ইউরোপ আমেরিকা সহ অনেক দেশে  নারী ও শিশু আজ সুরক্ষিত,  পেছনে যাদের অবদান

 

ধূমায়িত কফি খেতে খেতে রীতা তার নারী গ্রুপের জন্য একটা প্রজেক্ট তৈরি করছে আর তা  নিয়ে সে  মহা ব্যাস্ত ।

প্রজেক্ট টা  নারীর  অধিকার এবং নারীর সুযোগ সুবিধা  যা আজকের নারীরা লন্ডনে পাচ্ছে,  তাদের পেছনে যে নারীরা দীর্ঘ দিন আন্দোলন করেছিল এবং এ বিষয় নিয়ে  লেখা লেখি করে ছিল সেই মহীয়সী নারীদের  নিয়ে।

রীতা নারী উন্নয়ন নিয়ে চাকুরীতে যোগ দেয়ার পর  থেকে কত নারী যে নানা বিষয়ে সাহায্য পেয়েছে তা বলার  নয়।

বাংলাদেশের প্রত্যান্ত গ্রাম অঞ্চল থেকে আসা নারীরা জানেনা কোথায় কি সুবিধা আছে কি সুবিধা তারা পেতে পারে এবং তার জন্য কোথায় যেতে হবে। একে তো ইংরেজি ভাষাটা তারা বুঝতে বা বলতে পারেনা তার উপরে বড়ো সমস্যা এই সব অরগানাইজেসনে যাওয়ার মতো তাদের সাহস বা  মনের জোর কোনটায়  নাই।

বেশির ভাগ নারী অল্প শিক্ষিত বড়ো জোর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দোর গোড়াতে গিয়েছিল আবার অনেকের সে সুযোগও পায় নাই।

যখন কোন সমস্যা আসে পরিবার থেকে সে পারিবারিক সহিংসতা হোক বা  চিলড্রেন ডিস্যাবেলিটি, মানসিক সমস্যা, কাউন্সেলিং , বাড়ি ঘরের জন্য দরখাস্ত করা ,বাচ্চাদের ফ্রি লাঞ্চ যে কোন ধরনে বেনিফিট এবং বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র যেখানে তারা বিনা পয়সায়  ইংরেজি শেখা বা চাকুরীর জন্য ট্রেনিং নিতে পারবে এই সব নানান ধরনের ব্যাপারে তাদেরকে হেল্প করাই  রীতার কাজ। পারিবারিক সহিংসতার কেউ যখন শিকার  হয় তারাকে সেই অত্যাচারিত হাজবেন্ডের হাত থেকে রক্ষা পেতে   ইমারজেন্সি হোস্টেলের ব্যাবস্থা করা,তারপরে কাউন্সিল থেকে বাড়ি বরাদ্দের দরখাস্ত সবিই  রীতাকে দেখভাল করতে হয়।

রীতা তার পরিচালিত মহিলা গ্রুপে নিজে বা নানান পেশার লোক এনে তারাকে দিয়ে নানান বিষয়ে আলোচনা করায় । যেমন স্বাস্থ্য, বাচ্চাদের কি ভাবে মানুষ করা যায় , বার্থ কন্ট্রোল, তাদের অধিকার এই সব । উদ্দেশ্য তারাকে সচেতন করা এবং ঘরের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে ঘরের বাইরে আনা  এবং সব কিছু জানা।

রীতাকে মেয়েরা বিশেষ করে সুফিয়া বেগম বলে "আপা আপনি আমাদের প্রদীপ, আপনি  আমাদের আলো দেখিয়েছেন " । রীতা সুফিয়া বেগম কে বলে সুফিয়া,  আমি নই,  এই সব সুবিধা দেয়ার জন্য অনেক দিন ধরে মেয়েদের অনেক আন্দোলন করতে হয়েছে। আজ তোমরা  নারী হওয়ার জন্য যে সুবিধা পাচ্ছ তা আদায় করার জন্য যারা কাজ করেছিলেন,  একদিন তারাকে নিয়ে,তাদের আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করবো এবং  তোমাদের সামনে তাদের ছবি দেখিয়ে হাজির হব । আজ সেই প্রজেক্ট নিয়েই  কাজ করছে রীতা ।

রীতা তার  প্রজেক্টটি  বিরাট গ্রুপের সামনে নিয়ে আসে এবং প্রজেক্টটারের মাধ্যমে তুলে ধরে । যেখানে একে একে তারা কে দেখা যায় আর দেখা যায় তাদের সংক্ষিপ্ত কাজের ধারা।

তাঁরা হলেনঃ

ক্যারলাইন নরটন

'১৮৩৯ সালে কাস্টডি অফ ইনফ্যান্ট অ্যাক্ট' পাস হয়। এর পেছনে যিনি ছিলেন তিনি ক্যারলাইন নরটন। তিক্ত বিবাহিতো সম্পর্কের জন্য স্বামীর সাথে ডিভর্সের কারণে তার তিন সন্তানের কাস্টডি পাওয়ার জন্য আইনি লড়ায় চালাতে হয় কারণ সে সময় পিতা ছিল সন্তানের অধিকারি  বিয়ে ভেঙ্গে গেলে । ক্যারালাইনের আইনি লড়ায়ে  নুতুন আইন চালু হয় । মেয়েরা বাচ্চার কাস্টডি পায়।

হেলেন ব্লাকবার্ন

 

১৮৫৮ সালে তিনি 'ইংলিশ ওমেন রিভেউ' নামে একটি ম্যাগাজিন খোলেন যাতে তিনি নারী অধিকার, নারী শিক্ষা এবং নারীর জন্য চাকুরীর সুবিধা , বিবাহিত নারীদের জন্য সম্পত্তি অধিকার নিয়ে  লেখা লেখি শুরু করেন । সে সময় মেয়েদের চাকুরী মানে বাসা বাড়িতে কাজ করা অথবা ফ্যাক্টরি ওয়ার্কার এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তিনিই প্রথম আন্দোলন করেন নারীকে সব সেক্টরে কাজ দেয়ার সুযোগ দিতে হবে এবং সেই ভাবে তারাকে তৈরি করতে হবে ট্রেনিং এবং ইডুকেসানের ম্যাধ্যমে ।

জেসি বাছরেল ( jesi boucherell)বারবারা, Adelaide

'সোসাইটি অফ দি ইমপ্লয়মেন্ট ওমেন' নামে নারীদের জন্য একটি নারী শিক্ষা বিস্তার এবং ট্রেনিং সেন্টার খোলেন । যার ফলে নারী সিভিল সার্ভিসে যাওয়ার সুযোগ পায় এবং বিবাহিত হলে নারী চাকুরী করতে পারবেনা তার উচ্ছেদ হয়।

মেরী উলস্টনেক্র্যাফট   (Mary Wollstonecraft) ১৭৫৯-১৭৯৭

একজন ব্রিটিশ লেখক,  দার্শনিক এবং  ফেমিনিস্ট । তার বিখ্যাত বই A vindication of the rights এ তিনি লেখেন " নারী স্বাভাবিক ভাবে পুরুষের চেয়ে  ইনফেরিওর মোটেও নন অনেক সময়  দেখে তা মনে হতে পারে ,তার আসল কারণ অনেক সময় তাদের শিক্ষ্যা থাকেনা এই জন্য এরকম লাগতে পারে। "

ভারজেনিয়া উলফ

একজন  ফেমিনিস্ট লেখিকা যার লেখার মাধ্যমে,  মিটিং,  ডিবেট এর মাধ্যমে প্রচার করতে থাকেন নারী আর পুরুষ সমান এটাই নয় নারীকে রেকগনাইজ করা যে সে নারী হলেও ঘরে এবং বাইরে কিছু করতে পারে সমাজের জন্য।

বার্টন ( Burton)

একজন ব্রিটিশ লেখিকা তার লেখাতে বলেছেন 'আগে বলা হত সমাজিক উন্নতির জন্য নারী ইনভল্বমেন্ট দরকার এখন আর তা নয়,   এখন দরকার সত্যিকারের নারীর শক্তি যা দিয়ে সে ঘরের বাইরে এসে তার সক্ষমতা দেখাতে পারে'

জেইন আসটেন (Jane Austen)১৭৭৫- ১৮১৭

একজন নামকরা লেখিকা .Pride and Prejudice তার লেখা বিখ্যাত বই  টিতে নারীর বিবাহ,অর্থনইতিক সিকিউরিটি এই সব ব্যাপারের উপর আলোকপাত করে সমাজ কে জাগাতে চেষ্টা করেছেন।

এমিলাইন প্যাঙ্খরাস্ট    (Emmeline Pankhurst ) ১৮৫৮ -১৯২৮

তিনি একজন ব্রিটিশ নারী আন্দোলনের নেত্রী ।Women social Political Union এর তিনি নেত্রী ছিলেন। আইনের মাধ্যমে নারী সমতা,অধিকার,শিক্ষার  সুযোগ আইনি ভাবে প্রতিস্টা  করার জন্য তিনি লড়েছিলেন। এবং তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ম্যারি স্টপস (Marie Stopes )

১৮৮০-১৯৫৮প্রথম বার্থ কন্ট্রোল ক্লিনিক খোলেন বিভিন্ন স্থানে এবং নারীর কাছে এর সুবিধা পৌঁছে   দেন ।

ভিস্কাউনতেস ন্যান্সি আস্টর    Viscountess Nancy Aster ১৮৭৯- ১৯৬৪প্রথম রাজনীতিবিদ এবং প্রথম নারী MP হাউস অব কমন্সের ১৯১৯ সালে

ক্লেমেনটিয়া  (Clementina)সেক্রেটারি অব দি ওমেনস ট্রেড ইউনিয়ন লিগ

হেলেন টেইলর (Helen Taylor )১৮৭৬-১৮৮৪

একজন ইংলিশ ফেমিনিসস্ট লেখক,  একট্রেস এবং ফেমিনিসস্ট । তিনি নারী অধিকার প্রমট করেন।

ইসাবেলা (Isabella)

একজন স্কটিশ নারী,  সিভিল এবং পলিটিক্যাল ইকুইলিটি ,নারী অধিকার,  শিক্ষা  এবং সম্পত্তি বিষয়   নিয়ে লবি করেন।

ডঃ  এলিজাবেথ  এন্ডারশোন

প্রথম মহিলা ডাক্তার ,ফিজিসিয়ানএবং সার্জন । নারী আন্দোলনের একজন কর্মি ।তিনিই ছিলেন প্রথম নারী ডাক্তার  । যখন তিনি ক্লাস করা আরম্ভ করলেন  তখন ক্লাসের পুরুষ ছাত্ররা ক্লাস থেকে বের হয়ে গিয়েছিল । কারণ মেয়ে হয়ে  কেন ডাক্তারি পড়তে এসেছে এটাই তাদের ক্ষোভের কারণ।

রীতার প্রজেক্ট শেষ।

এই প্রজেক্টের শেষে কুলসুম বিবি কে নিয়ে যেতে হবে তার এমারজেন্সি একটা বাসস্থানের ব্যাবস্থা করার জন্য ।

কুলসুম বিবির বিয়ে হয়েছিলো বাবার জোরাজুরিতে। পাঁচ বোনের মধ্যে সে বড়ো। বাবা অনেক বয়েসে বাংলাদেশ থেকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছিল । যার ফলে বাবার হয়ে গেছে বেশি বয়স আর ।মেয়েদের বিয়ের দায়িত্ব তাকে শেষ করতে হবে মৃত্যু আসার আগে।

অথচ সে এদেশে বড়ো হয়েছে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চায়না। সামনে এ লেভেল পরীক্ষা । কে শোনে কার কথা । বিয়ের পর  পড়তে দিবে এই কথা  দিয়ে পাত্র পক্ষ রাজী হয় , কিন্তু সেই পর্যন্তই ।বিয়ের পর  তারা কথা রাখেনি । বাচ্চা গর্ভে আসে। পড়ার সুযোগ না দিয়ে  তাকে দিয়ে সব কাজ করাতো। সম্পর্কটা হয়ে যায় তিক্ততায় ভরা। শেষ হয়ে যায় বিবাহিত সম্পর্ক।

কুলসুমের বাবা কিছু দিন না যেতেই আবার চাপ দিতে থাকে । বিয়ে টাই যেন সব  । এটাই যেন সমাধানের একটা পথ।বিয়ে ছাড়া যেন একটা মেয়ে চলতে পারবেনা। অথচ বিয়ে দিয়েই কুলসুম বিবির জীবনটা থছনছ  ।পুরানো ধ্যান ধারনায় বড় হওয়া কুলসুমের বাবা মনে করে স্বামী একজন নারীকে নিরাপত্তা দায়। কিন্তু  বর্তমানের ব্রিটেনে একজন নারী যে একলা চলতে পারে সে ধারনা তার নাই । রাষ্ট্র এখানে অনেক  ব্যাবস্থা করে রেখেছে নারীর নিরাপত্তার জন্য ।

আবার একটা ছেলে পাওয়া যায় যারাকে বলা হয় "লরি  থেকে নামা"।বাংলাদেশ থেকে নানা ভাবে পথ পাড়ি দিয়ে বেআইনী ভাবে ইউকে তে প্রবেশ করাই তাদের উদ্দেশ্য ।  যাদের একটাই উদ্দেশ্য ব্রিটিশ পাসপোর্ট ধারি একটা পাত্রী খোঁজা । যাকে বিয়ে করলে লন্ডনে থাকা যাবে। তাদের আগের পক্ষের বাচ্চা থাকলেও কোন অসুবিধা নাই। কি ভরসা এই ছেলে তাকে রাখবে? নিজের পাসপোর্ট হয়ে গেলেই তারা গায়েব হয়।   তার ছেলেকে দেখাশোনা করবে সে গ্যারান্টি বা  কোথায়।

বাবা বাংলাদেশী পুরানো চিন্তা ধারার মানুষ ,তারা জানেওনা আজকের দুনিয়ায় এদেশে বড় হওয়া একটা মেয়ের নিরাপত্তার  দরকার হয়না। এখানে বাচ্চা রেখে পড়াশুনা চালিয়ে আবার একটা মেয়ে জীবন শুরু করতে পারে। কুলসুম বিবিকে কাউন্সেলিং করে,  কি কি সুবিধা আছে সব তথ্য দিয়ে রীতা তাকে পথ বাতলিয়ে দায় । সিধান্ত  এখন কুলসুমের।

তার আগে তার জন্য একটা বাড়ি দরকার যেখানে সে বাবার চাপ থেকে মুক্তি পেয়ে নিজেকে গোড়তে পারবে। কারণ বাবা আর তাকে রাখতে চান  না।

রীতার ভাবনা 

ব্রিটেনের এই সুযোগ গুলোর সাথে কাজ করতে করতে রীতা ভাবে তার নিজ দেশ বাংলাদেশে কবে এই সুযোগ গুলো আসবে । তাহলে মেয়েদের এই অবস্থা পড়ে রাস্তায় নামতে হবেনা। ফুট পাতে পলিথিনের ছুপরীতে বাস করতে হবেনা একটা মেয়েকে তার বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে। যেখানে কোন নিরাপত্তা নাই। টয়লেট নাই । বাচ্চাদের স্কুলের বা ফ্রি লাঞ্চের  ব্যাবস্থা  নাই। নাই ফ্রি চিকিৎসা । এদের কষ্ট দেখার মানুষ নাই। নাই কোন আইন ।

রীতা স্বপ্ন দ্যাখে বাংলাদেশের মেয়েরা একদিন জাগবে আর তাদের সমস্যা দূর হবে।একটা মা কে রাস্তায় নামতে হবেনা ডিভোর্সের পর তার বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ।

লেখক ও গবেষকঃ হুসনুন নাহার নার্গিস , নারী ও শিশু অধিকার ও উন্নয়ন কর্মী , লন্ডন ,UK

 

0 Shares

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ