গত বছরের শুরুর দিকে আমার এক কাজিন ফোন করে নিজের কন্যার জন্যে ছেলে দেখতে বললেন। কেমন ছেলে কন্যার উপযুক্ত পাত্র হিসেবে বিবেচিত হবে জানতে চাইলে বলেন, এদেশে বেড়ে উঠেছে, এবং এদেশেই লেখাপড়া শেষে ভালো একটি চাকুরি করছে এমন ছেলে হলেই চলবে। সবচেয়ে ভালো হয় নিজেদের চেনাজানা কেউ হলে। আমি মনে করার চেষ্টা করলাম চেনা বন্ধুদের কিংবা আত্নিয়দের কারো উপযুক্ত ছেলে আছে কিনা। তেমন কাউকে না পেয়ে জানালাম দেশে আমার চেনাজানা ভালো অনেক ছেলে আছে। কিন্তু আমার কাজিন একেবারেই নারাজ তাতে। যুক্তি দেখালেন এভাবে যে, এতে সাংস্কৃতিক বিরোধ দেখা দিবে। ছেলেমেয়ে দুইজন সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই দেশের দুই সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় হয় বলে তাঁদের মানসিকতা এবং দৃষ্টিভঙ্গিতেও দারুণ অমিল দেখা দিবে। নিশ্চিতভাবে চিন্তা-ভাবনার অমিল হবে। ভাষাগত সমস্যাও প্রকট আকার ধারণ করবে। ফলে নানাবিধ অমিলের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে দাম্পত্যজীবন জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠবে। তাঁরা খুব বেশিদিন একত্রে সংসার করতে পারবে না। এইসবই নাকি তাঁর চোখের সামনে দেখা কয়েকটি পরিবারে ঘটেছে, বিধায় তিনি সেই পথে হাঁটতে নারাজ।
দীর্ঘ এক বছর বাদে সম্প্রতি আমার সেই কাজিনের সাথে দেখা বাড়ির পাশের কুইন্স সেন্টার মলে। আমরা ফুডকোর্টে দুপুরের খাবার খেতে খেতে গল্প করছিলাম। এবার তিনি বেশ হতাশার সাথে জানালেন একমাত্র কন্যার বিয়ে দিবেন, নাতি-নাত্নি হবে, এমন বিষয়ে তিনি যে স্বপ্ন বুনেছিলেন এতদিন, সে স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে। অঝোরে কাঁদলেন। কন্যা নাকি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে মা’কে, সে বিয়ে নামক সম্পর্কে বিশ্বাসী নয়। বিয়ে করে সম্পূর্ণ অচেনা একজনকে তাঁর স্বাধীন জীবনের প্রতি খবরদারি করার সুযোগ সে দিতে চায় না। শ্বশুরবাড়ি সামলানো, বাচ্চা নেয়া, নিজের ক্যারিয়ার জলাঞ্জলি দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কন্যা কড়াভাবে আরও জানিয়ে দিয়েছে যে, বিবাহিত জীবনের ঝঞ্ঝাটের চেয়ে ‘ আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ জীবনই তাঁর কাম্য।
নিউইয়র্কে জন্ম এবং বেড়ে উঠা আমার এক বন্ধুপুত্রকে বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই বেশ বিরক্তির সাথে জানায়, ‘ বন্ধুদের কে কোথায় বিবাহিত জীবনে যন্ত্রণাকাতর হয়ে জীবন কাটাচ্ছে তা তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। সুতরাং বিয়ে মানেই নিজের মতো করে বাঁচা একটা জীবন থমকে দেয়া।’ ভাইয়ের কথায় সায় দিয়ে বন্ধুকন্যা অরুণিমা বলে উঠে, ‘ বিয়ে মানেই কি শুধু স্বামী- স্ত্রী একে অপরকে মানিয়ে নেয়া ? এখানে তো পুরো পরিবারের সাথে বোঝাপড়ার বিষয়টি উঠে আসে। বিয়ে মানেই সংস্কৃতির বিরোধ, অর্থনৈতিক বিরোধ, বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্ব। আমি এসবের মধ্য দিয়ে যেতে চাই না। এ দেশে আমাদের নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটে। বৈবাহিক সূত্রে পাওয়া নানান রকম সম্পর্ককে সময় দেয়ার সময় কোথায় ?’ সে এটাও যোগ করে যে, ‘ পঞ্চাশের পরে আমার হয়তো একাকীত্ব ঘোচানোর জন্যে একজন জীবন সঙ্গীর প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু তাই বলে এই পঁচিশ/তিরিশে কারো সাথে জড়িয়ে জীবনটাকে হেল করে দিতে চাই না। এই সময়টায় ‘ আপাতত রোমান্স’এ বিশ্বাসী আমি। ’
এই তো সেদিন কথা হচ্ছিল আমার এক সময়কার সহকর্মীর সাথে। নিউইয়র্কে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় তাঁর বাস। বাজারে, বাচ্চাদের স্কুলে, মসজিদে নিয়মিত যাতায়াতের সুবাদে এবং একই এলাকায় দীর্ঘদিন বসবাসের কারণে অসংখ্য বাংলাদেশি মায়েদের সাথে পরিচয়, চেনাজানা তাঁর। অধিকাংশ মায়েদের অভিযোগ ছেলেমেয়েরা ভালো পড়াশোনা করেছে, ভালো চাকুরিতে যোগ দিয়েছে, কিন্তু বিয়ের প্রসঙ্গে এলেই এড়িয়ে যাচ্ছে। হাইস্কুল কিংবা কলেজে পড়াকালীন সময়ে পরিবারের চাপে পড়াশুনা ব্যতিরেকে অন্য কোন দিকে মনোযোগ দিতে নিরুৎসাহিত হয়েছে এইসব ছেলেমেয়েরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সীমাহীন পড়ার চাপে সঙ্গী খোঁজা কিংবা সঙ্গীকে সময় দেয়ার কথা ভাবেনি। শেষে চাকুরি জীবনে প্রবেশ করে পেয়ে যায় স্বাধীন জীবনের স্বাদ। ভাবে, ‘ এই তো ব্যাচেলর জীবনে বেশ আছি, দিব্যি আছি।’ অবাধ স্বাধীনতার এক যাপিত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠে তাঁরা। যে জীবনে অফিস শেষে বন্ধুদের সাথে ডিনারে যাওয়া যায় নিশ্চিন্তে। যে জীবনে ছুটির দিনে কারো কথা ভাবতে হয় না। বন্ধুদের সাথে নির্ভেজাল আড্ডা, ঘুরাঘুরি করা যায় যখন তখন। মনটা ফুরফুরে করে ক্লান্তিহীন ঘরে ফেরাটা আনন্দের নাকি বাড়ি ফিরে কাউকে কৈফিয়ত দেয়াটা স্বস্তিদায়ক ? এমন প্রশ্ন করে প্রবাসে আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কেউ কেউ। তাঁদের ভাষায় শ্বশুরবাড়ির দাওয়াত রক্ষা করা, জীবন সঙ্গীর সাথে ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোথাও নেমন্ত্রন্ন খেতে যাওয়া একরকম মানসিক অত্যাচারের মতো। বিবাহিত জীবন মানেই দায়িত্ব কাঁধে নেয়া, একে অপরের স্বাধীন জীবন যাপনে হস্তক্ষেপ করা, মতানৈক্য, বিবাদ।
আবার কিছু অভিভাবককে সন্তানদের বৈবাহিক জীবনের বাইরে লিভটুগেদার জীবনটাকে সহজভাবে মেনে নিতে দেখেছি এই প্রবাসে। বছর কয়েক আগে আমার এক বাংলাদেশি পরিবারের সাথে সখ্যতা ছিল। তাঁদের মেয়েটির বয়স তখন ২৩/২৪ হবে। মেয়েটির পছন্দের আফগান রেস্টুরেন্টে আমরা পরিবারটিকে ডিনারের নিমন্ত্রণ জানাই। সে তাঁর বন্ধুকে সঙ্গে নিতে অনুমতি চায়। আমাদের বাঙালি মন ধরেই নিয়েছিলো সে হয়তো কোন বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে আসবে। নির্দিষ্ট দিনে মেয়েটি তাঁর মা, ভাই এবং বিদেশি বন্ধুকে নিয়ে এসে হাজির। আমাদের বাঙালি মন এবার খানিকটা উদার হয়ে উঠে। ভাবি, বন্ধু তো ছেলে কিংবা মেয়ে যে কেউই হতে পারে। রাতের খাবার শেষে গল্পে গল্পে মধ্যরাত প্রায়। বিদেশি বন্ধুটি ম্যানহাঁটনের ইউনিয়ন স্কয়ার এবং ফোরটিন স্ট্রীটের পাশে তাঁর এপার্টমেন্টের সামনে নামিয়ে দিতে অনুরোধ জানায় আমাদের। আমরা তাঁকে নামিয়ে দেই। মেয়েটিও নেমে যায় মা এবং ভাইকে বিদায় দিয়ে। পরে তাঁর মায়ের কাছে জানলাম তাঁদের সম্পর্কটা বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড। তাঁরা সেই এপার্টমেন্টে লিভটুগেদার করছে। এবার আমাদের বাঙালি মন কিঞ্চিত বিরক্ত এবং ব্যথিত উঠে। হায়, এ কেমন জীবন ! আলো ঝলমলে ম্যানহাঁটনের রাস্তা ধরে আমরা যখন বাড়ি ফিরছিলাম, তখন আমাদের মনের গহিনে থম্থমে আঁধার বিরাজ করছিল। মনে হচ্ছিলো সমস্ত রাত্রির আনন্দটাই যেন মাটি হয়ে গেলো। আনমনে বলি, সবই ঠিক ছিল, শুধু শেষটা ছাড়া !
প্রবাসে বেড়ে উঠা আমাদের তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশই এখন জীবন থেকে বিয়ে নামক অস্তিত্বকে মুছে দিতে চায়। বিয়ের মাধ্যমে তাঁরা একসঙ্গে দীর্ঘদিন জীবন যাপন করার মাঝে কোন আনন্দ খুঁজে পায় না। তাঁরা বিয়ে নয়, শুধুমাত্র লিভ ইনে বিশ্বাসী। যে কয়দিন ভালো লাগবে একসঙ্গে থাকবে, যখন আর ভালো লাগবে না, যে যার পথে চলবে ! দায়িত্ব নেয়ার ভয় কিংবা আত্ন বিশ্বাসের অভাবে বিয়ে থেকে দূরে থাকে এই তরুণ প্রজন্ম। যা সত্যিই ভাবায় আমাদের। তবে কি ‘ বিয়ে মানে নিরাপত্তা, বিয়ে মানে বন্ধন’ এমন ভাবনা খুব দ্রুতই কী মুছে যাবে অদূর ভবিষ্যতে ?
নিউইয়র্ক
0 Shares

৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ