যাযাবর প্রেম

রোকসানা খন্দকার রুকু ১২ মার্চ ২০২১, শুক্রবার, ০৫:২৪:৩৭অপরাহ্ন গল্প ২২ মন্তব্য

প্লাষ্টিক দিয়ে বানানো ছইয়ের মত ছোট ছোট টুকরি ঘর। প্রতিটি ঘরেই অনেকগুলো করে মানুষ। শীত, গ্রীষ্ম সব উপেক্ষা করেই তারা বসবাস করে। একটা বড় পাতিলে দিনে একবারই রান্না হয়। কখনো কাজ পায়, কখনো পায় না। কাজের উপর খাবার-দাবার ডিপেন্ড করে।গোল হয়ে নারী- পুরুষের গল্প আর ঠোঁট লাল করে পান খাবার দৃশ্য দেখে তাদের পরিপুর্ন সুখী বলেই মনে হয়।এ দৃশ্য নবনির্মিত একটি পার্কের। অনেকগুলো ছোট ছোট টুকরি ঘরে বসবাস অসংখ্য মানুষ; যাদের আমরা যাযাবর বলি।তাদের খাবারের অভাব, বাসস্থানের অভাব শুধু বোধহয় ভালোবাসার  অভাব নেই!

আজ সন্ধ্যায় ফারহান চলে গেল! বড় কোন বিষয় ছিলনা তার চলে যাবার মত! আমি মাত্র বাইরে থেকে ফিরেছি। সে বাসাতেই ছিল। দরজা খুলে হাল্কা কাশি দিল; আমি হাত দিয়ে জ্বর দেখলাম। কিছুটা গা গরম। বললাম, কফি খাবে কিনা! খাবে এবং একটু বাদে রাতের খাবারও খাবে। মুড অফ বলে মনে হল! ফারহানই কফি বানায়, আজ উঠছেই না। আমি অবাক হলাম না, কফি বানালাম। ধোয়া তোলা কফি হাতে সে জানাল, কিছুদিনের জন্য নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে যেতে চায়। জানি প্রশ্ন করে লাভ হবে না, তাই চুপ থাকলাম। বুঝতেও পারলাম, এ যাওয়া কদিনের জন্য নয়! এর আগেও সে গিয়েছিল, এত বড় লাগেজ নিয়ে যায়নি।কিন্তু আমাদের মাঝে সমস্যা তো কিছু হয়নি। সংসার ও সম্পর্ক যেমন  চলার ;তেমনি চলছিল। আমার চেয়ে সেই বরং বেশি খুশি ছিল।

আমাদের পরিচয় দু’বছর হবে। বুদ্ধিদীপ্ত লম্বা,পাতলা দোহারা গড়নের মানুষটার মাঝে পাগল হয়ে যাবার মত বিশেষ কিছু ছিল না; কিন্তু আমি পাগল হয়ে গেলাম।এরপর সে মাঝে মাঝেই আমার বাসায় বেড়াতে আসতে লাগল। একদিন সন্ধ্যার পরেও চলে যাবার নাম নিচ্ছে না। সেদিন সে থেকেই গেল এবং পরের দিন বিকেলে বিরাট বড় লাগেজ নিয়ে হাজির।ঠিক আজকের মতই!

আমাদের একসাথে কাটানো সময় গুলো স্বপ্নের মত যেতে লাগল। এ এক অন্যরকম স্বপ্নময় জীবন যেখানে কোন কমতি বলে কিছু নেই। দুজনের অফিস সেরে একসাথে বাড়ি ফেরা, মাঝেমাঝে বেশরাত পর্যন্ত বাইরে ঘুরে  বেড়ানো। হলিডে-অকেশনে বেড়াতে যাওয়া সব এত মধুময় ছিল যে, কখোনো মনেই হয়নি আমাদের শেষটা এমন হবে!

আমি একা থাকতাম আর একটু অগোছালো বলে সংসারের দুরঅবস্থা ছিল। ফারহান আসার দু- দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসের লিষ্ট করে ফেলল। অফিসের পরে দুজনে গেলাম ‘বেষ্ট বাই’ এ। এতটা কেয়ারিং কি করে হয়! আমি একটু অবাকই হলাম। একটা একটা করে প্রয়োজনীয় সকল জিনিস কিনে ফেলল, যাতে আমি দর্শকমাত্র। ভাবলাম আমি শুধু রান্নাটাই যা টুকটাক পারি! চমৎকার করে সব গুছিয়ে ঝকঝকে বসবাসযোগ্য করে গড়ে তুলল ছোট্ট বাসাটি। দেখে মনে হল যেন স্বপ্নের সংসার!

সে যাবার পর আমিও মায়ের কাছে চলে এলাম। কারণ অনেকদিনের অভ্যাস, হঠাৎ তার অনুপস্থিতি মেনে নেয়া আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব ছিল। দুদিন পর এক বিকেলে সে বারবার ফোন দিচ্ছিল, আমার সাথে জরুরী কথা আছে। আমি ভাবলাম ক্ষমা চাইবে হয়ত। দেখা হবার পর সে প্রশ্ন করল,” আমি বাসায় নেই কেন? লোকদেখানো যাচ্ছেতাই ব্যাপার করার বয়স নয় এটা। আর আমাদের সম্পর্ক তো শেষ হয়নি। বিকেলে চা হবে, কফি হবে, বেড়াতে যাব, আড্ডাও দেব, শুধু রাতে ঘুমাবো আলাদা। আমি কেন যেন রাজী হয়ে গেলাম।

দুজনে রিকসায় যাচ্ছি নদীর পাড়ের দিকে, কিন্তু আগের মত আর কাছাকাছি নেই। হাত ধরে ছাড়া আমরা কখোনোই বসতাম না, তাও নেই। আমি অনেক কথা বলি, সে চুপচাপ শোনে। আজ আমরা কেউ কোন কথা বলছি না। নদীর পাড়ের চায়ের সেই অমৃত স্বাদ যেন বিস্বাদ হয়ে গেছে।

সন্ধ্যায় দুজনে কফি হাতে চুপচাপ, শুধু টিভিটাই বকর বকর করে যাচ্ছে। রাতের খাবারেও চুপচাপ, তাকে এটা ওটা তুলে দিতাম, আজ দিতে ইচ্ছে হল না। বেশিদিন এভাবে চলল না। কারন কথা ফুরিয়ে গেলে জীবন চলে না। দুজন একসময় এমনিতেই আলাদা হয়ে গেলাম। এখন ফোনেও তেমন কথা হয় না।

এতকিছুর পরও আমি খুব মিস করছিলাম তার সাথে কাটানো সময়; গুড মর্নিং কফি আর বিদায়ের চুমুটা। কফিটা বেশ ভালোই বানাতে শিখে গিয়েছিল। খুব চেষ্টা করলাম অবশেষে না পেরে কফি বাদ দিতেই হল।তার পছন্দের খাবারগুলোও বাদ দিলাম। অবশ্য এর ভীষণ ভালো একটা দিকও আছে। প্রেমের সময়গুলোতে সুখের ঠেলায় শরীরে বেশ তেল- চর্বি জমে যায়। পরে যেগুলো কমানো খুবই জরুরী ও কষ্টকর! ব্রেকআপের সুফলে চা,কফি, খাবার কোনটিতেই টেষ্ট যেহেতু নেই। সেহেতু

ভাবছি এই ফাঁকেই তেল-চর্বি কমেটমে শরীরটা অন্তত ঝরঝরে হয়ে উঠুক!

তার স্মৃতিগুলোকে কিছুতেই পিছু ছাড়াতে পারছিলাম না। সত্যিকারের ভালোবাসার স্মৃতি সহজে মোছাযায় না। বরং দিনে দিনে বাড়তেই থাকে ও ভারী হয়! ফারহান সংসার সাজাতে তার কেনা জিনিস সবই রেখে গেল। আমি সেগুলোর কিছুই ব্যবহার করতে পারছিলাম না।দেখলেই বুকের ভেতর অসহ্য যন্তনারা শুধু মোচড় দেয়। অবশেষে প্যাক করে একজায়গায় গুছিয়ে রাখলাম। মাঝে মাঝে বের করে পরিস্কার করি অবশ্য তা চোখের পানি দিয়ে।

কারও বুকে লাথি মারা মানুষরা ভীষনরকম ফরমাল হয়। কঠিন কোনকিছু করে ফেলার পরও ঠান্ডা মাথায় চলে। লোকজন বুঝতেও পারেনা তিনি এই মাত্র কারও মন ভেঙ্গে তছনছ করে এলেন। প্রেমের বাজার এজন্যই এদের ভীষন চড়া। কিছুদিন যাবে এরপর আবার বডশি ফেলবে এবং বোকা কোন জন টপ করে গিলবে। এরা মোটামুটি জান দিয়ে ফেলার মত একটা আচরন করে। এবং সে আচরন সবার সাথেই করে। মুচকি হাসি মাখা সমাজের অতি ভদ্র মানুষ। যাকে কোনভাবেই ব্লেইম করার মত কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্রেকআপের বেলায় তাদের কোন দোষ থাকে না। নির্দোষ পক্ষই দোষী হয়ে সারাজীবন কাটায়। এখানেও পরচিতজনরা আমাকেই দোষী ভাবল এবং আমিও সেভাবেই কাটাতে লাগলাম।

সেদিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরছিলাম হঠাৎ চোখে পড়ল ফারহান। সে রিকশায় হুড ফেলে যাচ্ছে। অবশ্য একা নয়, অন্যকেউ সাথে আছে। তার বয়স আমার থেকেও অনেক কম হবে। হাতে হাত রেখে,মনোযোগ দিয়ে হাসিমাখা মুখে শুনে যাচ্ছে মেয়েটির বকর বকর। কৌতূহলবশত পিছু নিলাম। হ্যাঁ, রিক্সা থেমে গেল ‘বেষ্ট বাই’এর সামনে।পথ দেখিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল মেয়েটিকে। হয়ত কেনাকাটা করবে নতুন সংসারের!!!!

ছবি- নেট থেকে।

0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ