মানুষগুলো কেবলই মনে করিয়ে দেয়

রিমি রুম্মান ২১ এপ্রিল ২০১৬, বৃহস্পতিবার, ০৮:৪১:৫৭অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২০ মন্তব্য

বৈশাখী সাজে আমায় দেখে চমকে উঠে ইভন। বললাম, আজ আমাদের নিউ ইয়ার। শুভ নববর্ষ। ইভন পাল্টা বলে উঠে, সবো নববর্ষ। আমি হো হো করে হেসে উঠি। বলি, "সবো" নয়, বলো "শুভ"। এবার ঠিক ঠিক বলে। একবার নয়, দু'বার নয়, পরপর তিনবার। চমৎকার উচ্চারণ। বিদেশিনীর মুখে সঠিক বাংলা উচ্চারণ ! ভেতরটায় অদ্ভুত এক ভালোলাগা খেলে যায়।

পাশেই মানুষজনের কোলাহল। বৈশাখী কনসার্ট। শেষ বিকেলের হিমেল হাওয়া আর অস্তমিত সূর্যের তাপহীন সোনালি রোদে ব্রডওয়ের কর্নারে দাঁড়িয়ে গল্প করছি আমরা। বলি, তোমার পরিবারের সবাই কেমন আছে ?

বলল___ ভাল, বেশ ভাল। তুমিই কেবল আমার পুরো পরিবারের কুশল জিজ্ঞেস করো। অন্যরা, কাছের মানুষগুলো, চেনা মানুষগুলো দেখা হলেই জানতে চায়, তোমার ছেলে এখন কেমন আছে, সুস্থ আছে তো ! ওদের প্রশ্নে এখন আমার ক্লান্ত লাগে, রাগ লাগে, বিরক্ত লাগে, ভীষণ বিরক্ত...

আমি একটু অবাক হই। বলি, একজন মা'কে তাঁর সন্তানের কুশলাদি জিজ্ঞেস করা কি দোষের ? ইভন বলে, " সে তুমি বুঝবে না, কিছু অনুভূতি বলে বুঝানোর নয় "। অতঃপর, কপালে, বুকের বাঁ পাশে, ডান পাশে হাত ছুঁয়ে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করার ভঙ্গিতে বলে, "ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, আমার ছেলেটি এখন পুরোপুরি সুস্থ, চমৎকার বাস্কেটবল খেলে। আজ তাঁর আঠারোতম জন্মদিন।" আমার ভালো লাগে জেনে। ভীষণ ভালো লাগে।

ইভন রিয়েলস্টেট কোম্পানিতে জব করে।
আজ থেকে সতেরো বছর আগে মাঝে মাঝেই সে আমাকে তাঁর গাড়িতে তুলে নিতো। এখানে ওখানে বাড়ি দেখাতে নিয়ে যেত। সেসময় বাড়ি দেখার উদ্দেশ্যে বেশ অনেকবার আমাদের দেখা, গল্প করা। সেই থেকেই আমরা আত্নার আত্মীয় হয়ে উঠেছিলাম। ওঁর এক বছর বয়সী ছেলেটির তখন ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা, কেমো থেরাপি চলছিলো। ইভন চার্চে যায়। প্রার্থনা করে। কাজ শেষে হাসপাতালে ছুটে। সে এক কঠিন সময় ছিল তাঁর পরিবারের।

ধাপে ধাপে চিকিৎসার অনেকগুলো পর্যায় অতিক্রম করতে হয়েছিল অনেকগুলো দিন, মাস, বছর। অতঃপর একাধিক পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ডাক্তার জানায়, শিশুটি পুরোপুরি সুস্থ। গত এক যুগ সময় ধরে সে আর দশটি সুস্থ সবল শিশুর মতই ছয় মাস কিংবা একবছরে একবার নিয়মিত চেকআপে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। এখন শিশুটি আঠারো বছরের উচ্ছল এক তরুন।

ইভন সেই কঠিন, দুঃস্বপ্নের সময়গুলো অতিক্রম করে এসেছে অনেক আগেই। কিন্তু আজো চেনা, কাছের মানুষগুলো দেখা হলেই সহানুভূতি কিংবা সহমর্মিতার জায়গা থেকে একজন মা'য়ের কাছে তাঁর সন্তানের কুশলাদি জানতে চায়। ইভন এতে ভীষণ বিরক্ত, ক্লান্ত। সে জানায়, তাঁর সন্তান পুরোপুরি সুস্থ। খেলছে, বন্ধুদের সাথে ঘুরছে, আনন্দ করছে। অথচ মানুষগুলো কেবলই মনে করিয়ে দেয়...... !!

কি অদ্ভুত মায়েদের মন, তাই না ?
বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন করে জানলাম, সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে আমরা আসলে কখনো কখনো মানুষের মনঃকষ্টেরও কারন হই।

রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ