১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আর কোন ইলেকশন এরা করে নাই। মুসলিম লীগ দুই দলে ভাগ হয়ে গেল, একদল পরিচিত হত শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেবের দল বলে, আরেক দল পরিচিত হত খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব ও মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের দল বলে। আমরা মওলানা আকরম খাঁ সাহেবকে সকলেই শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতাম। তাঁর বিরুদ্ধে আমাদের কিছুই বলার ছিল না।
এই সময় একটা আলোড়নের সৃষ্টি হল। হাশিম সাহেব শহীদ সাহেবের সাথে পরামর্শ করে মুসলিম লীগের একটা ড্রাফট ম্যানিফেস্টো বের করলেন। মুসলিম লীগ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং এর রাজনৈতিক দাবিও থাকবে, ভবিষ্যতে পাকিস্তান পেলে অর্থনৈতিক কাঠামো কি হবে তাও থাকতে হবে। জমিদারি প্রথা বিলোপসহ আরও অনেক কিছু এতে ছিল। ভীষণ হৈচৈ পড়ে গেল। আমরা যুবক, ছাত্র ও প্রগতিবাদীরা এটা নিয়ে ভীষণভাবে প্রপাগান্ডা শুরু করলাম। পাকিস্তান আমাদের আদায় করতে হবে এবং পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো কি হবে তার একটা সুস্পষ্ট রূপরেখা থাকা দরকার। হাশিম সাহেব আমাদের নিয়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা ক্লাস করতেন। ঢাকায় এসে কয়েকদিন থাকতেন এবং কর্মীদের আলোচনা সভা করতেন। কলকাতা লীগ অফিসে তিনি থাকতেন, ঢাকার লীগ অফিসেও তিনি থাকতেন। কর্মীদের সাথে তিনি ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ রাখতেন। আমি তাঁর সাথে কয়েক জায়গায় সভা করতে গিয়েছি।
এই সময়কার একজন ছাত্রনেতার নাম উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে; কারণ, তিনি কোনো গ্রুপে ছিলেন না এবং অন্যায় সহ্য করতেন না। সত্যবাদী বলে সকলে তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। নেতাদের সকলেই তাঁকে স্নেহ করতেন। তাঁর নাম এখন সকলেই জানেন, জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী বার এট ল'। এখন ঢাকা হাইকোর্টের জজ সাহেব। তিনি দুই গ্রুপের মাঝে আপোষ করতে চেষ্টা করতেন। শহীদ সাহেবও চৌধুরী সাহেবের কথার যথেষ্ট দাম দিতেন। জনাব আবদুল হাকিম এখন হাইকোর্টের জজ হয়েছেন। তিনি টেইলর হোস্টেলের সহ-সভাপতি ছিলেন, ছাত্র আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। জজ মকসুমুল হাকিম সাহেব ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন না। বেকার হোস্টেলের প্রিমিয়ার হয়েছিলেন।, ভাল ছাত্র ছিলেন, লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।
এই সময় শহীদ নজীর আহমেদ নিহত হবার পরে ঢাকার ছাত্রদের নেতৃত্ব দিতেন জনাব শামসুল হক সাহেব, শামসুদ্দিন আহমেদ, নোয়াখালীর আজিজ আহমেদ ও খোন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং আরও অনেকে। এরা সকলেই শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিলেন। পরে হাশিম সাহেবেরও ভক্ত হন। এরা সকলেই ছাত্র আন্দোলনের সাথে সাথে মুসলিম লীগ সংগঠনকে কোটারির হাত থেকে বাঁচাবার জন্য মুসলিম লীগের কাজে যোগদান করেছিলেন। ঢাকায় প্রাদেশিক লীগের একটা আঞ্চলিক শাখা অফিস হাশিম সাহেব খোলেন ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে। কমিউনিস্ট পার্টির মত হোলটাইম ওয়ার্কার হিসাবে এরা অনেকেই যোগদান করেন। শামসুল হক সাহেব এই অফিসের ভার নেন। আমরাও কলকাতা অফিসের হোলটাইম ওয়ার্কার হয়ে যাই। যদিও হোস্টেলে আমার রুম থাকত, তবু আমরা প্রায়ই লীগ অফিসে কাটাতাম। রাতে একটু লেখাপড়া করতাম। সময় সময় কলেজে পার্সেন্টেজ রাখতাম। পাকিস্তান না আনতে পারলে লেখাপড়া শিখে কি করব? আমাদের অনেকের মধ্যে এই মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছিল।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং- ৩১ ও ৩২)
৮টি মন্তব্য
ব্লগার সজীব
বর্তমান রাজনীতিতে হোল টাইম ওয়ার্কার এর কথা চিন্তাই করা যায় না। কত নিবেদিত ছিলেন ঐ সময়ের রাজনীতিবিদ গন।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
সেজন্যে তখনকার সময়ের রাজনীতিবিদদের মানুষ সম্মানের চোখে দেখতো আর এখন….?
জিসান শা ইকরাম
জানছি তখনকার নেতাদের সম্পর্কে,
রাজনীতি তখন দেশের কল্যানের জন্যই করতেন সবাই।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
বইটি পড়লে তখনকার সময়ের নেতা আর এখনকার নেতাদের পার্থক্য স্পষ্ট হবে।
আজকালকার রাজনীতিকে নতুন প্রজন্মের কাছে কারা দূষিত করেছে ক্লিয়ার হবে। নতুন প্রজন্ম তো রাজনীতি মানেই ভ্রু কুঁচকায়!
মোঃ মজিবর রহমান
তখন নেতারা বিক্রী হত নীতির নিকট আর এখন অর্থ আর স্বার্থের নিকট
খুব ভাল লাগলো আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হ্যাঁ, এই বিষয়গুলো উঠে আসছে।
ধন্যবাদ মজিবর ভাই।
নীলাঞ্জনা নীলা
নি:স্বার্থ নেতা যদি এখন থাকতো, আমাদের দেশটা সত্যিকারের সোনার বাংলা হতো।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ঠিক তাই। পরার্থে রাজনীতি এখন কেউ করে না। আত্মজীবনী হওয়ায় তখকার সময়ের অনেক কিছু বেরিয়ে আসছে। তুলনা করা যাচ্ছে। যারা পড়বে, তারা বিশ্লেষণ করতে পারবে।