বৈশাখী সাজে আমায় দেখে চমকে উঠে ইভন। বললাম, আজ আমাদের নিউ ইয়ার। শুভ নববর্ষ। ইভন পাল্টা বলে উঠে, সবো নববর্ষ। আমি হো হো করে হেসে উঠি। বলি, "সবো" নয়, বলো "শুভ"। এবার ঠিক ঠিক বলে। একবার নয়, দু'বার নয়, পরপর তিনবার। চমৎকার উচ্চারণ। বিদেশিনীর মুখে সঠিক বাংলা উচ্চারণ ! ভেতরটায় অদ্ভুত এক ভালোলাগা খেলে যায়।
পাশেই মানুষজনের কোলাহল। বৈশাখী কনসার্ট। শেষ বিকেলের হিমেল হাওয়া আর অস্তমিত সূর্যের তাপহীন সোনালি রোদে ব্রডওয়ের কর্নারে দাঁড়িয়ে গল্প করছি আমরা। বলি, তোমার পরিবারের সবাই কেমন আছে ?
বলল___ ভাল, বেশ ভাল। তুমিই কেবল আমার পুরো পরিবারের কুশল জিজ্ঞেস করো। অন্যরা, কাছের মানুষগুলো, চেনা মানুষগুলো দেখা হলেই জানতে চায়, তোমার ছেলে এখন কেমন আছে, সুস্থ আছে তো ! ওদের প্রশ্নে এখন আমার ক্লান্ত লাগে, রাগ লাগে, বিরক্ত লাগে, ভীষণ বিরক্ত...
আমি একটু অবাক হই। বলি, একজন মা'কে তাঁর সন্তানের কুশলাদি জিজ্ঞেস করা কি দোষের ? ইভন বলে, " সে তুমি বুঝবে না, কিছু অনুভূতি বলে বুঝানোর নয় "। অতঃপর, কপালে, বুকের বাঁ পাশে, ডান পাশে হাত ছুঁয়ে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করার ভঙ্গিতে বলে, "ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, আমার ছেলেটি এখন পুরোপুরি সুস্থ, চমৎকার বাস্কেটবল খেলে। আজ তাঁর আঠারোতম জন্মদিন।" আমার ভালো লাগে জেনে। ভীষণ ভালো লাগে।
ইভন রিয়েলস্টেট কোম্পানিতে জব করে।
আজ থেকে সতেরো বছর আগে মাঝে মাঝেই সে আমাকে তাঁর গাড়িতে তুলে নিতো। এখানে ওখানে বাড়ি দেখাতে নিয়ে যেত। সেসময় বাড়ি দেখার উদ্দেশ্যে বেশ অনেকবার আমাদের দেখা, গল্প করা। সেই থেকেই আমরা আত্নার আত্মীয় হয়ে উঠেছিলাম। ওঁর এক বছর বয়সী ছেলেটির তখন ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা, কেমো থেরাপি চলছিলো। ইভন চার্চে যায়। প্রার্থনা করে। কাজ শেষে হাসপাতালে ছুটে। সে এক কঠিন সময় ছিল তাঁর পরিবারের।
ধাপে ধাপে চিকিৎসার অনেকগুলো পর্যায় অতিক্রম করতে হয়েছিল অনেকগুলো দিন, মাস, বছর। অতঃপর একাধিক পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ডাক্তার জানায়, শিশুটি পুরোপুরি সুস্থ। গত এক যুগ সময় ধরে সে আর দশটি সুস্থ সবল শিশুর মতই ছয় মাস কিংবা একবছরে একবার নিয়মিত চেকআপে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। এখন শিশুটি আঠারো বছরের উচ্ছল এক তরুন।
ইভন সেই কঠিন, দুঃস্বপ্নের সময়গুলো অতিক্রম করে এসেছে অনেক আগেই। কিন্তু আজো চেনা, কাছের মানুষগুলো দেখা হলেই সহানুভূতি কিংবা সহমর্মিতার জায়গা থেকে একজন মা'য়ের কাছে তাঁর সন্তানের কুশলাদি জানতে চায়। ইভন এতে ভীষণ বিরক্ত, ক্লান্ত। সে জানায়, তাঁর সন্তান পুরোপুরি সুস্থ। খেলছে, বন্ধুদের সাথে ঘুরছে, আনন্দ করছে। অথচ মানুষগুলো কেবলই মনে করিয়ে দেয়...... !!
কি অদ্ভুত মায়েদের মন, তাই না ?
বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন করে জানলাম, সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে আমরা আসলে কখনো কখনো মানুষের মনঃকষ্টেরও কারন হই।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
২০টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
আমাদের মন বড়ই বিচিত্র।
রিমি রুম্মান
আসলেই… আর বিচিত্র এই মনের কথা বুঝা কঠিন …
ভাল থাকুন, শুভকামনা…
জিসান শা ইকরাম
হ্যাঁ সহানুভুতি দেখাতে গিয়ে আমরা অনেক সময় কষ্ট দিয়ে ফেলি
ইচ্ছেকৃত নয়, আমরা জানিও না যার প্রতি সহানুভুতি দেখাচ্ছি, তিনি এতে কষ্ট পেতে পারেন
এ থেকে পরিত্রানের উপায়ও নেই আমাদের,
এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে এধরনের অনিচ্ছাকৃত কষ্ট দেয়া কমতে পারে।
জীবন থেকে নেয়া ঘটনা থেকে আপনি যেভাবে সামাজিক বার্তা নিয়ে আসেন, এমন ভাবে বার্তা নিয়ে আসতে আমি অন্য কাউকে দেখিনি।
শুভকামনা।
রিমি রুম্মান
নতুন বছরের প্রথম দিনে নতুন কিছু জানলাম, শিখলাম… তাই সবার সাথে শেয়ার করা।
ভাল থাকুন সবসময়।
ব্লগার সজীব
আপু আপনি আপনার চারপাশের দেখা মানুষদের নিয়ে কত ভালো ভালো লেখা লিখছেন, আমিও তো প্রতিদিন কত এমন দেখি, তা গুছিয়েই তো লিখতে পারিনা। সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে আমরা আসলে কখনো কখনো মানুষের মনঃকষ্টেরও কারন হই (y) সহমত আপনার সাথে।
রিমি রুম্মান
এই যে মনঃকষ্ট … এটি কিন্তু আমাদের ইচ্ছাকৃত নয়। নতুন করে জানলাম।
আমি কিন্তু অনেক সুন্দর কথামালা দিয়ে লিখতে পারি না। যা দেখি, তা-ই লিখি। রাফ খাতা। 🙂
ব্লগার সজীব
আপনার রাফ খাতা তো আসল খাতা থেকেও মূল্যবান আপু 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
রিমি আপু যখন খুব খারাপ অবস্থায় ছিলাম, তখন অনেক ফোন আসতো। জানতে চাইতো কিভাবে হলো, এখন কি অবস্থা! অসহ্য হয়ে গিয়েছিলাম। বিরক্তি ধরে যেতো। ব্যথা নিয়ে হাসছি, কিন্তু যখনই কেউ বলতো আহারে, ইস মনে হতো এরা কি কেউ বোঝেনা? একটু কেন বোঝার চেষ্টা করেনা? পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে গেলাম ওয়াকার নিয়ে, সবাই এসে ইস রে এখন কেমন? আহারে মেয়েটা কি যে কষ্ট পাচ্ছে। ব্যথা কমে আছে, ওসব শুনে ব্যথা বেড়ে গেলো।
যাক ওসব কথা। ইভনের অবস্থা অনুভূতি কিছুটা হলেও বুঝতে পারি। আর ও তো মা, সন্তানের জন্যে মায়ের হৃদয় কেমন করে সেটা যারা মা তারা জানে।
রিমি রুম্মান
তাই তো নীলাদি, তুমিই তো খুব কাছের ভুক্তভুগি ! ভুলেই গিয়েছিলাম।
এখন তোমার মনের অবস্থাটাও আঁচ করতে পারছি। ভাল থেকো। নিরাপদ থেকো।
নীলাঞ্জনা নীলা
আপু ভালো আছি, ভালো থেকো
আমাকে একটা চিঠি লিখো। 🙂
লীলাবতী
যে কষ্টকর দিনগুলোকে মানুষ ভুলে যেতে চায়, তা কেউ মনে করিয়ে দিলে আসলেই মানুষ কষ্ট পায়। খুবই সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করলেন আপু।
রিমি রুম্মান
ভাল থেকো লীলা’পু।
অনেক শুভকামনা।
মৌনতা রিতু
এটাই বাস্তবতা। কেউ কখনোই কারো মনের অবস্থা জানতে চায় না। ওর আঠার বছরের জন্মদিনে শুভেচ্ছা রইল।
রিমি রুম্মান
মনের অবস্থাটুকু বুঝা আসলেই কঠিন ।
শুভকামনা …
খসড়া
ভাল লাগল, লেখাটা অবেগাপ্লুর করে দিল।
রিমি রুম্মান
অনেক শুভকামনা রইলো।
মেহেরী তাজ
কষ্টের দিনের কথা কাওকে মনে না করিয়ে দেওয়াই উচিৎ। যা মানুষ ভুলে যেতে চায় তা ভুলে যাওয়ায় ভালো! 🙂
এতো আইডিয়া আপনার মাথায় আসে কি ভাবে আপু???
রিমি রুম্মান
যা কিছু দেখি, লিখি তার সামান্য কিছু। লিখব লিখব করে সময় করতে পারি না। যখন একটু সময় বের করে আনি, ততক্ষণে ভুলে যাই সেই বিষয়টি … 🙂
মোঃ মজিবর রহমান
মন বড়ই অচেনা। বুঝা যায় না।
কস্টের দিন স্বরন করা আর কস্টের।
স্বাভাবিক জিবনের চলার ব্যাপার বা ঘটনা আপনি সুন্দর করে উপস্থাপনা করতে পারেন।
সুভেচ্ছা অবিরত।
রিমি রুম্মান
শুভকামনা জানবেন। দেরি করে উত্তর দেয়ার জন্য দুঃখিত ।