শিরি ফরহাদ

রাহাত হোসেন ২২ এপ্রিল ২০১৬, শুক্রবার, ০৪:৩৬:০৩অপরাহ্ন গল্প ১ মন্তব্য

কখনও ছোট গল্প লিখবো ওভাবে ভাবা হয়নি।বেশ কিছুদিন যাবৎ কিছু গল্প অনুর্বর মস্তিস্কে ঘুরপাক খাওয়ায় লেখার স্পৃহা পেলাম।উদ্দেশ্যহীনভাবে লিখে যাওয়ার অনাকাঙ্খিত কোন উদ্দেশ্য সফল করার পৃষ্ঠপোষকতায় লেখা এই গল্প।আশা করছি পাঠকদের অন্তরের অন্তঃস্থল স্পর্শ না করলেও লেখাগুলো ভালো লাগবে।যদি কারও জীবনের সাথে গল্পটা্র কোন অংশে মিল খুঁজে পাওয়া যায় তবে ক্ষমাপ্রার্থী।

আবেগজনিত স্পর্শকাতরতার কারণে আমার মধ্যে পশুপাখির প্রতি একটা অজানা ভালোবাসা কাজ করত।এরই ফলশ্রুতিতে ঘটে যাওয়া জীবনের একটি মর্মান্তিক,করুণ ও হৃদয়বিদারক ঘটনার বর্ণণা দিতে যাচ্ছি।

আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি।আমি যে এলাকায় বাস করি তার থেকে কিছুদূর গেলে পাশের এলাকাতেই আমার স্কুল।মোটামুটিভাবে বন্ধুবান্ধবের আড্ডাবাজি আর পড়ালেখায় ফাঁকিবাজি দুইয়ে মিলে ভা্লোই চলছিল দিন।একদিন টিফিন পিরিয়ডে বিদ্যালয় হতে আসার সময় হঠাৎ পথের ধারে দুটো কুকুরের ছানা দেখতে পাই।ছানাগুলোর আশেপাশে অন্য কোন কুকুর দেখতে পাইনি।তো ভাবলাম যে পথ হারিয়ে বোধ হয় এখানে চলে এসেছে ছানাগুলি।এই ভাবনার মধ্যবর্তী সময়ে কখন যেন কুকুর ছানাগুলি পা ঘেষে কুঁ কুঁ আওয়াজ করছিল টেরই পাইনি।একপলক আনমনে ওদের দিকে তাকিয়ে থেকে দেখলাম যে চোখ আমার ছলছল করছে।বুঝলাম মায়া পড়ে গেছে ওদের উপর।কোন এক অজানা অদম্য আকর্ষণশক্তি ওদের থেকে পৃথক হতে দিচ্ছে না কিছুতেই।তো আবেগজনিত কারণবশত ওদের নিয়েই বাড়ি ফিরতে হল।সেদিন আর পরে স্কুলে যাওয়া হয়নি।এক বন্ধুর মারফতে বয়ে নিয়ে যাওয়া ব্যাগটা বাসা পর্যন্ত ফেরত আসে।

আমাদের বাড়িটা ছিল টিনশেডের।তো মা আবার ওখানে হাঁস মুরগি পালন করার একটা প্রজেক্ট শুরু করেছিলেন অনেক আগে থেকেই।সেই কারণে ওদেরকে রাখা নিয়ে একটা বিরাট ঝামেলা পোহানোর মানসিক শক্তি ভিতরে ভিতরে অর্জন করার চেষ্টা চলছিল।তার উপর বাবা কুকুর বিড়াল জাতীয় প্রাণী খুব একটা পছন্দ করতেন না।ছোটবেলায় একটা কুকুর কামড় দেওয়ায় বাবার হাতে একটা শক্ত আছাড় খেতে হয়েছিল যা আজও মনে পড়ে সেই দিনের কথা।অন্য বাবা মায়েরা হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন কিন্তু আমার বেলা হল তার পুরো উল্টোটা।তার একটা অন্যতম কারণ তো ছিলই বটে।কারণটা হল বাবা আমাকে মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসতেন।পরে অবশ্য ট্রিটমেন্ট হয়েছিল আমার প্রাথমিক পর্যায়ে।এক কবিরাজের লবণ ও গুড় পড়া।চৌদ্দটা জলাতঙ্ক প্রতিরোধক ইনজেকশন বাদ পড়েনি নাভীর গোড়ায়ও।

আমার বাবা মানুষ হিসেবে ছিলেন খুবই নমনীয়।কিন্তু রেগে গেলে ইস্পাতের চেয়ে কঠিন হতে সময় লাগতো বড়জোড় দুই মিনিট।তো বাবার হাতের মারের কথা মনে পড়াতেও ওদের রাখার ব্যাপারে উৎসাহের বিন্দুমাত্র হ্রাস ঘটেনি।কারণ খুব অল্প সময়ের সম্পর্ক হলেও ওদের প্রতি অকৃত্রিম মায়া ও ভালোবাসার টান ছিল অদম্য।তারপর কোন উপায় না বের করতে পেরে চুরি করে ওদের একটা ইটের তৈরী সাময়িক ঘরে রাখার ব্যবস্থা করলাম কজন বন্ধু মিলে।সেদিন অবশ্য বাবা মা কেউই ওভাবে টের পায়নি বিষয়টা।

তারপর প্রতিদিন ওদেরকে খাওয়ানোর একটা দায়িত্ব ছিল যা খুব মজার সাথে পালন করতাম।দুধ না ছাড়ার কারণে এক বন্ধুর মাধ্যমে একটা ফিডার যোগাড় করে তা দিয়েই ওদের খাওয়াতাম।বাসা থেকে যে স্বল্প পরিমাণ টাকা আমাকে দিত তা দিয়ে নিজে খরচ না করে তিনবেলা ওদের খাবার অনায়াসে হয়ে যেত।ওরা আমাকে দেখলে অতি আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ করে লেজ নাড়াতে নাড়াতে এসে আমার পা চাটতো।

ছানা দুইটির একটি ছেলে ও একটি মেয়ে হওয়ায় সাধ করে নাম রেখেছিলাম শিরি ফরহাদ।কারণ পশু জগতে ভাইবোন প্রথাটা প্রচলিত না থাকায় ওরা একই উদরের সহোদরদের সাথে যৌনমিলনে লিপ্ত হয়।এ কারণেই মানুষ পশুজগত হতে সভ্য একটা দৃষ্টিকোণ থেকে।

একদিন ওদেরকে খাওয়ানোর সময় আমার ছোটবোন এই দৃশ্য দেখে বাসায় বলে দেয়।আর তো কোন কথাই নেই।সেদিন রাতে বাবার হাতে মোটামুটিভাবে একটা স্লাইড ধোলাই খাই।কিন্তু একটা বোবা প্রাণীর প্রতি যে অকৃত্রিম ভালোবাসা জন্ম নেয় তা প্রতিদিন স্লাইড না হেভি ধোলাই দিলেও সেই অনুভূতি না কমে বরং বৃদ্ধি পায়।হয়তো এটার কারণ এটা হতে পারে যে ওদের ভালোবাসার কারণে মার খাওয়াতে ভালোবাসাটা আরও পোক্তভাবে ঝালাই হতে পারে।

আস্তে আস্তে শিরি ফরহাদ বড় হতে থাকল।আমার সাথে আমার পেছনে পেছনে এখানে ওখানে যেত ওরা অধীর আনুগত্য ভরে লেজ নাড়াতে নাড়াতে।ভেবে ভালোই লাগতো যে কোন পদহীন একজন ব্যক্তি তাও আবার ছাত্র তার কিনা দুই দুইটা বডিগার্ড।ভাবলেই বুকটা কেমন উঁচু হয়ে যেত কারণ কেউ আমার সাথে তখন লাগতে আসা মানে কুকুরের কামড় খাওয়া।কেননা ওরা তখন বড় বললে ভুল হবে না।দুজনের চেহারায় একটা পূর্ণাঙ্গ বয়সের কুকুরের ছাপ আসতে শুরু করেছে।গা গতরেও মাশাআল্লাহ্।ওদের সামনে ওদের প্রভুর গায়ে কেউ হাত দিয়ে যাবে অসম্ভব।আর স্বভাবগত কারণে কুকুরকে ভয় পাওয়ার একটা মানসিকতা তো মানুষের আছেই।তাই বলে আমার আচার আচরণে কোন অবাধ্যতা পরিলক্ষিত হয় নি কখনও।কিন্তু মানুষ অনেকে অনেক কথা বলতো।আর মানুষের জৈবিক কার্যক্রমের পর অলস সময়ের মূখ্য কাজই বোধ হয় সমালোচনা করা।মুখ থাকলে তো কথা বলবেই।তো এসব সমালোচনা অবশ্য আমি কানে নিতাম না।যে ভালোবাসা আমার ওদের প্রতি তা স্বয়ং আমার পিতার মার খেয়েও যখন যায় নি তো ওখানে সমালোচনার প্রভাব পড়ার তো কোন অবকাশই নাই।

ওরা যতই বড় হতে লাগলো ততই আমার বকা খাওয়া এবং মার খাওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকলো।কারণ ওদের প্রাত্যহিক কাজের মাঝে আমার মায়ের হাঁস মুরগি খাওয়ার একটা মেনু যুক্ত হয়েছিল।ওরা যেন কিভাবে ঘুরে ফিরে আমার মায়ের হাঁস মুরগিগুলোকেই সাবাড় করতো।ভাবতো হয়তো অন্যজনের হাঁসমুরগি খেয়ে মনিবের জরিমানা করার চেয়ে মনিবকে দুই কথা শোনানোর চেয়ে ঘরের ফার্মে যে ডিশ আছে তা দিয়েই ডিনার সাড়া ভালো।ওরা এটা বুঝতো না যে ঘরের ডিনারের কারণেই মনিবের উপর দিয়ে স্টীম রোলার চলতো।ওরা যে কোন ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমার হাঁস মুরগি চিনতো তা আল্লাহ্ পাকই ভালো জানে।হয়তো বা সপ্তম ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যা ওদেরকে আগে থেকেই বলে দিত আমাদের হাঁসমুরগির ব্যাপারে।কেননা ওদের ভিজুয়ালিটি আমাদের ভিজুয়ালিটি হতে সম্পূর্ণ আলাদা।

তারপর আমার মার এবং বকা খাওয়ার সাথে সাথে চলতে থাকে ওদের বেড়ে ওঠা।এক পর্য়ে অবশ্য মার এবং বকা খাওয়ার ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।এরই মধ্যে কেটে যায় দেড়টি বছর।ওরা তখন পরিপূর্ণ বয়সের কুকুর।রাতে নিয়মিত এলাকা পাহাড়া দেয়া ওদের সহজাত প্রবৃত্তি।অপরিচিত কাউকে দেখলে ঘেউ ঘেউ এর সাথে তার প্যান্ট কামড়ে ধরা ছিল ওদের স্বভাব।যার ফলশ্রুতিতে এলাকায় চুরি জাতীয় যে শব্দটি ছিল তা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

আমার সাথে সাথে ওদেরও বিচরণ ছিল যেখানে যেখানে যেতাম।এলাকায় সমবয়সী সবার কাছে আলাদাভাবে দাম পেতাম ওদের কারণে।দু একজন যাদের সাথে মনমালিন্য ছিল তারাও ভালোভাবে ব্যবহার করত ওদের কারণে।ব্যাপারগুলো ভালোই লাগতো।সবাই আমাকে কুকুরপ্রেমী হিসেবে ভালোভাবেই চিনতো।পশু হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ইনজেকশন দিয়েছিলাম ওদের।বলা তো যায় না অবলা অবুঝ প্রাণী যদি আবার কাউকে কামড়ে দেয় এই ভয়ে।তবে ইনজেকশন দেওয়ায় ওদের যতটুকু যন্ত্রণা না হত তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি যন্ত্রণা আমার হত ওদেরকে অগাধ ভালোবাসার কারণে।

ওদের নানা রকম খুঁনসুটি খেলাধুলা দেখতে আমার ভালোই লাগতো।আমার জগতের একটা বিশাল অংশ জুড়ে ওদের বিস্তৃতি ছিল।আস্তে আস্তে বাবা মার বকাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ওদের প্রতি আমার
অনুভূতি বোঝার পর।
শুধুমাত্র ফরহাদ একজন মুরুব্বিকে কামড়ে দিয়েছিল ওকে ঢিল ছোঁড়ার কারণে।তখন একবার মার খেতে হয়েছিল।আমিও সেদিন ওদেরকে লাথি দেই যার যণ্ত্রণাটা আমি পরক্ষণেই বুকের গভীরে টের পাই।আমার জিনিসপত্র যেমন জুতা মোজা এগুলো অগোছালো করাই ছিল ওদের পছন্দের কাজ।জুতা নিয়ে গিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতো।এখানে ওখানে ছুটাছুটি করত কিন্তু জুতা দিত না।হাতে কিছু একটা নেওয়ার সাথে সাথে(লাঠি বা ঢিল)জুতা আমার কিছুটা সামনে রেখে দৌড়ে পালাত।একবার আমি একটা ছোট জায়গায় পুঁইশাকের বীজ বপন করি।মাটি খুনতি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ভালোভাবে বীজ বপন করে ঠিক করে রাখি।ওরা তখন অধীর আগ্রহে আমার কাজ করা দেখছিল।তারপর বিকালে এসে দেখি আমার বৃক্ষরোপণ নার্সারীর সে কি বেহাল দশা।শিরি ফরহাদ ওই জায়গাটা খুঁচিয়ে একেবারে নাযেহাল করে দিয়েছে।পরে বুঝলাম আমার খোঁচাখুঁচি দেখে তারা অনুপ্রাণিত হয়ে এগুলো করেছিল।এসে এমনভাবে দাঁড়িয়েছিল যে অসাধ্য সাধন করে ফেলেছে।পরে ওকে হাত নেড়ে বিভিন্ন ইশারায় বুঝিয়েছিলাম যে এটা এভাবে করতে হয় না নষ্ট হয়ে যায় এটা সেটা।বুঝেছিল কিনা কে জানে কিন্তু পরবর্তীতে আর এসব ঘটনা তারা ঘটায়নি।

দেখতে দেখতে ওদের প্রজননকাল এসে পড়ল।ওদের বিভিন্ন খুঁনসুটি আমি বিরক্ত না হয়েই দেখতাম।ওখানে ভিন্ন কোন উদ্দেশ্য বা মনোভাব কোনটাই ছিল না।ওদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসাটার কারণেই হয়তো এমনটা হত।যাক প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় শিরি অন্তঃসত্ত্বা হল।ফরহাদের চেহারাতেও একটা পৌরুষের দাম্ভিকতা চলে এলো।ওদের নামকরণের ব্যাপারটাতে অবশ্য আমার অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।কারণ এই নাম দুটির পবিত্রতা ক্ষুন্ন হওয়ায় সবাই আমাকে একটু ভিন্ন চোখেই দেখতো।বলতে গেলে মানসিক রোগী হিসেবেই বলা চলে।

একদিন রাতে কি কারণে যেন ফরহাদ খুব চেচাচ্ছিল।আমি বেশ কয়েকবার বের হয়ে দেখেছি কিন্তু বিরূপ কোন কিছু দেখতে পাইনি সেখানে।তার পরেও কেন জানি সে অস্থির চিত্তে চেচাচ্ছিল।কুকুরগুলো বলতে গেলে আমার খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিল।আমি ওদের সাথে প্রায়ই কথা বলতাম।বুঝতো কিনা জানি না।সেদিনও অনেক কথা বলে অনেক কিছু বুঝাতে চেয়েছি।তারপরেও ফরহাদের থামার কোন নামই নেই।কোন এক অজানা রহস্যজনক কারণবশত মনটা খারাপ হয়ে গেল।সে রাতে ঘুমটাও ভালো হয়নি আমার।

পরদিন সকালে কোন একটা কারণে বাইরে যাওয়ায় দুপুরে বাসায় ফিরি।ফিরে যা দেখি তাতে আমার সহ্যশক্তির একটা তীব্র পরীক্ষা নেয়া হয় বলে মনে হল হঠাৎ করে।দেখলাম যে ফরহাদ শুয়ে আছে আর মুখ থেকে অঝোরে লালা ঝরছে।ভাবলাম যে গরমের কারণে হয়তো বা।শিরি পাগলের মত দৌড়ে এসে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো আর ফরহাদের আশেপাশে বিষণ্ণভাবে ঘুরতে লাগলো।ফরহাদ ধীরে ধীরে উঠে কোঁ কোঁ করতে করতে আমার কাছে এলো।তখনই আমার বুকটা কামড়ে ধরলো।ওর যে খুব কষ্ট হচ্ছে তা ওর স্বরেই বোঝা গেল।শিরিও খুব অস্থিরচিত্তে ছোটাছুটি করতে লাগলো ফরহাদকে ঘিরে।আমি পাগলের মত ভঙ্গি করতে লাগলাম অস্থির হয়ে।মা পুরো ব্যাপারটাই দেখছিলো এবং আমার অস্থিরতা দেখে বললো যে ওকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে।তাড়াতাড়ি তেঁতুল খাওয়াতে।আমি হুড়মুড় করে দৌড়ে গিয়ে ঘরে জিনিসপত্র পাগলের মত এলোমেলো করে তেঁতুল খুঁজতে লাগলাম।তারপর নিজ হাতে তা গুলিয়ে ওর মুখে ঢাললাম।ফরহাদ ধীরে ধীরে ওর শোবার জায়গায় চলে গেল।ওর শোবার জায়গা ছিল আমাদের ঘরের পেছনে দেয়ালের আড়ালে।আমি ভাবলাম বোধ হয় ওর ভালো লাগছে একটু তাই হয়তো ওখানে গেছে বিশ্রাম নিতে।এর মধ্যে আমি এলোপাথারি গালি দিতে লাগলাম,“এক বাপের বেটা হলে সামনে আয়,কে বিষ খাওয়াইছিস,কার কি ক্ষতি করেছিল এই অবলা প্রাণী”।আমার সন্দেহ ছিল যে কিছু কুলাঙ্গার প্রেমিক প্রেমিকা যারা প্রেমের নামে রাতের বেলা সবাই ঘুমানোর পর অশালীন কাজকর্মে লিপ্ত হয় তারাই করেছে এই কাজ।কিন্তু ওরা তো পরিচিত কাউকে কিছু বলতো না।তো কে বিষ খাওয়ালো ওকে?অনেক প্রশ্ন নিজের মনে রহস্যের ঝড় তুলতে থাকলো।ভাবতে ভাবতে আমাদের ঘরের পেছনে ফরহাদ যেখানে থাকে সেখানে গিয়ে দেখি ফরহাদ নেই।শিরি কুঁ কুঁ শব্দ করে আমার পায়ে এসে মাথা ঘেষছিল।তখন আমার অজান্তেই কখন জানি আমার চোখ গড়িয়ে অঝোরে কান্না ঝরছিল আমি বলতে পারবো না।শিরির ব্যকুল আর্তনাদ দেখে বুঝলাম যে ফরহাদ চলে গেছে।তারপর বেশ কয়েকদিন খুঁজেছি কোথাও পাইনি ফরহাদকে।হায়রে পশুপাখিতেও যে অভিমান এত দৃঢ় হতে পারে তা তখন বুঝেছিলাম।কোথায় গেছে,বেঁচে আছে না মারা গেছে কোন খবরই আর পাওয়া যায়নি ফরহাদের।

তারপর বেশ কয়েকদিন মন খুব খারাপ ছিল।টানা কয়েকদিন খাবার নামেনি গলা দিয়ে।দেখলাম যে পরিবারের সবারই মোটামুটি মন খারাপ।মনে মনে ।ভাবলাম আর হাসতে লাগলাম যে যাদেরকে পালন করার জন্য একসময় কত বকা মার খেয়েছি আজ তার শোকেই তাদের মন খরাপ।হায়রে দুনিয়ার কি নির্মম নিষ্ঠুর বিধান।একটা পশুর জন্য এত মায়া কোথা থেকে কখন কিভাবে জন্ম নিলো তা বুঝতেই পারিনি।

একটা ব্যাপার লক্ষ্য করতে লাগলাম যে শিরিও দিন দিন মুষড়ে পড়ছে।কেমন যেন প্রাণহীন হয়ে গেছে।আগের মত তার খাওয়া দাওয়া খুঁনসুটিতে মন নেই।আমার কাছেও তেমন ভিড়ে না।সারাদিন ওখানেই শুয়ে থাকে বাসার পেছনে।ভাবলাম যে আমি মানুষ হয়ে ওদের প্রতি যদি এই অনুভূতি থাকে আর ওরা তো স্বজাতি।প্রিয়তম হারানোর প্রভাব তো একটু আকটু পড়তেই পারে।ভাবলাম যে বাচ্চা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিছুদিন পর একদিন সকালে দেখলাম যে বাড়ির পেছন থেকে কিচমিচ শব্দ আসছে।যা আন্দাজ করলাম তাই।গিয়ে দেখি আমার ফরহাদের রেখে যাওয়া স্মৃতির শেষ অংশগুলো শিরির কোলে জড়োসড়ো হয়ে আছে আর কিচমিচ করছে।দেখেই চোখ ছলছল করে উঠলো আমার।কি সুন্দর উপহার দিয়ে গেছে আমাকে ফরহাদ।ও থাকলে যে কি খুশি হত বলার মত না।কিছুক্ষণ পর ঘুম ভাঙ্গা চোখে ভালোভাবে চেয়ে দেখি যে শিরি নড়ছে না।তারপর আমি ডাক দিলাম কোন সাড়াশব্দ নেই।বেশ কয়েকবার ডাক দেওয়ার পর ওর গায়ে হাত দিয়ে নাড়ানোর চেষ্টা করি দেখি ও নড়ে না।শরীর পুরো শক্ত হয়ে গেছে।বুঝতে দেরী হল না যে ও মারা গেছে।তারপর চোখ বেয়ে নামতে লাগলো অবিরত শ্রোতের ঢল।

আরে নাম না হয় শিরি ফরহাদ রেখেছিলাম কিন্তু তাই বলে সেই নামের স্বার্থকতা ধরে রাখার জন্য জীবন বিসর্জন দিয়ে তো আমাকে কাঁদাতে বলি নাই।ভুল তো আমারই,নাম আমি রেখেছি সাজা তো আমাকেই পেতে হবে।শিরি প্রমাণ করে দিয়ে গেলো তার প্রিয়তম ফরহাদের প্রতি তার ভালোবাসার জোর সম্পর্কে।পৃথিবীর বুকে দ্বিতীয়বার শিরি ফরহাদের প্রেম কাহিনীর পুনরাবৃত্তি হল আমার চোখের সামনে।
খুব বড় মাপের একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম মানসিকভাবে যা সামলে নেয়া অনেক মুশকিল হয়ে গিয়েছিল বেশ কিছু সময়।কিছু কিছু অস্বাভিকতাও নাকি এসেছিল আমার মধ্যে।একা একা বসে থাকা,ঠিকমত খাওয়া দাওয়া না করা,মন ভার করে রাখা,বেশি মানুষ সহ্য না হওয়া সহ আরও বেশ কিছু।

সবচেয়ে কাছের বন্ধু হারালে যে কি কষ্ট হয় তা যদি সবাই বুঝতো তাহলে হয়তো সবার আচরণেও এই ধরণের অস্বাভাবিকতা দেখা যেত।কত যে কেঁদেছি ওদের জন্য তার কোন হিসাব নেই।

তারপর কেমন যেন পাথর হয়ে গেল মনটা।বিভিন্ন ছেলেপেলে এসে ওর বাচ্চাগুলো নিয়ে যায়।জানি না আমার শিরি ফরহাদের কোন অংশ আজও বেঁচে আছে কিনা।থাকলে কোথায় আছে,কেমন আছে, কিভাবে কি।তারপর থেকে আজ পর্যন্ত কোন পশুপাখি পালন করি নাই।পশুপাখির মৃত্যুর খবরগুলোও সহজভাবে নিতে পারি না।শুনলেই ওদের কথা মনে পড়ে।আর ওদের কথা মনে পড়লে আজও মনটা ভার হয়ে যায়।শতচেষ্টা করেও ওদের ভুলতে পারিনি আর হয়তো কোনদিনও পারবোও না।অমর গাঁথা মানুষ কখনও ভুলতে পারে না।ওটাই ছিল আমার জীবনের একটা অসীম যন্ত্রণার কাল আর ওটাই ছিল আমার দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার নজির।

মাঝে মাঝে খুব বেশি মিস করি তোদেরকে।খুব ভার হয়ে যায় মনটা জানিস।এক মুহুর্তে ফিরে যাই
সেই সােনালী দিনগুলিতে যেখানে মিশে ছিলি তোরা।জানি সে সময়গুলো আর আসবে না।আমার কি মনে হয় জানিস?তোরা আমাকে আমার থেকেও বেশি মিস করিস।যাক আর বেশি কথা বলে বেদনা বাড়াবো না।তোরা যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস শিরি,ফরহাদ। 🙁 (-3

রাহাত হোসেন

0 Shares

একটি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ