“বাবা দিবস” ২০১৬

রিমি রুম্মান ২১ জুন ২০১৬, মঙ্গলবার, ১১:১৪:২০পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ১১ মন্তব্য
বসন্তের ফুল ঝরে গিয়ে এই শহর এখন কেবলই সবুজ। বাড়ির সামনের আঙিনায়, রাস্তার দু'ধারে যে দিকে চোখ যায় শুধুই সবুজ। স্ট্রীট, এভিনিউয়ের মোড়ে এখানে ওখানে ফুল কেনা বেচার হিরিক। শপিংমলগুলোয় "ফাদারস ডে সেল" চলছে। সেখানেও কেনাকাটার ভিড়। বিশেষ দিনটিতে নিজ নিজ বাবাকে উইশ করার প্রস্তুতিতে সবাই ব্যস্ত। ব্যস্ত শহরের মানুষগুলোর এই উচ্ছ্বাস, বিশেষ মানুষটিকে ঘিরে ব্যস্ততা__ এসব দেখে দেখে অজান্তেই মন খারাপ হলো। আমার বাবা নেই, বিশেষ দিনটিকে ঘিরে ব্যস্ততাও নেই। উদ্দেশ্যহীন হাঁটছি করোনা এভিনিউ ধরে।
 
বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে হাঁটা চার্লসকে মনে পড়ছে কোন কারন ছাড়াই। কাজের ফাঁকে ব্রেকটাইমে পাশের কফিশপে পরিচয় হওয়া চার্লস। কোনার দিকের টেবিলে বসে কত যুক্তি তর্কই না করেছি আমরা "বাবা দিবস" নিয়ে। একদিন কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে চার্লস জানতে চেয়েছিলো বাবা দিবসে বাবাকে কি উপহার দিয়েছি। আমি বলেছিলাম, "কিছুই না"। সে এক পৃথিবী সমান বিস্ময় নিয়ে তাকিয়েছিলো ধূসর ঘোলাটে চোখে। তখন আমার বাবা বেঁচেছিলেন। আমি বলি, "বাবাকে আমি ভালোবাসি, মিস করি প্রতিনিয়ত। আটলান্টিকের এই পাড়ে থেকেও সুখ-দুঃখের অনুভুতি শেয়ার করি প্রায় প্রতিদিনই "। একথায় চার্লস খুশি হতে পারেনি। তাঁর ছেলে অন্যশহর হিউস্টন থেকে কি কি উপহার পাঠিয়েছে "বাবা দিবস" উপলক্ষে__ তা বলে যাচ্ছিলো। চোখে মুখে সরল এক শিশুসুলভ উচ্ছলতা, আনন্দ নিয়ে। আমি বলি, "তোমার ছেলে কি প্রতিদিন ফোন করে তোমার খবর নেয়, সুখ-দুখ, অনুভূতি শেয়ার করে, কিংবা ছুটে আসে দেখতে ? বছরে একবার বড়দিনে আসে, কালে ভদ্রে ফোন করে, আর বিশেষ দিবসে উপহার পাঠায় __ এটিই কি সব ?"
 
চার্লসদের কাছে এটাই সব হয়তো। তাঁরা এতেই খুশি। এমন করেই সুখানুভূতি নিয়ে বেঁচে থাকে। হাহাকার নেই। না পাওয়ার বেদনা নেই। আমার দেশের বৃদ্ধাশ্রমে থাকা বাবাদের মতন বুকচেরা দীর্ঘশ্বাস নেই। নেই বৃদ্ধাশ্রমের উঠোনে গাছের ছায়ায় বসে পিছনের কালের সুখের সময়গুলোর কথা ভেবে অশ্রুসজল হয়ে উঠা একজোড়া চোখ।
 
ফুটপাতের কিনার ঘেঁসে হাঁটছি। একপাশে গির্জা। সাথে ছোট পরিসরে কবর। সেদিকে চেয়ে লোহার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে মধ্যবয়সী এক শ্বেতাঙ্গ নারী। অন্যহাতে একগুচ্ছ নাম না জানা শুভ্র সাদা ফুল। একটু দূরত্বে দাঁড়াই। সমাধি ফলকের লেখাগুলো পড়ি। সেখানে লেখা__ OLIVER H (1864 - 1922). কোনটিতে লেখা __ IN MEMORY OF CHARLS C. STRANG ( APR 7, 1849__ MAR 17, 1926)। মানুষগুলোর বেশিরভাগের মৃত্যু হয়েছে প্রায় শত বছর আগে। হিসেব করি, অচেনা সেইসব মানুষগুলো কে কত বছর বেঁচেছিলো পৃথিবীর বুকে। ভাবি, একপাশে কি ভীষণ অন্ধকার আর নৈঃশব্দ্য এর মাঝে কিছু মানুষ চিরতরে ঘুমিয়ে, অন্যপাশে কি ভীষণ আলো আর কোলাহলের মাঝে ছুটে চলা মানুষ ! পাশেই গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা নারীর ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ কানে আসে। এখানে কোথাও কি তাঁর বাবা ঘুমিয়ে ? জানিনা। আমার দাদার বাড়ির কবরস্থানের পাশাপাশি দুটো কবর চোখের সামনে ভেসে উঠে। আমার বাবা-মা'য়ের কবর। সেখানে কোন সমাধিফলক নেই। জন্মমৃত্যু দিবসের কোন তারিখ লেখা নেই।
 
গাড়িগুলোর শাঁ শাঁ ছুটে চলার শব্দে বাস্তবতায় ফিরি। ততক্ষণে আশেপাশে কেউ নেই। আমি একা, একলা দাঁড়িয়ে। শ্বেতাঙ্গ নারী হেঁটে যাচ্ছে হ্যম্পটন এভিনিউয়ের দিকে। আমি হাঁটছি বাড়ির দিকে। দূরের রাস্তা ধরে সাদা পাঞ্জাবী, টুপি পড়ে লাঠি ভর করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অশ্রুসিক্ত এক বৃদ্ধের হেঁটে যাওয়া দেখি কল্পনায়। আমার বাবার হেঁটে যাওয়া। একবারও যে পিছু ফিরে চায়নি। ফিরে তাকালে হয়তো দেখতে পেতো তাঁর আদরের কন্যাটি তারই মতন অশ্রুসিক্ত। হাজারো বাস্তবতার ভিড়ে কিছু কল্পনা থাকুক না ! থাকুক না কিছু অবাস্তব কল্পনা...
 
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
0 Shares

১১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ