বাতাসে ওড়ে দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাস

রিমি রুম্মান ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪, বৃহস্পতিবার, ০৩:৪৮:৩৩অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৩০ মন্তব্য

শহর থেকে গ্রামে গেলে সবাই যখন গাছের ডাব খাওয়া, চালতার আচার, কাঁচা আম বানানি খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকে, কোন এক অদৃশ্য টানে, অলিখিত নিয়মে সকলের অগোচরে পাশের গ্রামে যাই প্রতিবারই। যে গ্রামটি আজও গহীন গ্রাম হয়ে নুয়ে আছে। হারিকেন, কুপির আলোয় যাদের সন্ধ্যা হয়, রাত নামে। সেখানে আমি যাই রহিমা বু'র কাছে। বেড়ার ঘরে কন্‌কনে শীতের সেই দুপুরে হুহু করে বাতাস ঢুকে কাঁপন ধরায় শরীরে। শীত বর্ষায় এটুকু আশ্রয়ের স্থানেই এমন করে বেঁচে থাকা রহিমা বু'র। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটে যাওয়া ঘটনা, পরবর্তী সময়কার বিষাদময় বেঁচে থাকা, একটি অতৃপ্ত আত্মা'র ঘরময়, গ্রামময় ঘুরে বেড়ানো, আর্তনাদ আর ক্রন্দনের গল্প শুনি।

 

তিনি ফিরে যান সেই তেতাল্লিশ বছর আগে। যেন স্পষ্ট দেখতে পান সময়গুলো চোখের সামনে। উনিশ বছরের উচ্ছল প্রানবন্ত দুই সই বেণী দুলিয়ে দুলিয়ে গ্রামময় চষে বেড়াতেন। অভাব ছিল না সংসারে। ধানক্ষেত, সরিষাক্ষেত, সুপারি বাগান সবখানে দুরন্ত ছুটে চলা ছিল রহিমা বু আর সালেহা বু'র। সালেহা বু'র বিয়ে ঠিক হয় শহরে লেখাপড়া করা পাশের গাঁ'য়ের রমিজের সাথে। সালেহা বু স্বপ্নে বিভোর থাকে, খুশীর জোয়ারে ভাসে। দুর্দান্ত সুখের সেই সময়টাতে যুদ্ধ শুরু হয়...

 

মুক্তিযোদ্ধা দলের সাথে যোগ দেয় রমিজ। দেশ রক্ষা ছাড়া অন্য কোন স্বপ্নের কথা ভাবতে পারে না। এরপর দীর্ঘকাল রমিজের কোন খোঁজ জানা হয়না গাঁ'য়ের কারো। তারা নিশ্চিত ঠাহর করে নেয়, রমিজ বেঁচে নেই। এদিকে সেই গাঁ'য়ের অনেকেই চোখের সামনে বুলেটের আঘাতে ঝাঁজরা হয়। কাউকে কাউকে হানাদার বাহিনী চোখ বেধে নিয়ে যায় নদীর ধারে। লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে একে একে গুলি করে। খুব ভোরে নদীর জলে চেনা মানুষগুলোর লাশ ভাসতে দেখা যায়।

 

তরুণী রহিমা বু আর সালেহা বু নিরাপত্তাহীন উৎকণ্ঠা, শঙ্কা'র দিন কাটায়। রাত কাটায় নিদ্রাহীন। একরাতে তাদের বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় সেনা ক্যাম্পে। সেখানে পাকিস্তানী সেনা আর দেশীয় রাজাকার দ্বারা অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয় দু'জন। দেশ স্বাধীন হয়। সেই সাথে দুরন্ত চঞ্চল যুবতীদ্বয়ের সমস্ত সুখ, হাসি, আনন্দ স্তব্দ হয়ে মুখ থুবড়ে পরে। এরপরের কয়েকটি দিন থম্‌কে থাকে সালেহা বু। নির্বাক ছলছল আতংকিত চোখে শূন্যে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। এক ভোরে গ্রামবাসী আবিষ্কার করে, বাড়ীর পেছনের আমবাগানে গলায় ওড়না পেঁচানো ঝুলন্ত নিথর এক যুবতীর দেহ...

 

রহিমা বু জানায়, সালেহার আত্মা অমাবস্যায়, রিমঝিম বৃষ্টির দিনে,রাত গভীরে অন্ধকারে গ্রামময় হেঁটে বেড়ায়। তিনি তার ক্রন্দন আর আর্তনাদের শব্দ শুনতে পান। আক্ষেপে বলেন, এমন মরবার গুপ্ত ইচ্ছে তার নিজেরও ছিল। জীবনের প্রতি তীব্র হতাশা, ঘৃণা সত্ত্বেও ক্যামন করে আজো বেঁচে আছেন__ সেটাই বিস্ময়। বনের পাখীর ন্যায় স্বাধীন ঘুরে বেড়ানো রহিমা বু সংকোচ, লজ্জায় ঘরের কোনে থাকেন সেই থেকে। পিঞ্জরের আহত পাখির মত ছটফট করেন সুদীর্ঘকাল। মুক্ত বাতাস আর আলোর বিপরীতে অনাহারে অর্ধহারে কেটে যায় অনেকগুলো বছর।

 

আমি নতমুখে বসে থাকি। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। রহিমা বু'র দিকে ব্যথাতুর হয়ে তাকাই। তিনি উন্মত্তের মতন এদিক সেদিক কাউকে খুঁজেন। অতঃপর শক্তিহীন ক্ষীণস্বরে বলেন___" চক্ষু দুইডা মুদে জন্মের লাহান ঘুমাইতে পারলে পরানডা শান্তি পাইতো"। আমি বুঝি__ দুঃসহ স্মৃতি বইতে বইতে তিনি ক্লান্ত, অবসন্ন। রহিমা বু'র আসলেই বিশ্রাম প্রয়োজন খুব... খ-উ-ব। জীবনের শেষ বিশ্রাম ! শ্রদ্ধা আর বিস্ময় নিয়ে তাকাই। তাঁর ছানি পরা ঘোলাটে দু'চোখ বেয়ে নোনাজল গড়ায়। যে জল দীর্ঘ তেতাল্লিশ বছর ধরে গড়ায়, গড়াতেই থাকে... ফুরায় না... শুকায় না...

 

সন্ধ্যা ঘনায়। একঝাঁক পাখি উড়ে যায়... নীড়ে, নিরাপদ আশ্রয়ে। আমি ফিরি ঘরে। হুম... নিরাপদ একটি ঘর ! বাংলাদেশ নামক স্বাধীন দেশটির জন্মের পিছনে কত শত দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাস বাতাসে ঘুরে বেড়ায়___ আমি কেমন করে ঘুমাই এই রাতে ? ক্যামন করে !

0 Shares

৩০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ