বদ্‌লে যাওয়া সময়

রিমি রুম্মান ১৩ আগস্ট ২০১৫, বৃহস্পতিবার, ১০:২১:২২অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৩৩ মন্তব্য

মুখোমুখি দু'টো বাড়ি। মাঝে শহরের মেইন রাস্তা। ওবাড়ির খালাম্মা সৌখিন ভাবে সাজিয়েছেন বাড়িটি। তাঁর হাতের পায়েস না খেলে আমাদের ঈদ পরিপূর্ণ হতো না। আমাদের টিভি কেনার আগ অবধি আমরা সে বাড়িতে "এসো গান শিখি" কিংবা "এইসব দিনরাত্রি" দেখি।

বাড়িটির পিঠেপিঠি বয়সী তিন কন্যা সব সময় একই রকম জামা পরে। একজনই শিক্ষক। ডাইনিং টেবিলের চারপাশে গোল হয়ে বসে বাংলা, ইংরেজি, অংক, ধর্ম__ সবই পড়ান তিনি। পড়া দেয়। পড়া নেয়। না পারলে হাতের তালুতে ঠাস্‌ঠাস্‌ করে মারেন লাঠি দিয়ে। সন্ধ্যার পর পাড়ার অন্য খালাম্মারা বেড়াতে গেলে সে বাড়ির খালাম্মা যখন গল্পে মশগুল, কিংবা আপ্যায়নে ব্যস্ত, তখন তিন কন্যা একযোগে "ভাত খাবো" " ভাত খাবো" বলে কাঁদতে থাকে। খালাম্মা অগ্নিচোখে শুধু তাকায়। কিছু বলেন না। অতিথি'রা চলে গেলে তিন কন্যাকে প্লেটভর্তি ভাত দিয়ে লাঠি নিয়ে সামনে বসেন। ওরা খায়। জোর করেই খায়। কিন্তু সব শেষ করতে পারে না। শাস্তি স্বরূপ__ ঠাস্‌ঠাস্‌ মার !

আমরা পাশাপাশি বেড়ে উঠি। একটা সময় ওদের বিয়ে হয়ে যায়। সবশেষে আমারও। নতুন জামাইকে নিমন্ত্রন করেন খালাম্মা। টেবিল ভর্তি সুস্বাদু খাবার। নিজ হাতে রেঁধেছেন। শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা, শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও রক্তসম্পর্কহীন, অনাত্মীয়, পাশের বাড়ির কন্যাসম আমার জন্যে এতো আয়োজন !অতঃপর একবার যখন দেশে যাই, তাঁরা নেই। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে খালাম্মা- খালু দু'জনই ছেড়ে যান পৃথিবী। বিদেশের একলা ঘরে বসে আমি সেসব সংবাদ পাই যদিও। তবুও যাই প্রতিবারের মতোই। বাড়ির নতুন পুত্রবধু নতুন আসবাবে সাজিয়েছেন নিজের মত করে। জন্মাবধি আমি যেমনটি দেখে অভ্যস্ত তেমনটি আর নেই। আমার সোনালি অতীত চাপা পরে আছে আধুনিক সব আসবাবের নিচে। আমার ছুটোছুটির শৈশব, কৈশোরের আনন্দের স্মৃতিগুলোর মাখামাখি যেখানে, সেখানকার প্রতিটি ইট, পাথর আমার চেনা। একদিকে সাজসজ্জার পরিবর্তন দেখছিলাম, অন্যদিকে মন ভেঙ্গে খান্‌খান্‌ হচ্ছিলো...
শেষবার যখন আমার শহরে যাই, আপা বলে, "খালাম্মাদের বাসায় যাবি না ?"
বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে অজান্তেই। নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বরে বলি__ "না"। ভেঙ্গেচুরে আসা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াই। ও বাড়িতে খালাম্মা-খালু, আর এ বাড়িতে আমার বাবা-মা___ কেউ নেই। কোথাও কেউ নেই। শুধু মুখোমুখি দু'টো বাড়ি দাঁড়িয়ে, কালের সাক্ষী হয়ে।

আমাদের ছোট্ট জগতটা কেমন দ্রুত খালি হয়ে যায়। সবকিছু কেমন দ্রুততার সাথে বদলায়। কিছুই থাকে না আগের মতো। যেমন এই শহরে কাল ঝকঝকে রোদ ছিল, আজ ঝুম বৃষ্টি। অবিরাম শহর ধুয়ে যাওয়া বৃষ্টি...

জানি, বৃষ্টি শেষে ধরণী হবে স্নিগ্ধ, সতেজ, নির্মল,
তবে কেন কান্না শেষে মানব প্রান হয়না শান্ত, শীতল ?

0 Shares

৩৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ