ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিলো।

শামীম চৌধুরী ১০ নভেম্বর ২০২০, মঙ্গলবার, ০৭:৪৯:৫০অপরাহ্ন পরিবেশ ১৬ মন্তব্য
ঢাকা শহরের মধ্যে খুব নিরিবিলি একটি স্পট ও পাখির বিচরন ক্ষেত্র ছিলো শেরে-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। খুবই স্বল্প পরিসরে গবেষনা ও ছাত্রদের ব্যাবহারিক মাঠ কাজের জন্য শেরে-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় ছোট্ট একটি মাঠে নানান জাতের ধান,সরিষা,পাট,ভূ্ট্টার চাষ হতো। আর আমাদের দেশীয় পাখিরা সেখানে মনের সুখে তাদের খাবারের সুযোগ পেতো। সময়টা ছিলো ২০১২ সালের নভেম্বর মাস। আমি পাখির ছবি তোলার জন্য নিয়ম করে প্রতি শুক্র ও শনিবার শেরে-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম। ছোট্ট পরিসরে হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস জুড়ে পাখিদের অবাধ বিচরন ছিল। এক কথায় অভয়াশ্রম বললেও ভুল হবে না। সুবজ টিয়া, মদনা টিয়া, চার প্রজাতির মুনিয়া, বাবুই, সবুজ সুঁইচোরা, তিন প্রজাতির মাছরাঙা, দুই প্রজাতির খঞ্জনা, ঘুঘু, হুদহুদ, কানিবক,পানকৌড়ি সহ হরেক প্রজাতির পাখি দেখা যেত। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস অনেকটািই পাখি শূন্য।
 

কোন এক শুক্রবার আমি সুঁইচোরা পাখির ছবি তুলছি। অথচ আমার সামনে পাকা ধানে বসে আরামসে পাখিটি ধান খাচ্ছে। সেই দিকে আমার নজর নেই। সুঁইচোরা জুড়ে নেশা কাজ করছিলো। তার মূল কারন সুঁইচোরা পাখিটি প্রথম দেখা ও ছবি তোলা। তাই বেশ উত্তেজনা নিয়েই ছবি তুলছিলাম। সুঁইচোরার প্রায় চারশত ছবি তোলার পর পাখিটি উড়ে যায়। ক্যামেরার ডিসপ্লেতে ছবি দেখছি। এমন সময় আমার ৫ফুটের মধ্যে পাকা ধানের ভিতর থেকে টু..উই...টুই...উই শব্দ কানে ভেসে আসলো। এমন ডাকের সঙ্গে পূর্ব পরিচয় না থাকায় বুঝতে পারলাম না কোন পাখির ডাক। হঠাৎ আমার চোখের সামনে দিয়ে দুটি পাখি উড়ে গেল। লেজ দেখে বুঝতে পারলাম টিয়া পাখি। আমার ধারনা ছিল সবুজ টিয়া পাখিই হবে হয়তো। তাই তেমন আগ্রহ ছিল না। কিছুক্ষন পর পাখি দুটি আবার ধান খাওয়ার জন্য এসে বসলো। আমি নিজেকে আড়াল করে নিলাম। ধান ক্ষেতে শুয়ে পড়লাম। আস্তে আস্তে মাথা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করলাম এটা কোন টিয়া। পাখিটিকে ভাল করে খেয়াল করার পর আমার মাথায় বাজ পড়ার মতন উপক্রম হলো। এমন টিয়াপাখি পূর্বে কোনদিন দেখিনি। সময় নষ্ট না করে ছবি তোলা শুরু করলাম। বেশ কয়েকটি ছবি তোলার পর আবার ওরা উড়ে গেল। পরে পাখিটি সম্পর্কে জানতে পারি এটা Grey-headed parakeet বা ধূসর-মাথা টিয়া।

পরবর্তীতেও এই টিয়াপাখি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যম্পাস ও দেশের অন্য অঞ্চল থেকেও তুলেছি।
২০১২ সালের নভেম্বরে শেরে-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা পাখিগুলি আমাদের দেশে অতি বিরল ও সংকাটাপন্ন আবাসিক পাখি Psittacula পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ধূসর মাথা টিয়া পাখি। আবার অঞ্চল ভেদে কালো-মাথা টিয়া নামেও পরিচিত। এদের দৈর্ঘ্য ৩৬-৪০ সেঃমিঃ এবং ওজন ১১৫-১২০ গ্রাম। এরা লম্বা লেজের হলুদাভ সবুজ পাখি। এদের মাথা,কপাল, কান-ঢাকনি ও মুখমন্ডল ছাই ধুসর। থুতনিতে কালো রেখা ও গলায় সরু কালো রেখা দেখা যায়। পিঠ উজ্জ্বল সবুজ ও দেহতল হলুদাভ-সবুজ। লেজ সরু ও লম্বা হয় ও রং বেগুনী-নীল বর্ণের। চোখ হলুদ। পা ও পায়ের পাতা সবুজাভ। স্ত্রী ও পুরুষ পাখির মধ্যে সামান্য পার্থক্য দেখা যায়। পুরুষ আকারে কিছুটা বড় ও কাঁধে লাল পট্টি থাকে। যা স্ত্রী পাখির মধ্যে নেই।
 
এরা মূলতঃ চট্রগ্রামের চির সবুজ বনের পাখি। ঢাকা বিভাগে একবারই দেখা গিয়েছিলো। সেই হিসেবে আমার ভাগ্যটা সুপ্রসন্ন ছিল। লোকালয়ে দেখা যায় না। ইহাছাড়া পাহাড়ী সবুজ বনেও এদের বিচরন আছে। এরা দিবাচর ও বৃ্ক্ষচারী পাখি। সচারচর ছোট ছোট ঝাঁকে ও মাঝে মাঝে মাঝারী জাঁকে দেখা যায়। খাদ্যতালিকায় রয়েছে মিষ্টি রসাল পাকা ফল,শস্যদানা,কীট-পতঙ্গ। পাহাড়ি পাকা ফলের প্রতি এদের আসক্ত বেশী। খাবারের সময় মধুর সূরে ডাকে। উড়ার সময় তীক্ষ্ম ও কর্কশ স্বরে টুই..টুই...টুই শব্দে ডাকে।
 
ফেব্রুয়ারী থেকে মে মাস পর্যন্ত এদের প্রজননকাল। প্রজনন কালে গাছে খোঁড়লে বা অন্যান্য পাখির পরিত্যাক্ত খোঁড়লের বাসায় নিজেরা বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় স্ত্রী ৪-৫টা সাদা বর্ণের ডিম পাড়ে। ছেলে মেয়ে উভয়ে ডিমে তা দিয়ে ২৩/২৪ দিনে ছানা ফোঁটায়। মা-বাবা দুজনেই সংসারের যাবতীয় কাজ ও ছানাদের পরিচর্যা করে। এদের আয়ুস্কাল ৭-৮ বছর।
 
বাংলাদেশ ছাড়া ভারত,নেপাল,ভূটান,মিয়ানমার,পাকিস্তান সহ দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় এদের বিস্তৃত রয়েছে। বাংলাদেশের বণ্যপ্রাণী আইনে এরা সংরক্ষিত।
বাংলা নামঃ ধূসর-মাথা টিয়া
ইংরেজী নামঃ Grey-headed parakeet
বৈজ্ঞানিক নামঃ Psittacula finschii
ছবিগুলি ঢাকার শেরে-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তোলা।
0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ