মামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-১৮)

শামীম চৌধুরী ২৭ আগস্ট ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৮:২৮পূর্বাহ্ন ভ্রমণ ১৭ মন্তব্য
আগের পর্বের লিঙ্ক- মামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-১৭)
পর্ব-১৮
সন্ধ্যা ৭:৩০মিনিটে আমরা হোটেল রুমে পৌছালাম। সারাদিন একটানা ছবির জন্য বনের ভিতর হেঁটে ক্লান্ত ছিলাম। যতক্ষন ছবি তোলায় ব্যাস্ত ছিলাম ততক্ষন আরাম-আয়েশের কোন সুযোগ ছিল না। কাজের মাঝে থাকলে কখন যে সময় চলে যায় তা উপলব্ধি করা যায় না। আর সেই কাজ যদি হয় ফটোগ্রাফী তা’হলে তো কথাই নেই।
 
হোটেল রুমে গোসলটা সেরে নিলাম। গোসলের পর শরীরে চাঙ্গা ভাব চলে আসলো। কিছুক্ষন পর হোটেল বয় এক কাপ কফি ও দোচা দিয়ে গেল। তৃপ্তি সহকারে কফির পেয়ালায় চুমুকের সঙ্গে সঙ্গে মনটা সতেজ হয়ে গেল। আমরা সবাই পরিশ্রান্ত ছিলাম। যার জন্য কারো সঙ্গে তেমন কোন কথা বলার ইচ্ছে হলো না। এক সময় আমি তন্দ্রায় চলে গেলাম। আমার ছেলে যে, বনের পরিবেশটা খুব উপভোগ করেছে তা বুঝতে পারলাম। সে নিজের তোলা ছবিগুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো। কখন যে রাত ১০টা বেঁজে গেছে বলতে পারবো না। আমাদের ট্যুর অপারেটর সুজিত বেরা রাতের খাবারের জন্য ঘুম থেকে জাগালো। ওয়াশরুমে ফ্রেস হয়ে হোটেলের ক্যান্টিনে খেতে বসলাম। রাজস্থানে সবাই নিরামিষভোজী। মাছ-মাংসের কোন ব্যাবস্থা নেই। খাবারের ম্যানু ছিলো সব্জি ডাল, পনির মাসালাম, আলুর দম, রুটি ও ভাত। সঙ্গে পর্যাপ্ত সালাদ এবং দইয়ের লাচ্ছি। খাবার টেবিলে সারাদিনের কাজের সার-সংক্ষেপ আলোচনা করলাম। যার পুরাটা জুড়েই ছিলো ফটোগ্রাফীর।
 
রুমে এসে বিছানায় শরীরটা ছেড়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘড়িতে ভোর পাঁচটার এলার্ম দেয়া ছিল। শীতের সকাল। ঘুম থেকে উঠতে আলসেমে লাগছিলো। তারপরও বনের ভিতর সকাল সকাল প্রবেশ করতে হবে। আমার সতীর্থরা সবাই প্রস্তুত হয়ে নিলো। আমি প্রকৃতির কাজ সেরে চটজলদি তৈরী হয়ে সবাইকে সঙ্গে করে বের হয়ে গেলাম।
 
আজ আমাদের ভ্রমনের ৪র্থ দিন। হোটেলের খুব কাছেই কেওলাদেও ন্যাশনাল পার্ক হওয়ায় সকাল ৬টায় বনের মূল ফটকে পৌছে গেলাম। সকালের নাস্তা বলতে ভিতরের ক্যান্টিনে এলাচ ও আদার মিশ্রণে এক কাপ দুধ চা ও বিস্কিট। জীতেন সহ অন্যান্য রিক্সার বাহকরা আমাদের অপেক্ষায় ছিলো। জীতেন আমাদের সবার জন্য বনের প্রবেশ টিকিট সংগ্রহ কর আনলো। এরই মধ্যে আমরা আলোচনা করে নিলাম কোথা থেকে শুরু করবো। সবার মতামত ছিলো ১ নাম্বার জোন থেকে শুরু করা হোক। তাতে একটা সুবিধা হবে আমরা ২ নাম্বার জোন কভার করে পর্যায়ক্রমে ৩,৪,৫,৬ নাম্বারেও যেতে পারবো। সঙ্গীদের সিদ্ধান্ত আমার পছন্দ হলো।
 
বনের পাহারাদারদের যাবতীয় আনুসাঙ্গিকতা শেষে এক নাম্বার জোনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ২০ মিনিটের মধ্যে জোনের প্রবেশমুখে পৌছালাম। মুল সড়কের দুই পাশ তখনও কুয়াশায় আচ্ছন্ন। শীতের সকাল প্রচন্ড বাতাস। ঠান্ডায় হাত জমে যাবার উপক্রম। তারপরও ঠান্ডাকে তোয়াক্কা না করে নতুন কিছু অর্জনের লোভে গরম অনুভব করলাম। রিক্সা থেকে নেমে মূল সড়কের হাতের ডানে সরু মেঠোপথ ধরে ভিতরে প্রবেশ করলাম।
 
এই জোনটা শুধু জলাশয়ে ঘেরা। প্রচু জলজ উদ্ভিদের দেখা পেলাম। আর জলজ পাখির অভয়ারণ্য হলো ১ নাম্বার জোন। এখানে ৩৫ প্রজাতির হরেক রকমের হাঁস জাতীয় পাখি। তার মধ্যে বেশ কয়েক প্রজাতির বক জাতীয় পাখির দেখা পেলাম গাছের ডালে মাছ শিকারের আশায় বসে আছে। আমার কাংখিত Black-headed Ibis বা কালো-মাথা কাস্তেচরা পাখিটি খুব কাছে পেয়ে উত্তেজনায় শরীরে কম্পন শুরু হলো। শরীরে ঠান্ডার কোন অনুভবই নেই। যদিও এই পাখি দেশে তুলছি। তারপরও এত কাছে পাইনি। যাকে বলে ফুল ফ্রেম। আমার সঙ্গীরা অন্যান্য পাখি তোলায় ব্যাস্ত ছিলো। আমি অন্য পাখির প্রতি মনোনিবেশ না করে কাস্তেচরা পাখিটিকে নিয়ে ব্যাস্ত রইলাম। ভাল ভাল বেশ কয়েকটি ফুলফ্রেম ছবি নিলাম। আনন্দে মনটা ভরে গেল। পাখিটির ছবি ও পরিচিতি আমার পাঠক বন্ধুদের কাছে তুলে ধরলাম।
Black-headed Ibis বা কালো-মাথা কাস্তেচরা।
অনেকেই মনে করেন এরা পরিযায়ী পাখি। আসলে এরা পরিযায়ী পাখি না। আমাদের দেশের দূর্লভ পাখি।
‘কাস্তেচরা’ Threskionis পরিবারের অন্তর্ভুক্ত মাঝারি আকারের ৭৫ সেঃমিঃ দৈর্ঘ্যের জলচর পাখি। বয়স্ক পাখির মাথা ও ঘাড় পালকহীন। ঠোঁট নীচে বাঁকানো ও কালো রঙের। মাথা ও ঘাড় ছাড়া পুরো দেহ সাদা। ঘাড়ের গোড়ায় কিছু পালক ঝুলে থাকতে দেখা যায়। ডানা সাদা-ঢাকনিতে ধুসর আভা। বুকে হলুদ আভা।
অনেক সময় কাঁধে সাদা পালক থাকে। ঘাড় নীলচে কালো। চোখ লাল বাদামী। পা লম্বা। পায়ের পাতা কুচকুচে কালো। প্রজনন সময় পুরুষ পাখির ঘাড়ে পালকে সজ্জিত থাকে। পুরুষ ও মেয়ে পাখির চেহেরায় ভিন্নতা আছে। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথা ও ঘাড়ের নীচের অংশ কালো ও নরম পালক থাকে। ঘাড়ের সামনের অংশ সাদা।
‘কাস্তেচরা’ জলাভূমি, নদী, তৃণভূমি, ধানক্ষেত, কাদাচরা ও উপকূলের জোয়ার-ভাটার খাঁড়িতে বিচরন করে। এরা সচারচর দল বেঁধে থাকে। একেকটি ঝাঁকে অন্তত ২০০-২৫০ পাখি দেখা যায়। কাদা বালু ও অগভীর পানিতে ঠোঁট ঢুকিয়ে এরা খাবার খুঁজে খায়। মাছ, ব্যাঙ, ছোট শামুক, কেঁচো, পোকা উদ্ভিদ জাতীয় শৈবাল এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে। শীত মৌসুমে এরা নীরব থাকে, কিন্তু গরমের সময় ঘোঁত ঘোঁত শব্দ করে ডাকে। উড়ার সময় এরা বকের মত গলা ভাঁজ করে না।
 
জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এদের প্রজনন সময় প্রজননকালে বক ও পানকৌড়ির সাথে মিশে যায়। পানির ধারে জলমগ্ন গাছে কিংবা গ্রামের কুঞ্জবনে ডালপালা দিয়ে ছোট মাচার মত বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় মেয়ে পাখিটি ২-৪টি সাদা ডিম পাড়ে। ২০-২৫ দিনের মাথায় ডিম থেকে বাচ্চা ফুঁটে। মা-বাবা উভয়েই বাচ্চাদের লালন-পালন করে।
‘কাস্তেচরা’ আমাদের দেশের দূর্লভ আবাসিক পাখি। শীত মৌসুমে বরিশাল, হাতিয়ার নিঝুমদ্বীপ, মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ, শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিল, টাঙ্গুয়ার হাওড়, রাজশাহীর পদ্মার চর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ভোলায় দেখা যায়। ইহা ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, সহ এশিয়ার অনেক দেশেই এদের বিচরন রয়েছে। সারা বিশ্বে ৫ প্রজাতির ‘কাস্তেচরা’ আছে। কিন্তু আমাদের দেশে ১ প্রজাতি দেখা যায়।
Black-headed Ibis বা কালো-মাথা কাস্তেচরা Flight mood.
 
এখানে হরেক প্রজাতির পাখির ছবি তুললাম। যার মধ্যে Rose- ringed parakeet বা সবুজ টিয়া, Baikal-Teal বা তিলা হাঁস, Bar-headed goose বা দাগী রাজহাঁস, Purple Heron বা বেগুনী বক, Western Marsh Herier. বা পশ্চিমা পানকাপাসি, Indian spotted Eagle বা গুটি ঈগল উল্লেখ যোগ্য।
Rose- ringed parakeet বা সবুজ টিয়া।
Baikal-Teal বা তিলা হাঁস।
Bar-headed goose বা দাগী রাজহাঁস।
R Purple Heron বা বেগুনী বক।
 Western Marsh Herier বা পশ্চিমা পানকাপাসি।
Indian spotted Eagle বা গুটি ঈগল।
আমরা ১ নাম্বার জোন শেষ করে সামনের দিকে অগ্রসর হলাম।
(চলবে)
0 Shares

১৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ