শুধিতে হইবে ঋণ

রিমি রুম্মান ১৩ জুন ২০২০, শনিবার, ০১:৫৭:৩২অপরাহ্ন সমসাময়িক ৮ মন্তব্য

দীর্ঘ প্রায় তিন মাস পর গত ৮ই জুন নিউইয়র্ক সিটির লকডাউন তুলে দেয়া হয়েছে। ভয়াবহ এই সময়ের সাক্ষী হয়ে আমরা যারা এখনো দিব্যি বেঁচেবর্তে আছি, তারা হারিয়েছি কাছের দূরের অনেককে। একের পর এক প্রিয়জন, চেনা বন্ধু, স্বজন হারানোর বেদনায় আমাদের যখন ভারাক্রান্ত মন, ঠিক তখনই অর্থাৎ গত ২৫শে মে মিনেসোটার মিনিয়াপোলিসে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তার হাঁটুর নিচে দম বন্ধ হয়ে জর্জ ফ্লয়েড নামক আফ্রিকান-আমেরিকানের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বব্যাপী ঝড় উঠে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের। ইতিমধ্যে করোনাভাইরাসে এক লাখের উপরে ছাড়িয়ে যাওয়া মৃত্যুর এই দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতির উপর দাঁড়িয়ে মৃত্যুভয়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে অগণিত মানুষ। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুকে ঘিরে সারা আমেরিকা জুড়ে বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রাস্তায় নেমে আসে সাদা-কালো-বাদামি সব শ্রেণির মানুষ। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে জ্বালাও-পোড়াও-লুটপাট চলেছে বিক্ষোভকালে। মোতায়েন করতে হয়েছে ন্যাশনাল গার্ড বাহিনী। আমাদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। কিন্তু আদতে আমরা নিজেরা কি নিরন্তর সংগ্রাম করে টিকে থাকা এই কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বর্ণবৈষম্যমূলক মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি ?

অনেক আগে আমার বন্ধুর পরিবার ইমিগ্র্যান্ট হয়ে যখন এদেশে আসবে বলে নিশ্চিত হোল, তখন তাদের বসবাসের জন্যে বাড়ির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বন্ধুর উদ্দেশ্য ছিল সব ঠিকঠাক পেলে বাড়িটি কিনে ফেলবেন। রিয়েলস্টেট এজেন্টের সাথে আমরাও গাড়িতে চেপে বসি। বন্ধুদের একজন বাড়ি কিনবে, আমাদের সবার আনন্দ কে দেখে! আমরা সবাই মিলে দলবেঁধে তা দেখতে যাই। ভাল মন্দ মন্তব্য করি। একবার বাড়ি দেখানোর উদ্দেশ্যে আমাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল জ্যামাইকার ইয়র্ক কলেজের কাছাকাছি। কেননা, তখনো ওই এলাকায় বাড়ির দাম তুলনামূলক কম ছিল। নির্ধারিত বাড়ির কাছাকাছি যেতেই দেখা গেল রাস্তায় ছোট ছোট শিশুরা সাইকেল চালাচ্ছে, খেলা করছে। কোথাও তরুণরা জটলা করে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। কেউবা শূন্যে সিগারেটের ধোঁয়া ছুঁড়ছে। সেইসব ধোঁয়া কুন্ডুলি পাকিয়ে আমাদের গাড়ির কাঁচ ভেদ করে ভেতরে এসে পড়ছে। মানুষগুলো সকলেই কৃষ্ণাঙ্গ। বন্ধুরা সকলে একযোগে ভেটো দিল, এই এলাকায় কোনোভাবেই বাড়ি কেনা ঠিক হবে না। কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করলো, রাত করে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় নির্ঘাত ছিনতাইয়ের কবলে পড়তে হবে। আমরা আর বাড়িটি দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করলাম না। এত কাছাকাছি পৌঁছেও বাড়ি না দেখে ফিরে এলাম।

প্রবাসের প্রথমদিকের সময়ে আমার এক আত্মীয় ছোট তিনটি শিশু সন্তান নিয়ে দেশ থেকে এসেছিলেন সবে। তাদের অন্য এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছিলেন ব্রনক্সে। সেই আত্মীয় যে এপার্টমেন্ট বিল্ডিং এ বসবাস করতেন, তার ৭৫% অধিবাসীই ছিল কৃষ্ণাঙ্গ। একই এপার্টমেন্টে পরবর্তীতে দেশ থেকে নতুন আসা পরিবারটি বাসা ভাড়া নেয়। সেখানেই শিশু সন্তানরা বেড়ে উঠছিল। পাঁচ বছর বাদে তারা সপরিবারে দেশে বেড়াতে গেলেন। কাছাকাছি বয়সের শিশুগুলো নিজেরা নিজেদের মাঝে কথা বলতো, রাগান্বিত হয়ে একে অপরকে অকথ্য ভাষায় গালি দিতো। আত্মীয়রা সীমাহীন বিস্ময় নিয়ে সেইসব শুনে জানতে চাইল কীভাবে শিখলো এইসব। শিশুদের মা যারপরনাই লজ্জিত হলেন। জানালেন, প্রতিবেশি কৃষ্ণাঙ্গ বন্ধুদের কাছ থেকে শিখেছে।

আরেক পরিচিতের কথা জানি, তিনি বাচ্চাদের স্কুল বদল করেছেন ভিন্ন ঠিকানা ব্যবহার করে। কেনো ? এমন প্রশ্নের জবাবে বললেন, যেহেতু এলিমেন্টারি স্কুল জোন ভিক্তিক, তাই স্বাভাবিকভাবেই কোনো পরিবার যে এলাকায় বসবাস করবে, সে এলাকায় বসবাসরত পরিবারের শিশুরা একই স্কুলের শিক্ষা গ্রহণ করবে। এলাকাটি কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত ছিল, বিধায় স্কুলের সিংহভাগ শিক্ষার্থীই কৃষ্ণাঙ্গ। তিনি চান না তার সন্তান সেই স্কুলে শিক্ষা গ্রহণ করুক। কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের আচরণগুলো তার সন্তানের মাঝে প্রভাব বিস্তার করুক। আর তাই তিনি তার পরিচিত বন্ধুর ঠিকানা ব্যবহার করে এশিয়ান শিক্ষার্থীদের স্কুলে নিয়ে আসেন সন্তানকে। শুধু তাই নয়, জানালেন, চলতি পথে পুলিশ হয়তো ড্রাগ বেচাকেনা কিংবা রবারি সন্দেহে কোন গাড়িকে থামিয়েছে, আমরা পথচারিরা ঘাড় ঘুরিয়ে একনজর সেদিকে তাকালে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ড্রাইভার সিটে বসা অভিযুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ কেউ। এমনটিই দেখে এসেছেন তিনি তার দীর্ঘ প্রবাস জীবনে।

প্রবাস জীবনের শুরু থেকেই কৃষ্ণাঙ্গদের সম্পর্কে এমনতর নানান নেতিবাচক কথা শুনে শুনে আমার ভেতরে অবিশ্বাস্যভাবে বিশ্বাস জন্মায় যে, তারা সত্যিই ভীতিকর। এমন ধারণার ধারাবাহিকতায় নিজের ভেতরের একান্ত অনুভূতির কথা বলি এবার। একদিন জ্যামাইকার ‘ই’ ট্রেনের শেষ স্টেশন থেকে বাড়ি ফেরার পথে ভুল করে ‘জে’ ট্রেনে উঠে পড়ি। ট্রেন চলছিল হিসহিস শব্দে। আমি নিশ্চিন্তে বসে আছি বাড়ির দিকে ফিরছি ভেবে। ট্রেন যতই এগিয়ে চলছিল, যাত্রীদের কেউ কেউ গন্তব্যে নেমে যাচ্ছিল,কেউবা উঠছিল। একটা সময় লক্ষ করলাম যাত্রীদের প্রায় সকলেই কৃষ্ণাঙ্গ। তখন রাত এগারোটা বেজে পঞ্চান্ন। আমার ভেতরে অজান্তেই ভয় চেপে বসলো। বুকের ভেতরে তুমুলভাবে হার্টবিট বেড়ে চলল। বরকে ফোনে জানালাম বিষয়টি। তিনি পরবর্তী স্টেশনে নেমে অপেক্ষা করতে বললেন, এবং খুব দ্রুততম সময়ে ড্রাইভ করে সেখানে এলেন। আমায় তুলে বাড়ি নিয়ে এলেন। কয়েক বছর পর আমার ভাই যখন ইমিগ্র্যান্ট হয়ে এদেশে এলো সপরিবারে, তাদের জন্যে বাসা খুঁজছিলাম। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে কয়েকস্থানে ফোনও করা হোল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের এলাকা পছন্দ হয়নি। দুর্ভাগ্য কেনো ? কেননা, সেগুলো ছিল কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত এলাকা। আমাদের যুক্তি ছিল এমন যে, ভাইয়ের সন্তানরা বাসার পাশের স্কুলে যাবে বিধায় কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থীদের সাথে একই স্কুলে পড়বে, তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে। আমরা কিছুতেই তা মানতে পারছিলাম না। সেইসব স্থানে পাওয়া বাড়িগুলো আমরা নাকচ করে দিয়েছিলাম। কেনো আমাদের এই মানসিকতা ? ওই যে বললাম, প্রবাস জীবনের শুরুর দিকে অগ্রজদের কাছে, প্রতিবেশি, বন্ধুদের কাছে শুনে শুনে আমাদের ভেতরেও অবিশ্বাস্যভাবে বিশ্বাস জন্মায় যে, কৃষ্ণাঙ্গরা সত্যিই ভীতিকর এক জাতি। আমার বিশ্বাস আমাদের অধিকাংশই ভেতরে ভেতরে এমন ভীতিকর মানসিকতা বহন করছি। অথচ কৃষ্ণাঙ্গদের লড়াই করে টিকে থাকার ইতিহাস, সংগ্রামময় জীবনের ইতিহাস, নিগ্রহ, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত হবার ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। তাদের কাছে আমেরিকার অনেক ঋণ। তবুও তাদের ঘন কৃষ্ণবর্ণই যেন কাল হয়ে দাঁড়ায় বারংবার শতাব্দী থেকে শতাব্দিকাল ধরে।

নানান নেতিবাচক সংবাদের ভিড়ে আশার খবর হোল, শত শত বছর ধরে চলে আসা বর্ণবাদের এক ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে গেছে ইতিমধ্যে। পুলিশি নিপীড়নের শিকার জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকে ঘিরে যখন বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভের ঝড়ো হাওয়া বইছে যুক্তরাষ্ট্রে, ঠিক সেই সময়ে মার্কিন সিনেট বিমান বাহিনীর চিফ অব স্টাফ হিসেবে চার্লস ব্রাউন নামের একজন আফ্রিকান-আমেরিকানকে নিয়োগ দিয়েছেন। বলা বাহুল্য, তিনিই যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীতে এমন নেতৃস্থানীয় পদে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ। পরিবর্তন আসুক। সহসাই প্রবল প্রলয়ের ন্যায় পরিবর্তন আসুক। কেননা, দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ।

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ