আমি কিছু সংখ্যক ছাত্র নিয়ে সেখানে উপস্থিত ছিলাম। খবর যখন রটে গেল লীগ মন্ত্রীত্ব নাই, তখন দেখি টুপি ও পাগড়ি পরা মাড়োয়ারিরা বাজি পোড়াতে শুরু করেছে এবং হৈচৈ করতে আরম্ভ করেছে। সহ্য করতে না পেরে, আরও অনেক কর্মী ছিল, মাড়োয়ারিদের খুব মারপিট করলাম, ওরা ভাগতে শুরু করল। জনাব মোহাম্মদ আলী বাইরে এসে আমাকে ধরে ফেললেন এবং সকলকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন। হিন্দু নেতারাও বাইরে এসে প্রতিবাদ করল। যাহোক, কিছু সময় পর সব শান্ত হয়ে গেল, আমরা ফিরে এলাম। এই সময় বোধহয় দেড় বছরের মত মুসলিম লীগ শাসন করে, যদিও গভর্নরই সর্বময় ক্ষমতার মালিক ছিলেন। আমি নিজে জানি, শহীদ সাহেব কলকাতা ক্লাবের সদস্য ছিলেন। রাতে একবার দুই এক ঘন্টার জন্য কলকাতায় থাকলে ক্লাবে যেতেন, কিন্তু যেদিন তিনি সিভিল সাপ্লাইয়ের মন্ত্রী হন, তারপর থেকে এক মুহূর্তও সময় পান নাই কলকাতা ক্লাবে যেতে। রাত বারটা পর্যন্ত তিনি অফিস করতেন। আমি ও নূরুদ্দিন রাত বারটার পরেই শহীদ সাহেবের সাথে দেখা করতে এবং রাজনীতি সম্বন্ধে আলোচনা করতে প্রায়ই তাঁর বাড়িতে যেতাম। কারণ, দিনের বেলায় তিনি সময় পেতেন না। তিনি আমাদের এই সময়ের কথা বলে দিয়েছিলেন।
এর পূর্বে আমার ধারণা ছিল না যে, এমএলএরা এইভাবে টাকা নিতে পারে। এরাই দেশের ও জনগণের প্রতিনিধি! আমার মনে আছে, আমাদের উপর ভার পড়ল কয়েকজন এমএলএকে পাহারা দেবার, যাতে তারা দল ত্যাগ করে অন্য দলে না যেতে পারে। আমি তাদের নাম বলতে চাই না, কারণ অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। একজন এমএলএকে মুসলিম লীগ অফিসে আটকানো হল। তিনি বারবার চেষ্টা করেন বাইরে যেতে, কিন্তু আমাদের জন্য পারছেন না। কিছু সময় পরে বললেন, "আমাকে বাইরে যেতে দিন, কোনো ভয় নাই। বিরোধী দল টাকা দিতেছে, যদি কিছু টাকা নিয়ে আসতে পারি আপনাদের ক্ষতি কি? ভোট আমি মুসলিম লীগের পক্ষেই দিব।" আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলাম তাঁর দিকে। বৃদ্ধ লোক, সুন্দর চেহারা, লেখাপড়া কিছু জানেন, কেমন করে এই কথা বলতে পারলেন আমাদের কাছে? টাকা নেবেন এক দল থেকে অন্য দলের সভ্য হয়ে, আবার টাকা এনে ভোটও দেবেন না। কতটা অধঃপতন হতে পারে আমাদের সমাজের! এই ভদ্রলোককে একবার রাস্তা থেকে আমাদের ধরে আনতে হয়েছিল। শুধু সুযোগ খুঁজছিলেন কেমন করে অন্য দলের কাছে যাবেন।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং- ৩৩ ও ৩৪)
৯টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
“আমাকে বাইরে যেতে দিন, কোনো ভয় নাই। বিরোধী দল টাকা দিতেছে, যদি কিছু টাকা নিয়ে আসতে পারি আপনাদের ক্ষতি কি? ভোট আমি মুসলিম লীগের পক্ষেই দিব।”
কি বলব।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হাহাহা…কিচ্ছু বলার নাইরে ভাই। সেকালেও কিছু নষ্ট লোক ছিলো, তবে পরিমানে কম। কমিটেড রাজনীতিবিদ বেশি ছিলো বলে এদের জব্দ করা যেতো।
মোঃ মজিবর রহমান
থিক তাই।
নীলাঞ্জনা নীলা
স্বাধীন দেশ হয়েছে কিন্তু নেতাদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি একটুকুও।
চলুক আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
বুঝা যায়, সবকালেই সুবিধাবাদী নিকৃষ্ট মানের লোক ছিলো কিন্তু দেশের প্রতি, জাতির প্রতি কমিটেড লোকগুলো তাদের বেড়ে উঠতে দেয়নি। আদর্শবানদের যাঁতাকলে আদর্শহীনরা পিষ্ট হয়েছে।
জিসান শা ইকরাম
মারপিট, এমএলেদের টাকা দেয়া নেয়া তাহলে তখনো চালু ছিল!!
মারজানা ফেরদৌস রুবা
চালু ছিলো বটে কিন্তু এটা স্পষ্ট, কমিটেড লোকগুলোকে আদর্শচ্যুত করা যেতো না বলেই আদর্শহীনরা অতলে হারিয়ে যেতো।
লীলাবতী
দলাদলি মারামারি তখনও ছিল? 🙂
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ছিলো রে আপু, রাজনীতি মানেই দলাদলি মারামারি। আর রাজনীতির মুল ব্যাপার হচ্ছে অশুভকে ছাপিয়ে শুভর উত্থান।
এখনও আমাদের দেশে তাই জরুরী। অশুভরা একতাবদ্ধ। তাদের হটাতে শুভদের এগিয়ে থাকা জরুরী। আর তাই শুভর হাতকে শক্তিশালী করতে, শুভকে মনস্তাত্ত্বিক সাপোর্ট যোগাতে আমাদের নাগরিক সচেতনতা দরকার, নাগরিক ঐক্য দরকার।