ভাল থাকুক আমাদের সন্তানরা

রিমি রুম্মান ১৮ আগস্ট ২০১৬, বৃহস্পতিবার, ১২:২০:০০অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ১৭ মন্তব্য

রিয়াসাত এবং সাহান নিউইয়র্কের এলিমেন্টারি (প্রাইমারী) স্কুলে ক্লাসমেট ছিল। দু'জনার মাঝে প্রতিযোগিতা ছিল বেশ। লেখাপড়ায় সাহান এগিয়ে ছিল অনেকটাই। পরীক্ষায় নাম্বার কম পেলে রিয়াসাত মনখারাপ করে থাকতো। বাড়ি ফেরার সময় অর্ধেকটা পথ অশ্রু জলে ভাসতো। আর আমি তাঁকে বুঝাতাম, নিশ্চয়ই পরেরবার তুমি ভাল করবে, যা নাম্বার পেয়েছ, তাতে আমি অনেক খুশি...। অতঃপর আমি তাঁকে হাসির গল্প বলতাম, অদ্ভুত সব অভিনয় করে দেখাতাম, এবং আমরা মা-ছেলে হাসতে হাসতে বাকিটুকু পথ বাড়ি ফিরতাম।

সেই সময়ে পড়াশোনার নিয়মিত অংশ হিসেবে লাইব্রেরী থেকে বই এনে রিয়াসাতকে নেচে, গেয়ে, অভিনয় করে পড়ে শুনাই। সে খিলখিল করে হাসে। কম্পিউটারে ম্যাথ নিয়ে বসি। কুইজ খেলি। তাঁর সাথে আমিও যেন আরেকজন সমবয়সী শিশু। দু'জনে মিলে পড়া পড়া খেলায় মেতে উঠি। থার্ড গ্রেড থেকে রিয়াসাত ভালো ফলাফল করতে শুরু করে। স্কুল ছুটি শেষে আমরা মায়েরা বাচ্চাদের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। যেন নীরব জিজ্ঞাসা "আজ কেমন নাম্বার পেয়েছ ?" । ওরাও যেন চোখের ভাষা বুঝে নিয়েছে। এসেই বলতে থাকে। সাহান যেদিন ভাল নাম্বার পায়না, সেদিন ওর মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা একদিকে খিঁচুনির মত করে নাড়তে থাকে থেমে থেমে। বিষয়টি ওর মা-ই আমাকে দেখায় একদিন। ভয়ে, আতংকে নাকি এমনটি করে। এরপর থেকে মনের অজান্তেই সবসময় সেদিকে মনোযোগ চলে যেতো। দেখতাম, আসলেই তো !

সকালে এবং স্কুল ছুটির সময়ে সাহান এর মা এবং আমি স্কুল গেটে যখন গল্প করি, তখন বুঝতে পারি যে তিনি ভীষণ কড়া এবং রাগী মা। নিজেই জানালেন, ছেলে ভাল রেজাল্ট না করলে কন্‌কনে শীতের দিনেও তাঁকে বাড়ির বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখেন এক ঘণ্টা। আর বলেন, "এটা তোমার পানিশমেন্ট"। শাস্তিস্বরূপ আরো কি কি করেন, শুনে আমি বিস্ময়ে চেয়ে থাকি। বলি, "এমনটি করবেন না।এতে ভালোর চেয়ে খারাপই হবে বেশি।"

মাঝে মাঝে স্কুল ছুটির সময়ে সাহানের মা'কে দেখি না। রিয়াসাতকে জিজ্ঞেস করে শুনি সেদিন সাহান স্কুলে আসেনি। ফোন করি। ভাবি, অসুখ বিসুখ হোল কিনা ! ওর মা জানায়, সাহানের সাইকোলজিস্ট এর সাথে রুটিন এপয়েনমেন্ট ছিল। আমি একটু অবাক হই। নিজেই বললেন, ডাক্তার প্রতিবারই মা এবং ছেলের সাথে আলাদাভাবে একাকি কথা বলেন। সাহানের মা'কে একাধিকবার সতর্ক করে দিয়েছেন এই বলে যে, "তুমি ছেলে চাও, নাকি রেজাল্ট ? যদি ছেলে চাও, তাঁকে তাঁর মত করে থাকতে দাও, আচরনে নমনীয় এবং বন্ধুসুলভ হও"। কিন্তু তিনি কিছুতেই এটি মানতে নারাজ। ছেলেকে যে ভাল রেজাল্ট করতেই হবে, যে কোন ভাবেই হোক।

এখন সাহান এবং রিয়াসাত দূরের মিডল স্কুলে অষ্টম গ্রেডে পড়ে। একাকি পাবলিক বাসে স্কুলে যায়। নিজেদের পড়া নিজেরাই বুঝে। আমায় আর নেচে, গেয়ে, অভিনয় করে পড়াতে হয় না। দিনভর গেইম খেলা রিয়াসাত কেমন করে ভাল রেজাল্ট করে, অনারেবল এ্যাওয়ার্ড পায়, স্টুডেন্ট অফ দ্যা মান্থ হয়__ বুঝি না। এদিকে ছোটবেলায় এগিয়ে থাকা সাহান মোটামুটি রেজাল্ট নিয়ে পিছিয়ে আছে। আমাদের মায়েদেরও আর দেখা হয় না, গল্প হয় না। মাঝে মধ্যে ফোনে কথা হয় অল্পবিস্তর। যেহেতু আসছে অক্টোবরে ওদের পরীক্ষা, তাই পড়াশোনা, প্রস্তুতি__ এসব জানার জন্যে ফোন দেই। জানলাম, ইদানিং সাহান তাঁর মাকে এড়িয়ে চলে, দূরে দূরে থাকে, প্রচুর মিথ্যে বলে, মিথ্যে ধরিয়ে দিলে কিংবা জেরা করলে বলে, "সত্য বললে তো তুমি চিৎকার চেঁচামেচি করবে, তাই মিথ্যে বলি"। আমি চম্‌কে উঠি। যে ছেলেটি মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতো না ভয়ে, সে ক্যামন করে এমন হোল !

ফোন রাখার আগে সাহানের মা ছোট্ট শ্বাস নিয়ে আক্ষেপের স্বরে বললেন, "ওরে আমার দুই চক্ষে দেখতে ইচ্ছা করে না, কি আর করবো জীবনে, ম্যাকডোনাল্ডসে কামলা দিবো আর কি "।

ফোন কেটে দেয়ার শব্দ কানে এলো। চুপটি করে বসে থাকি ব্যালকনিতে। সাহানের মত আমার চেনা আরও কয়েকজনের কথা মনে পড়ে গেল। যারা তাঁদের কিশোরমনে তীব্র ঘৃণা লালন করে নিজ নিজ বাবা-মায়ের প্রতি। বাবা-মায়ের সাথে হাসি, আনন্দে মেতে থাকা কোন শৈশব স্মৃতি নেই তাঁদের। আছে শুধু শাসনের নামে নরক যন্ত্রণার এক শৈশব, কৈশোর।

এ পর্যন্ত লেখার পর আমার ছয় বছরের রিহান বিস্কিট খেতে খেতে সামনে এলো।
আমি বলি, " রিহান, ভাল করে চাবায়ে খাও"।
জবাবে সে বলল, "আমি বালো করে চাবা করি তো " !   🙂

ভাল থাকুক আমাদের সন্তানেরা। ভাল থাকুন সকলে।

রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

0 Shares

১৭টি মন্তব্য

  • ছাইরাছ হেলাল

    বেশ গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয় তুলে ধরেছেন।
    জোর জবরদস্তি করে কোন কিছুই আদায় করা যায় না।
    শিশুদের বেলায় বিষয়টি আরও জটিল,
    মায়েদের অনেক কিছুই শিখতে হবে, আপন শিশুটির কল্যাণের জন্য।

  • ইঞ্জা

    কি বলবো বুঝতে পারছিনা, আমি নিজেই বাচ্চাদের শাস্তির বিরুদ্ধ যে কারণে আমার বাচ্চারা অন্য ধাতুতে গড়া, ওদের সাথে আমি বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক রাখি যে কারণে ওদের সব জানা অজানা কথা আমি জানি, আমার বাচ্চারা এখন বন্ধুবৎসল, ওদের আমি একা বাইরে যেতে দিই না আর এতে তাদের তেমন অমতো নেই।
    শুভকামনা আপু।

  • আবু খায়ের আনিছ

    তোমার সন্তানেরা তোমার সন্তান নয়। তারা জীবনের জন্য জীবনের আকুল প্রত্যাশার পুত্র-কণ্যা মাত্র। তারা তোমাদের মাধ্যমে আসে কিন্তু তোমাদের ভিতরে জন্ম নেয় না। এবং তারা যদিও তোমাদের সাথে থাকে তারা তোমাদের সম্পদ নয়।
    তোমরা তোমাদের ভালোবাসা দিতে পারো কিন্তু তোমাদের ভাবনা দিও না। কারণ তাদের নিজস্ব ভাবনা আছে। তোমরা তাদের দেহকে ঘরে আটকে রাখতে পারো কিন্তু আত্মাকে ধরে রাখতে পারো না। কারণ তাদের আত্মার বসবাস ভবিষ্যতের গৃহে, তোমাদের স্বপ্নেও তোমরা সেই গৃহের সন্ধান পাও না।
    তোমরা তাদের মতো হওয়ার চেষ্টা করতে পারো কিন্তু তাদেরকে তোমাদের মতো করার চেষ্টা করিও না। কারণ জীবন পশ্চাতপানে চলে না, ফেলে আসা দিনের জন্য দাঁড়িয়েও থাকে না।

    খলিল জিব্রান এর এই কথার চেয়ে উপযুক্ত মন্তব্য আর খুজেঁ পেলাম না আমি।

  • নীলাঞ্জনা নীলা

    রিমি আপু দারুণ লিখেছো। আমরা সন্তানকে নিজস্ব সম্পত্তি মনে করি। তাদের উপর আমাদের অভিভাবকত্ত্ব সম্পন্ন খবরদারী করি। অথচ এই খবরদারী যে কতোটা ক্ষতিকর সন্তানের জন্য আমরা জেনে-বুঝেও করি। অথচ একটু আদরে ওরা সব করে। আমার তীর্থকেই তো দেখি রেগে গিয়ে কিছু করতে বললে ওর মধ্যে মারাত্মক ক্ষোভের জন্ম হয়। আবার আদর করে বললে সেই কাজ মুহূর্তে করে ফেলে। আমাদের বাঙ্গালী অভিভাবকের মন-মানসিকতার মধ্যে সন্তানদের শিক্ষাগত সনদ নিয়ে প্রচন্ড বাড়াবাড়ি দেখি। আর এর কারণেই বেশীরভাগ ছেলে-মেয়ে শিক্ষিত যন্ত্র হয়, কিন্তু জ্ঞানের মন্ত্র ধারণ করেনা।

    বাবা-মা হিসেবে সন্তান অন্যায় করলে অবশ্যই শাসন করা উচিৎ, কিন্তু সেই শাসন যেনো অত্যাচার কিংবা নির্যাতন হয়ে না দাঁড়ায়।
    রিমি আপু তোমার রিয়াসাত অনেক বড়ো মানুষ হোক। ভালো থেকো তোমরা। -{@

  • মৌনতা রিতু

    এসব পোষ্ট পড়লে আমি রাগে উত্তেজিত হয়ে যাই। ওসব গার্জিয়ান মা না ,,,,,,,,,,,। ভাল রেজাল্ট সবাই চাই, কিন্তু সে তার নিজের মতো করেই আগাক না। আমরা শুধু হাতটা ধরে থাকব। বাংলাদেশের অবস্থা তো আরো খারাপ। বললে পোষ্ট ছেড়ে পালাবে সবাই। আমার মেমন রিয়ানের টিচারদের কাছে কখনোই জিজ্ঞেস করিনা, কততম হল। হ্যাঁ, তারা দুজনেই, খুবই সিনসিয়ার। খুব প্রেস্টিজ। মার্ক কম পেলে ওরাই কেন যেন ক্লাসমেটদের দেখায় না। মেমন সোনাকে তো একবার এক গার্জিয়ান, বাবার বয়েজ স্কুলের ক্লাস থেকে ডেকে নিয়ে জেরা শুরু করেছিল, ছেলে আমার ভয়ে কি অবস্থা ! পাঠ্য বই এর বাইরে যে অন্য বইও পড়া উচিত , তাদের মানসিক বিকাশের জন্য, এটা যেন কেউ বোঝেই না।
    সন্তান যদি প্রকৃতার মতো বেড়ে না ওঠে, তবে সে রুক্ষ হয়ে যাবে।
    অনেক সেন্দর একটা পোষ্ট।

    • রিমি রুম্মান

      নিউইয়র্কের স্কুলগুলোয় কততম বলে কোন কথা নেই। রেজাল্ট যেন গোপনীয় বিষয়। কারোটা কেউ জানতে পারে না। এরা ভীষণ প্রাইভেসী মেইন্‌টেইন করে। একবার এ ব্যাপারে শিক্ষককে জিজ্ঞেস করে জানলাম, এতে শিশুদের মনের উপর প্রভাব পড়ে। একজন ভাল করছে, অন্যজন ভাল করছে না… এতে তাঁদের ভেতরে কমপ্লেক্স কাজ করে। আমি শুনে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। শিশুদের বিষয়গুলো কতটা স্পর্শকাতর এবং গুরুত্ব বহন করে এদেশে।

  • অনিকেত নন্দিনী

    স্কুলে থাকার সুবাদে দেখি আপু স্কুলের বাচ্চাদের মায়েরা কেমন করে। তাদের কোথাও কিছু একটা ভুল হলে যদি নাম্বার কেটে দেই তো পরদিন কোমরে আঁচল জড়িয়ে হাজির হয়ে যায়, জিজ্ঞেস করে কেন এমন নাম্বার কাটা গেলো। কম নাম্বার পাওয়া কিছু বাচ্চা খুব ভয় পায়, তাদের মায়েরা খুব রাগ করবে সেই কথা বলে। রিপোর্ট কার্ড দেয়ার দিন মায়েদের যে অভিব্যক্তি দেখি তাতে মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি হয়তো মা হিসাবে খুব অধম। কারণ আমি বাচ্চাদের স্কুলে গিয়ে তাদের টিচারদের সাথে কথা বলিনা, তাদের সহপাঠীদের রিপোর্ট কার্ডের সাথে তাদের প্রাপ্ত নাম্বার মিলিয়ে দেখিনা। সত্যি বলতে কী, বাচ্চা কম নাম্বার পেলে মারামারির কী আছে তাই বুঝিনা। আমার বাচ্চাদের আমি কখনোই পড়াশোনা নিয়ে কিছু বলিনা। তারা তাদের নিজের ইচ্ছেমত পড়ে।
    ছোটবেলায় এইভাবে চাপ দেয়াটা একেবারেই অনুচিত। এতে বাচ্চারা পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারায়ই, বাবামায়ের উপরও যারপরনাই বিরক্ত হয়।

  • মিষ্টি জিন

    অনেক দিন বাচ্চাদের মাঝে ছিলাম.আরলি চাইল্ডহুড এডুকেশনের উপর একটা কোর্স ও করেঁছি । বাচ্চারা যে কত ব্রেনি হয়ে জন্মায় কোর্স করার সমঁয় বুঝেছি।
    ফ্যামিলি থেকে পড়াশুনা এবং অন্যান্য ব্যাপারে অত্যাধিক প্রেসারের কারনে একটা সময় এই ব্রেন বাচ্চারা আর কাজে খাটাতে পারে না।মানুষিক ভাবে অসুস্হ হয়ে পরে ।
    অনেক শিক্ষনিয় একটা পোষ্ট ।

  • জিসান শা ইকরাম

    সন্তান লালন পালন কিভাবে করতে হয়, তাই আমাদের দেশের অনেক অবিভাবক জানেন না,
    ছেলে এবং মেয়েদের আসলে স্কুলে এই নিয়ে একটি বিষয় থাকলে ভাল হয়,
    যেটি নবম শ্রেনী হতে ইন্টার পর্যন্ত থাকবে।

    আপনি একজন আধুনিক আদর্শ মা,
    আপনি আপনার নিজস্ব জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে সন্তানকে পড়িয়েছেন, পড়ায় আগ্রহী করে তুলেছেন,
    একটি শিক্ষামূলক লেখা এটি,
    ধন্যবাদ এমন একটি লেখা দেয়ার জন্য।
    শুভকামনা সকল সন্তানের জন্য।

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ