মাই হিরু নং ৩।

ইমন ২ আগস্ট ২০১৫, রবিবার, ১২:২৩:২৩পূর্বাহ্ন বিবিধ ২০ মন্তব্য

আমার বন্ধু শান্ত।

ফহিন্নীর পুত ছিলো। 🙂
আমরা ক্লাস সেভেন পর্যন্ত এক সাথে পড়াশুনা করেছি। সাড়ে তিন মাইল পথ পায়ে হেটে আমি আর শান্ত হাই স্কুলে আসতাম।
আমার বন্ধু শান্ত!
একটা শাদা শার্ট পড়ে সিক্স সেভেন পর্যন্ত ক্লাস করেছে। বুক পকেটে ইকোনো কলমের কালি লেপ্টে থাকা সেই শার্ট এখনো আমার চুখে জ্বল জ্বল করে....
সে সব সময় পকেটে হাত দিয়ে রাখতো। যাতে কেও তার এই দৈন্যতা না দেখে। ...
আমার বন্ধু শান্ত।
কালি লেগে থাকা পকেটের ঠিক নিচে ওর বিশাল বড় কলিজা ছিলো। আর সেই কলিজায় টগবগে রক্তের সাথে ছিলো টুইটম্বুর করা সাহস। শান্ত যে গ্রামে থাকত আমরা সেই পাড়াটাকে বলতাম 'ফহিন্নি গাও' . গ্রামের মূল নাম ছিলো ' বৈলাবো '।
আমারা ফহিন্নি গাও ডাকতাম, কারণ ওই গ্রামের মেক্সিমাম মানুষ (পুরুষ &; মহিলা) ভিক্ষা করতো।
শান্তর বাবা মা দুজনেই ভিক্ষা করতো । আমি সহ আমদের বাকি বন্ধুরা শান্তকে খেপাতাম 'ফহিন্নির পুত ' বলে। শৈশবের হাতাহাতি , মারামারিতে আমরা ওকে একটা গালিই দিতাম সেটা হচ্ছে 'ফহিন্নির পুত'।
ক্লাস ফোরে যেবার রুজা রেখে মরতে বসেছিলাম ! সেবার কোনো বন্ধুর চুখ ভিজেনি আমাড় কষ্ট দেখে! কিন্তু শান্তর চুখ ভিজেছিল। সে কেঁদেছিল। তাঁরপর থেকে শান্তকে আর 'ফহিন্নির পুত ' বলতাম না। কেউ বললে তাকে উল্টা মারতাম আমি। সয্য করতে পারতাম না। মেরে মুখ ফাটিয়ে দিতাম।
আমার বন্ধু শান্ত।
হঠাৎ স্কুলে আসা বন্ধ করে দিলো। টানা চারদিন সে স্কুলে আসেনা। আমি তাদের বাড়িতে যাই। গিয়ে শুনি শান্ত চায়ের স্টলে কাজ নিয়েছে। সে আর পড়াশুনা করবেনা। তার মা এখন থালা নিয়ে হাটতে পারেনা। ২ বোন সহ পাঁচজনের সংসার চলবে কিভাবে!
তাই শান্ত কে চায়ের স্টলে দিয়ে দিছে উর বাবা।
আমাদের বাজারে শান্ত যে চায়ের স্টলে কাজ নিছে , সেখানে গেলাম। আমাকে দেখে শান্ত চোখ তুলে আর তাকায়না। স্কুল পালান, স্কুলে না যাওয়া আমাদের সমাজে এখনো একটা বিরাট অপরাধ বৈকি। আমার সরল বন্ধু শান্তর চুখে তা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
- ইমন চা খাবি ?
-না। তুই তাহলে আর স্কুলে যাবিনে!
-নারে ভাই। কাম না করলে মায় খাইবো কি! কোমর লইয়া মায় হাটতে পারেনা।
এসব কথার পরে আর কোনো কথা কি জবানে ফুটে! চুপ করে আছি .... কি করবো, কি বলবো ! কেবল খারাপ লাগতাছে এই ভেবে যে, আমি শান্তকে অনেকবার 'ফহিন্নির পুত' বলে গালি দিছি....
শান্ত চায়ের কাপ নিয়ে আমার পাশে এসে বসল-
-ইমন আমি আমার বাপেরেও আর হাটতে দিমুনে। এইহানে আমি মাসে ২৫০ টাহা পামু। টাহা জমাইয়া নিজে দোকান দিমু, দেখিস।
আমি তখনো কিছুই বলতে পারতেছিনে। আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছেনা। কান্না কোনো ভাবেই থামাতে পারতেছিনে।
-শান্ত, আমি যাইগা। আমার স্যার আইবো আমারে পড়াইতে।
তারপরে কেটে গেছে বহুদিন। আমি বাজারে যাইতাম না শুধু শান্তর সাথে আমার দেখা হয়ে যাবে বলে। আমার দুস্ত চায়ের স্টলে কাজ করে তা দেখতে আমার ভালো লাগতোনা । তবো মাঝে মাঝে যেতে হোতো। শান্ত কে দেখে শুধু মুচকি হাসি দিয়ে পাশ কাটাতাম।
তারপরে চলে গেছে কয়েক বছর।
আমি ক্রিকেট , পড়াশুনা নিয়ে ব্যাস্ত। শান্তকে প্রায় ভুলেই গেছি।
তারপরে কলেজ। নারী, প্রেম,প্রতারণা, স্বপ্ন, ক্রিকেটার, আমার কি আর সময় আছে 'ফহিন্নির পুতের' খবর রাখার !
গতো ঈদে বাড়িতে গিয়ে বাজারে গেছি ফোন ঠিক করতে। বাজারের ঠিক মোড়েই দেখি একটা মোবাইল এক্সেসরিসের দোকান। দোকানে ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম ফোনের ফ্লাশ দেয়া যাবে কিনা। মাথা নিচে করে একটা লোক কাজ করতেছে।
বললো, - হ। কি সেট?
কণ্ঠটা শুনে ধক করে উঠলো বুকের ভিতরটা !
- এই কে !
- আরে ইমন তুই! কেমুন আছস ! কতদিন পরে দেখা! - শান্ত! তুই! ভালো আছি। তুই তো অনেক মোটা হয়ে গেছিস 🙂
- হরে ভাই। সারাদিন দোকানে বইসা থাকি। তর কি খবর? মানুষ বড়োলোক হইয়া গেলে কি গরীবের কথা ভুইলা যায়?
- নারে দু্স্ত। ঠিক তা না। তুই তো জানস আমি বাজারে কম আসি। তাছাড়া ঢাকায় গেলামগা পড়তে। বাড়িতে একদিনের জন্য আসি। কোথাও বের হওয়া হয়না।
শান্ত: - চা খাবি ? চল। বাজারে আমার একটা হোটেল আছে। ভালো চা বানায় ওইটাতে।
আর এই দোকানটা দুস্ত আমার 🙂
- তাই নাকি! বাহ!
চা খেলাম একসাথে। গল্প হলো অনেক। শান্তর মা-বাবা মারা গেছে। সে বিয়ে করেছে। তার একটা মেয়ে আছে ৩ বছরের। সে ওই চায়ের স্টলে থেকে টাকা জমিয়ে বাজারে একটা ভিটা নিয়ে চা বিক্রি করতো। তারপরে আস্তে আস্তে টাকা জমিয়ে একটা ভাত-মাছের বাংলা হোটেল দিছে। ২ বছর হলো একটা মোবাইল এক্সেসরিসের দোকান দিছে।
আমার বন্ধু শান্ত। 🙂
তার কথা রেখেছে।
সেদিনের পর থেকে তার মা কে আর হাটতে হয়নি। তার বাবাকেও সে আর হাটতে দেয়নি। শান্ত এখন আর 'ফহিন্নির পুত' না। শান্ত এখন সমাজের দশ জনের একজন।
বাড়িতে এসে শান্তকে একটা ফোন দিলাম,
- শান্ত , বন্ধু তরে অনেক সময় 'ফহিন্নির পুত' বলে গালি দিতাম, মজা করতাম। মাফ করে দিস বন্ধু।
- ধুর বেডা কি কস। এইগুলাতো তোরা দুষ্টামি করে কইতি।!!!
বুক থেকে বিরাট একটা পাথরের বোঝা নেমে গেলো। যে বন্ধু ছিলো সমাজের সবচেয়ে নীচ একটা ক্লাসের , যে একটা চায়ের স্টলে চা বানাতো সে আমাকে চুখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো কাজের কোনো ছোটো বড় নাই। ইচ্ছা আর সাহস থাকলে পাশার দান উল্টে যেতে পারে যে কোনো মূহুর্তে। উদ্দেশ্য যার মহৎ এবং সৎ হয় তাহলে ভাগ্য & বিধাতা দুজনই তার সাথে থাকে।
শান্তর উদ্দেশ্য একটাই ছিলো। সে তার বাবা-মা কে ভিক্ষা করতে দিবেনা।
আমার বন্ধু শান্ত পেরেছে।
শান্ত you made me proud man 🙂

I love you man 🙂
https://www.facebook.com/rong.janina/posts/714483972017345?comment_id=714686408663768&offset=0&total_comments=40&ref=notif&notif_t=feed_comment

0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ