iDxJmGLYdGEv
কোনোমতে হাওড়া পৌঁছালাম, এখন উপায় কি? পরামর্শ করে ঠিক হল, মাখন টিকিট নিয়ে সকলের মালপত্র নিয়ে বের হয়ে যাবে। মালপত্র কোথাও রেখে তিনখানা প্লাটফর্ম টিকিট নিয়ে আবারও ঢুকবে। আমরা একসাথে বের হয়ে যাব।

গাড়ি থামার সাথেসাথে মাখন নেমে গেল, আমরা দুইজন ময়লা জামাকাপড় পরে আছি। দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না যে আমরা দিল্লি থেকে আসতে পারি। চশমা খুলে লুকিয়ে রেখেছি। মাখন তিনখানা প্লাটফর্ম টিকিট নিয়ে ফিরে এসেছে। তখন প্যাসেঞ্জার প্রায়ই চলে গেছে। দুই চারজন আছে যাদের মালপত্র বেশি। তাদের পাশ দিয়ে আমরা দুইজন ঘুরছি। মাখন আমাদের প্লাটফর্ম টিকিট দিল, তিনজন একসঙ্গে বেরিয়ে গেলাম। তখন হিসাব করে দেখি, আমাদের কাছে এক টাকার মত আছে। আমরা বাসে উঠে হাওড়া থেকে বেকার হোস্টেলে ফিরে এলাম। না খেয়ে আমাদের অবস্থা কাহিল হয়ে গেছে। সেই সময় হতে নুরুদ্দিনের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব হয়। পরে আমাদের বন্ধুত্বের 'খেসারত' তাকে দিতে হয়েছে। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে মার্শাল ল' জারি হওয়ার পরে কর্মীদের তাদের দুঃখ কষ্টের কথা অন্য কোনো নেতাদের কাছে বললে কানও দিত না। একমাত্র শহীদ সাহেবই দুঃখ কষ্ট সহানুভূতির সাথে শুনতেন এবং দরকার হলে সাহায্যও করতেন। নূরুদ্দিন পরে 'অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগে'র অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক হয়। আনোয়ার সাহেব যক্ষ্ণা রোগে আক্রান্ত হয়ে যাদবপুর হাসপাতালে ভরতি হন। তাঁর যাবতীয় খরচ শহীদ সাহেব বহন করতেন।

১৯৪৪ ছাত্রলীগের এক বাৎসরিক সম্মেলন হবে ঠিক হল। বহুদিন সম্মেলন হয় না। কলকাতায় আমার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা কিছুটা ছিল-বিশেষ করে ইসলামিয়া কলেজে কেউ আমার বিরুদ্ধে কিছুই করার সাহস পেত না। আমি সমানভাবে মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগে কাজ করতাম। কলকাতায় সম্মেলন হলে কেউ আমাদের দলের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবে না। যাহোক, শহীদ সাহেব আনোয়ার সাহেবকেও ভালবাসতেন। আনোয়ার সাহেব অনেকটা সুস্থ হয়েছেন। ঢাকার ছাত্রলীগ ও আমাদের সাথের কেউ আনোয়ার সাহেবকে দেখতে পারত না। একমাত্র শাহ আজিজুর রহমান সাহেবই ঢাকায় আনোয়ার সাহেবের দলে ছিলেন।

শাহ সাহেব চমৎকার বক্তৃতা করতে পারতেন। বগুড়ায় তাঁকে আমি প্রথম দেখি। আনোয়ার সাহেব কলকাতা ও ঢাকায় কনফারেন্স করতে সাহস না পেয়ে কুষ্টিয়ায় শাহ আজিজুর রহমানের নিজের জেলায় বার্ষিক প্রাদেশিক সম্মেলন ডাকলেন। এই সময় আনোয়ার সাহেব ও নূরুদ্দিনের দলের মধ্যে ভীষণ গোলমাল শুরু হয়ে গেছে। আনোয়ার সাহেব আমার কাছে লোক পাঠালেন এবং অনুরোধ করলেন, তাঁর সাথে এক হয়ে কাজ করতে। তিনি আমাকে পদের লোভও দেখালেন। আমি বললাম, আমার পদের দরকার নাই, তবে সবার সাথে আলোচনা করা দরকার। নূরুদ্দিন সাহেবের দলও আমার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালায়। একপক্ষ আমাকে নিতেই হবে, কারণ আমার এমন শক্তি কলকাতা ছাড়া অন্য কোথাও ছিল না যে ইলেকশনে কিছু করতে পারব। ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে চট্টগ্রামে চলে গেছেন। জহির সাহেব ছাত্র আন্দোলন নিয়ে মাথা ঘামান না, মুসলিম লীগেরই কাজ করেন।

কলকাতায় যে সকল ছাত্র-কর্মী ছিল তারা প্রায়ই হাশিম সাহেবের কাছে যাওয়া-আসা করে। তাঁর কাছে যেয়ে ক্লাস করে, এইভাবে তাদের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। যে সমস্ত নিঃস্বার্থ কর্মী সে সময় কাজ করত তাদের মধ্যে নূরুদ্দিন, বর্ধমানের খন্দকার নূরুল আলম ও শরফুদ্দিন, সিলেটের মোয়াজ্জেম আহমদ চৌধুরী, খুলনার একরামুল হক, চট্টগ্রামের মাহাবুব আলম, নূরুদ্দিনের চাচাতো ভাই এস. এ. সালেহ অন্যতম ছিল। শেষ পর্যন্ত এদের সাথেই আমার মিল হল, কারণ আমরা সকলেই শহীদ সাহেব ও আবুল হাশিমের ভক্ত ছিলাম।

অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং- ২৭ ও ২৮)

অসমাপ্ত আত্মজীবনী (পর্ব-২০)

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ