড়ি। বলেই জব্বর মিয়া তার ব্যাগ থেকে কিছু টেবলেট বের করে আবার বলা শুরু করে-এই বড়ি সেবনে আপনার... লৌহ দন্ডের মত শক্ত হবে।এক দেড় ঘন্টায় ও সে মাথা নোয়াবে না। এইবার এই বড়ি নিয়ে বাড়ি গেলে স্ত্রীর আদর সোহাগ বেড়ে যাবে। ডিম দুধ খাওয়াবে। পাশে বসে পাখার বাতাস করে মিষ্টি পান  খাওয়াবে। আপনার সাথে আর খেটখেট করে কথা বলবেনা। আপনার প্রতি তপ্ত তালাপি বেড়ে যাবে। আর আপনি ফিরে পাবেন আপনার হারানো আত্মবিশ্বাস।

কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই জব্বার মিয়ার চোখ পড়ে হাসেম আলীর চোখে। নিজের দুর্বলতার কথা ভেবে চোখ নামিয়ে ফেলে হাসেম আলী। ভেবে মনে মনে ঠিক করে- না,এইবার এই বড়ি নিয়া যাইতেই অইব। ক্যানভাসারের হাঁকে তার দিকে আবার দৃষ্টি নিবন্ধ হয় হাসেম আলীর। জব্বার মিয়া বলে-

-ভাইসব , এখন যার যা দরকার জায়গায় বসে অওয়াজ দিবেন এই অধম আপনাদের নিকট পৌছে দিব। মূলামুলি নাই দরাদরি নাই একটা বড়ি একদাম পাঁচ টাকা, পাঁচ টাকা, পাঁচ টাকা।

এরই মধ্যে দুএকজন বড়ির জন্য হাত ও পেতেছে। জব্বার আলী ক্যানভাসার তখন ব্যস্ত হয়ে ওঠে-দাড়ান ভাইজান দিচ্ছি দিচ্ছি। একটু সবুর করেন। হাসেম আলীর কাছে আসতেই পথ খরচের জন্য বুক পকেটে রাখা টাকা থেকে জব্বার আলীর দিকে বিশ টাকার একটা নোট এগিয়ে ধরে সে। চারটা বড়ি নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে হাসেম আলী গুনগুনিয়ে গানের কলি ভাজে-মনে বড় জ্বলারে পাঞ্জাবী ওয়ালা...।

আজ যেন হাসেম আলী তাড়াতাড়িই বাড়ি এসে পৌঁছেছে। মনে যেন তার রঙ লেগেছে। খুশিতে আটকান। বউকে একা পেয়ে দু’একবার গায়ে হাত ও দিয়েছে হাসেম আলী। কিন্তু অজুফা চাপা গলায় মৃদু আপত্তি করে বলে-পোলা মাইয়া বড় অইছে,লাজ শরম নাই একটুও। বিগলিত হয়ে হাসেম আলী বলে-আইও বউ একটু কাছে আইও, তোমারে একটু মায়া করি। অজুফা আবার ফিসফিসিয়ে বলে- না এহন না মর্দামী দেখমু পরে।

কথাটা শেষ করতে পারেনা অজুফা। সাথে সাথেই বড় মেয়ে পারুল এসে ঘরে ঢুকে। মা বাবার অন্তরঙ্গতা দেখে কেমন অপ্রস্তুত হয়ে যায় সে। একটা কিছু খোঁজাখোঁজির ভান করে আবার বেরিয়ে যায়।। হাসেম আলী একটু ঘুরতে বেরিয়ে যায়। তার এখন রাতের অপেক্ষা। রাত হতে আজ এত দেরি হচ্ছে কেন-তা কিছুতেই বুঝতে পারছেনা সে। আজ যে তাকে জিততেই হবে।আর জিতবেইনা কেন?আজ যে তার সঙ্গে আছে শ্রীপুরের বড়ি। বুক পকেটে হাত দিয়ে শ্রীপুরের বড়ির অস্তিত্ব পরখ করে হাসেম আলী।

আজ সন্ধ্যা নামতে না নামতেই রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে ফেলে অজুফা। হাসেম আলী এখন দাওয়ায় একটা জল চৌকিতে বসে গোগ্রাসে সিগারেটের ধোঁয়া গিলছে। অজুফা ছেলে-মেয়েদের তাদের দাদা-দাদির কাছে শোয়ার জন্য পাঠিয়ে দিয়ে,একটা আয়না নিয়ে বসে। আজ হাসেম আলীর আনা সস্তা দামের পাউডার মাখে। ঠোঁটে লিপষ্টিক লাগায়। চোখে কাজল লাগিয়ে, চুলে গন্ধরাজ, তৈল মেখে মাথা আচরায়। হাসেম আলী বসে বসে মাদকতাপূর্ন দৃষ্টিতে বউকে দেখে। অজুফাকে এখন পরীর মত লাগছে হাসেম আলীর কাছে। সে আজ একটা এসপার ওসপার করতে চায়।বউকে আদুরে গলায় ডাকে হাসেম আলীÑবউ এক গেলাস পানি দেও তো। অজুফা পানি নিয়ে এসে ইঙ্গিতপূর্ন হাসি হাসে। মুচকি হাসে হাসেম আলী ও। পানি দিয়ে অজুফা ঘরের ভিতর চলে যেতেই সে পকেট থেকে দুইটা বড়ি বের করে। ক্যানভাসার বলেছে যারা একটু বেশী দুর্বল তাদের এক সংগে দুইটা বড়ি খেতে হবে। হাসেম আলী এদিক ওদিক তাকিয়ে মুখের ভেতর দুইটা বড়ি রেখে ডগডগ পানি খায়। তখনই বড় মেয়ে পারুল আবার ঘরে ঢুকে, সঙ্গে পোলা রমিজও।

পারুল বলে-আব্বা,কালকা কিন্তু আমার স্কুলের বেতন দিতে অনব। নাইলে নাম কাইট্যা দিব। রমিজ বলেÑআব্বা, আমারের একটা নতুন শার্ট কিন্তু কিইন্যা দিতে অইব কইলাম।ছেলে-মেয়ের কথা শুনে হাসেম আলী হাসতে হাসতে বলেÑদিমু। সবঐ দিমু। অহন ঘুমা গিয়া।

বাবার কাছে আবদার পেরেই পারুল ও রমিজ চলে যায়। রাত বেশ জমতে শুরু করেছে। পাড়া  গায়ের রাত সন্ধ্যা বেলায়ই কাত। চৌকিটার অবস্থাও বেশ নড়বড়ে। তাই আজ অজুফা মাটিতেই চাটাই পেতে বিছানা করেছে। চারদিকে ঘন কালো অন্ধকার। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। অজুফা বিছানায় শুয়ে বাতি নিভিয়ে হাসেম আলীকে ডাকে-আইও তাড়াতাড়ি আইও।

হাসেম আলী ওঠতে যায়। মাথাটা তার কেমন চক্কর দিয়ে ওঠে। সারা শরীরে কেমন অস্থিরতা। সারা শরীরে ভীষন জা¡লাপোড়া শুরু হয়েছে। কেমন বমি বমি করছে। হাসেম আলীর আর পা চলেনা। চোখে শুধু অন্ধকার দেখছে।

অজুফা আবার তাগাদা দেয়- কি অইল আইও না ? হাসেম আলী চিৎকার করে ওঠে-

বউ আমার কেমন জানি মাথা ঘুরাইতাছে। আমারে ধর । তাড়াতাড়ি কইরা ধর আইসা। অজুফা দৌড়ে আসে স্বামীর কাছে।হাসেম আলীকে ধরতেই সে মাটিতে ঢলে পড়ে অজুফাকেসহ।

অজুফা চিৎকার শুরু করে-তোমরা কে কই আছ গো ,জলদি কইরা  আইও; পারুলের বাফ জানি কেমন করতাছে। অজুফা বিলাপ শুরু করে। তার বিলাপ ও চিৎকারে বাড়ির সবাই দৌড়ে আসে। অজুফা স্বামীর মাথাটা কোলে নিয়ে বসে। হাসেম আলী চিৎকার করে বলতে থাকে-পানি। তোমরা আমার মাথায় পানি ঢাল। আমার মাথাডা নিতাছেগা। বলেই হরহরিয়ে বমি শুরু করে হাসেম আলী। বাড়ির সবাই এসে হাসেম আলীর শুশ্রুষায় লেগে যায়। কলস দিয়ে পানি এনে পারুল তার বাবার মাথায় ঢালতে থাকে। ছোট ভাই কাশেম গ্রামের পল্লী চিকিৎসক সামাদ ডাক্তারকে আনতে চলে যায়।

হাসেম আলীর অস্থিরতা বাড়তেই থাকে। এর মধ্যে শুরু হয়েছে খিচুনি। বমির পর বমি করতে থাকে হাসেম আলী। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে সামাদ ডাক্তারকে নিয়ে হাজির হয় কাশেম। সামাদ ডাক্তার ঘুম চোখেই রোগিকে দেখে সবাইকে সরে যাওয়ার জন্য তাগাদা দেয়-যাও যাও তোমরা সবাই সইরা যাও। জাগাটা একটু ফাঁক কইরা দেও, একটু বাতাস লাগুক।

হাসেম আলী অনবরত ঘামছে। ঘেমে নেয়ে একাকার সে। সবার সামনে আবার ওয়াক ওয়াক করে বমি করে হাসেম আলী। সামাদ ডাক্তার কাশেমকে ডেকে বলে রোগির গায়ের শার্টটা খুলে দেয়ার জন্য। সবাই ধরাধরি করে শার্টটা খুলে। হাসেম আলী আর্তচিৎকার করে- আমারে তোমরা বাঁচাও। আমি মইরা গেলাম, আমারে বাঁচাও । সবাই মিলে হাসেম আলীকে সান্তনা দেয়। কাশেম শার্টটা রাখতে যাবে তখনই পকেট থেকে কিছু একটা খসে পড়ে। সামাদ ডাক্তার হাতে নিয়ে পরখ করে দেখে শ্রীপুরের বড়ি দুইটা।

[অনুরোধ: এটি একটি মনোদৈহিক গল্প। দয়া করে কেউ অশ্লিলতা খুঁজবেন না।]

 

----------------

0 Shares

৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ