শৈশবের আখড়া [পর্ব: ঝরা কাঞ্চন]

নিবিড় রৌদ্র ৯ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৭:৫৫পূর্বাহ্ন স্মৃতিকথা ১ মন্তব্য

ঠাকুর দালানের পেছনের জায়গাটা তেমন সুবিধাজনক ছিল না। চুনা-দেয়াল খসা পাতি পাথর, নাট মন্দিরের ছাদ থেকে নেমে আসা বৃষ্টিতে ক্ষয়ে গোলাকার রূপ নিয়ে ছড়িয়ে থাকা লাল কংক্রিটের ওপর মন্দিরের জানালা দিয়ে বিভিন্ন সময়ে ফেলা দেব-দেবীর গায়ের পুরনো কাপড়ের টুকরো, ধূপকাঠির খালি প্যাকেট, প্রদীপের পোড়া সলতে ইত্যাদি পড়ে থাকতো স্যাঁতসেঁতে শেওলাতে মাখামাখি হয়ে। সেখানে একটি কলতলা থাকাতে মাঝে মাঝে জলের প্রয়োজনে সাধারণভাবে লোকের যাতায়াত ছিল, তাও ওই কল পর্যন্তই। দিনে দুপুরেও কেমন আলগা শিহরণ ঢেউ খেলতো মনে এই পাশ দিয়ে গেলে। খুব কাছেই দুই হাত বেড়ের খাড়া একটি তরুণ কাঞ্চন ফুলের গাছ দালান ঘেষে কাউকে তোয়াক্কা না করেই ছাড়িয়ে গেছে ছাদ।

পশ্চিম দিকে পুকুরের পাড় পর্যন্ত কাঠকয়লা, খর পোড়া ছাইয়ের গাদা। অযন্তে অসচেতনে বেড়ে ওঠা কলা, পান, পেপে, পেয়ারার ঝোপ। ফাঁকে ফাঁকে সারি সারি সুপারি গাছ যেন যুদ্ধাবসরে জিরিয়ে নেওয়া সৈন্যবাহিনীর আদলে চনমনে মাথা দুলাচ্ছে বাতাসে তাহাদের শক্তপোক্ত চিকন শরীর ঝাঁকিয়ে।

আর দক্ষিণে ঘন সবুজ জংলা। জাম্বুরা, নারিকেল, কুল, আম, কাঁঠালসহ আরো কত বুনো গাছ লতা পাতার বাহার আমাকে কৌতূহলী করে রাখতো ঋতুর বৈচিত্র্যভেদ করে।

এই যেমন চৈত্র মাস এলে আমাকে রঙ্গিন কাঠের ফল নাম ধরে ডেকে ডেকে নিয়ে যেতো ওই তল্লাটে। এই সময়টা বাঁশের চুঙ্গিতে রঙ্গিন ফলের গুটি ভরে ফুটানোর সময়। চিকন বাঁশি আঁকারের কিন্তু বাঁশির থেকে মাপে ছোট এক টুকরো টেংরা বাঁশের একটা চুঙ্গি আর এর নলাকার ছিদ্র ও উচ্চতা পরিমাণে আরেকটা চটিবাঁশ দিয়ে বানানো ডান্ডি আঁকারের হাতল, এটাকে বলা হতো ডান্ডি পটাশ। এ-পাড়া ও-পাড়ার সব ছেলেদের ডান্ডি পটাশ খেলা অন্যান্য খেলার পাশাপাশি পুরোদমে জমে উঠলে গাছের ছরা ছরা ফলের কাজ ছিল গাছ ছেড়ে এসে ডান্ডি-যোদ্ধাদের পকেটে, হাতে- হাতে বন্দুকের গুলির মত পরিযায়ী পরিবেশ নিয়ে শৈল্পিকভাবে ঝুলে থাকা।

এই কটা দিন ছোট থেকে মাঝারি ধরণের কোন রঙ্গিন গাছে ফল টিকিয়ে রাখা কষ্টসাধ্য ছিল। বীজে পরিণত হয়ে আপনি ঝরে পড়া ছাড়া যে মহামতি ফল মানুষের মহান কোন কাজে আসে না, সে ফলের প্রতি মানুষের আর মায়া থাকে কই! আগ্রহ তো বেশ পরের ব্যাপার। বরং জীবনের সবচেয়ে রঙ্গিন ও খাঁটি অধ্যায় এই যাবতীয় শৈশব মস্তিষ্কের বেপরোয়া ও কোমল নিউরনের প্রাণে খানিকটা আনন্দ উদ্দীপনা জাগাতে পেরে রঙ্গিন কাঠের ফলের জীবনেও ধন্যযোগ নেমে আসা উচিত বৈ কি! ফুল থেকে ফলের গুটি একটু বড় হওয়ার দিন-কয়েকের মধ্যেই গাছ খালি। বড় গাছগুলো বিশাল উঁচু ও মোটা বেড়ের বিধায় মাথা তুলে ওদিকে কারো নজর দেওয়া আর আঙ্গুর ফল টক তার কাছে একই ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

তখন দক্ষিণ দিকের জংলাটায় জাম্বুরা গাছের পাশে তূলনামূলক নীচু জায়গায় ছোট একটা গাছে রঙ্গিন ফল গাছেই পেকে ফেটে ফেটে ঝরতো প্রতি বছর। কখনো কখনো কারো কারো নজরে এলেও গাছে চড়ে সেই ফলের ছরা যে পেরে এনে সংকটকালের খায়েশের যোগান মেটাবে সেই অনর্থক ইচ্ছা বা সাহস কোনটাই সহসা ধরা দিতো না দুরন্ত ছেলেদের উল্লাসে। বাড়ি থেকে শতেক মিটারের দূরত্বের আপন আমি মাঝে মাঝে দুপুর বেলা রহস্য নিষেধের দাগ মাড়িয়ে সবার অগোচরে দুয়েক ছরা পেরে আনতাম নিজের জন্য। গ্রীষ্মের ঝিঁঝি ডাকা কাঠফাটা রোদ্দুরে যখন নীরব নিস্তব্ধ পাড়ার ভারি চোখের পাতা অনড় দৃশ্যপথে ঝিমঝিম হয়ে লেগে আসে, তখন যেন শৈশবের সাহস আমাকে একটু বেশিই তাড়িয়ে বেড়াতো আমার একলা অস্তিত্বের রাজ্য জুড়ে।

আবার শীত যাই যাই সকালে দেব কাঞ্চনের গাছের আগায় যখন মৌমাছি মেঘ জমে নীল, হলুদ সাদা করবীর চিরল চাহিদা এবং শিউলি- জবা- স্থলপদ্মে যখন ভীড়ের জোয়ার তখন আমার ভাটার প্রতি টান। গাঢ় আবিরের রঙে ছাওয়া প্রবীরের মত দাঁড়িয়ে থাকা কাঞ্চন গাছের কাঁধ বেয়ে মন্দিরের ছাদে নেমে যেতাম অনায়াসে। ছাদের রেলিঙ থেকে মগডালের ফুল তোলা সহজ ছিল। আবছা নীলচে আঁচলের নকশা বিছানো গাছ ভর্তি ফুলের মধ্য থেকে একটি দুটি ফুল ছিঁড়লে মনে হত যেন মৃদু সূর্যালোকে আলোকিত আসমান থেকে আমি একটি করে তারা কুটছি। একেকটি কাঞ্চন ফুল যেন আমার চোখে একেকটি নক্ষত্র ফুল হয়ে ধরা দেয়। এভাবে একটি একটি করে নক্ষত্র জমিয়ে তারপর সেই ফুলের অর্ধেক মন্দিরের পূজোর থানে রেখে বাকীগুলো নিয়ে আসতাম নিজের জন্য।

এদিকে বৈষ্ণবী হরিপ্রিয়া পিসি টের পেয়ে গেলো কি না এও আরেক চিন্তার বিষয়। নাট মন্দিরের ছাদে যখন তখন ওঠা নিষিদ্ধ বলেই হয়তো এই মহামুশকিলময় চিন্তা। তবে এর মূল কারণ শুধুই যে সাতসকালে দেবতাস্থানের ছায়া মাড়িয়ে উঁচু গাছের ফুল তোলা দোষের কিংবা পাপাচারে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কা ঠিক তা নয়। বরং এর সাথে সাথে আছে অন্য আরেক কৌশলগত কারণ। আর সেটি বোধ করি কাঞ্চনের বীজসহ পুনর্নবা নামক এক ধরণের ভেষজগুণসম্পন্ন বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। ভাঙ্গা পরিত্যক্ত ঘরের কিনারা, ঠাকুর দালানসহ বিভিন্ন ছাদে পুনর্নবার ঘের দেখা যেতো তখনকার সময়ে। কবিরাজি গুণসম্পন্ন বৈষ্ণবী হরিপ্রিয়া ভেষজ লতা পাতার চিকিৎসা জানতেন বলে বিভিন্ন তিথি পার্বণে আশপাশের মানসিক বা শারীরিক জরাগ্রস্ত লোকেদের আনাগোনাতে বেশ ভালই জমে উঠেছিল পাগলের আখড়া। এই গাছের কান্ড, ওই লতার মালা, পাতার রস করে বা পাতা চটকিয়ে মুণ্ডুতে মেখে গলা অবধি জলে নেমে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকাসহ নানা কিসিমের চিকিৎসা চলতো এখানে। হয়তো সেই সব অপ-চিকিৎসার উপাচারের উপকরণ বা উপাদানসমূহ লালনে-রক্ষণে বিভিন্ন সময়ে এমন সব নিষেধাজ্ঞার বাড়বাড়ন্ত দেখা যেত।

অন্যদিকে কাক ডাকা ভোর, নিরেট দুপুর, দিবারাত্রির সন্ধিতে দেব-দেবতা ভূত-প্রেতের চলাচলের সময়। এক মায়ের এক ছেলে-মেয়েদের এসবক্ষেত্রে বিপদ বেশি। ফর্সা সুন্দরের প্রতি তেনাদের নজর থাকে সবসময়। তাই এমন আরো কত শত সুপরিচিত অথচ উদ্ভট বিষায়বলি নিয়ে মা'র কাছে বয়োজ্যেষ্ঠ কৃষ্ণা বৈষ্ণবীর নালিশ যেন নিত্যকার সূচিপত্রের শিরোনাম; অবশ্যপাঠ্য।

যদিও এত সবকিছুর পরও নিজের সমস্ত ছেলেবেলার আহ্লাদ উচ্ছ্বাস নিয়েই বিশারদ বাবার নিশ্চুপ হাসি হয়ে নিয়মিত ফুটতাম আমি তার প্রেরণার ফুলে। সে ফুলে ঘ্রাণ ছিল না, শৈশবের স্বাক্ষরিত দিনগুলোর প্রাণ ছিল তবু এই দেব কাঞ্চনের পাপড়ির মত কৃষ্ণনীল। একটা ঝরতো তো দশটা ফুটতো।

মনমোহন মন্দির জুড়ে ফেলে আসা দিনের ভোর থেকে শুরু করে সন্ধ্যা আরতির ধূপগন্ধী কালভেদী ভজন আমার কানে আজও সুর তুলে প্রাত্যহিক যাপনের রসদ হয়ে। আমি বড় হই। বাড়ি ছাড়ি। লক্ষ্যের গণ্ডি আয়তনে পুরনো দালানের যৌবন ঘিরে নবীন আলোর ঝলমলানি বাড়ে। কাঞ্চন ফুলের গাছ কাটা পড়ে। পুনর্নবারা লাপাত্তা! কলতলা, জংলা, চুঙ্গি ফাটা নিক্ষিপ্ত বারুদের মত ছেঁচা রঙ্গিন-গুটির কাঁচা ও তিক্ত গন্ধমাখা ডান্ডি পটাশ ও তার শ্রুতিমধুর তরতাজা আওয়াজ- সবকিছু একাকার হয়ে সুবিশাল মোজাইকের আলপনার ইমারতে মিশে যায় নিষ্প্রাণ নন্দিত সভ্যতার প্রেক্ষাপটে।

- - - - -

0 Shares

একটি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ