“নির্যাতিত হবার পর সমাজ ও দেশ অনেকক্ষেত্রে এইসব নারীদের পরিত্যাগ করেছিল। যখন তাঁদের জন্য প্রয়োজন ছিল শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা,সহযোগিতা,সহমর্মিতা ও স্নেহ ভালোবাসাপূর্ণ আশ্বাস তখন কেউ তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ায় নি। ফলে ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার সংকটে পিষ্ট এসব ধর্ষিত নারীরা নিজেদেরকে যৌন শৃঙ্খলে আবদ্ধ এক ঘৃণিত বিচ্ছিন্ন জীব হিসেবে আবিষ্কার করেন।”
.......দেশ স্বাধীন হবার পরে পাকিস্তানি জানোয়ারদের হাতে নির্যাতিত বাঙালি নারীদের ঠিক কতোটা অবহেলা আর অপমানে একটা ঘন কালো অন্ধকারে নিক্ষেপ করা হয়েছিলো, তার কথাই খুব স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় উপরের লাইনগুলো দ্বারা। লাইনগুলো হুবুহু তুলে দেয়া হয়েছে ডা. এম এ হাসানের “যুদ্ধ ও নারী” বইটি থেকে। মূলত, “যুদ্ধ ও নারী” কে বই না বলে একটি “প্রামাণ্য দলিল” বলাটাই সবচাইতে সঠিক। ইতিপূর্বে, আমি একাত্তরে নারী নির্যাতন নিয়ে লেখা যতোগুলো বই পড়েছি, তারমধ্যে এই বইটিই সবচেয়ে তথ্যসমৃদ্ধ।
যুদ্ধের ন’মাস পাকিরা যে কতভাবে নির্যাতন করেছে তা নারী নির্যাতনের ঘটনা গুলো না পড়লে কখনোই জানা যাবে না। শুধু মাত্র যৌন লালসা চরিতার্থ করার জন্যই ওরা নারী ধর্ষণ করেনি। সেই সাথে ওদের উদ্দেশ্য ছিল, দানবীয় ত্রাস সৃষ্টি করা, মনোবল ভেঙ্গে দেয়া, বাঙালি নারীর গর্ভে পকিস্তানী সন্তানের বিস্তারের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে নির্মূল করা। এ ব্যাপারে “যুদ্ধ ও নারী”র ৩১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে-
“ঘরের বউ মেয়েদেরকে নির্যাতন করেছে তাদের শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে, যাতে প্রতিপক্ষ ঝাড়ে মূলে নিকাশ হয়ে যায়, যে ক’টা বেঁচে থাকে তারা যেন ভয়ে পালিয়ে যায়। আর যারা পালাতে পারলো না সেসব মেয়েদের ভেতরে ইসলামের বিজয়ের বীজ বুনেই দেয়া হল।”
পাকিরা ধর্ষণ করেছে ৭ থেকে ৮৭ বছরের নারীদেরও। বইটির ২৬ পৃষ্ঠায় রয়েছে ন’বছরের সন্ধ্যার জীবন প্রদীপ চিরতরে নিভে যাবার কথা-
“পাকিদের বীভৎস পাশবিক লালসা থেকে ন’বছরের শিশু সন্ধ্যায়ও রেহাই পায়নি। একাত্তরের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঝালকাঠির কুড়িয়ানা গ্রাম আক্রমণ করে পাকিরা। সন্ধ্যা ও তাঁর মা অন্যান্য সদস্যদের সাথে ছুটে পালাচ্ছিলো। কিন্তু তাঁরা সবাই ধরা পরে আটক হয় কুড়িয়ানা স্কুলের পাকি ক্যাম্পে।সেখানে পাকি হায়নারা সন্ধ্যার উপর এমন নির্যাতন চালায় যে- কষ্ট , যন্ত্রণা আর বিরামহীন রক্তপাতে সে নির্জীব ও ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিলো। পরবর্তীতে সে মারা যায়।”
পাকিদের যৌন বিকৃতি,মনোবিকার ও নিষ্ঠুরতা এতোটা ভয়ংকর ছিল যে ওদের অনেকেই Sociopath Personality হিসেবে গণ্য করে। ওরা যতোই পরাজয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছিলো ততোই নিষ্ঠুর যৌন নির্যাতক,বিকারগ্রস্ত ও ধর্ষকামী হয়ে উঠেছিলো। নিষ্ঠুর নিপীড়নের মাধ্যমে ভুলতে চাচ্ছিলো ক্রমবর্ধমান পরাজয়ের গ্লানি। এ বিষয়ে বইটির ২৯ পৃষ্ঠার কিছু লাইন এরকম-
“ওরা এইসব নারীর পায়ুপথ ছিন্নভিন্ন করে ওদের সকল বর্জ্য ও যৌনাঙ্গ নারীদের মুখে ঢুকিয়ে দিয়েছে। অল্প বয়সী মেয়েরা যখন অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় কাতরিয়েছে তখন ওরা বেয়ানেটের খোঁচায় ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে তাঁদের যোনিপথ। কামড়িয়ে,খামচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করেছে মেয়েদের শরীর, কেটে নিয়েছে স্তন। মেয়েদের যৌনাঙ্গে লাঠি,রাইফেলের নল,ধারালো বোতল জাতীয় জিনিস ঢুকিয়ে দিয়ে নির্যাতন করা ছিল ওদের উপভোগের বিষয়।”
একাত্তরে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা নিয়ে যে দ্বিধাটি রয়েছে, সেটিও পরিষ্কার হয়ে যাবে বইটির “গবেষণা তথ্যসার” অংশে চোখ রাখলে। বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে আমি বইটির ৪১ পৃষ্ঠা থেকে একটি লাইন তুলে দিচ্ছি –
“একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিদের কারাগার ও বন্দি ক্যাম্পাসগুলোতে নিক্ষিপ্ত নারীর সংখ্যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে সর্বোচ্চ।”
......
কি করে নিমিষেই নিভে যেতো একটি প্রান প্রদীপ ? আর যাদের প্রান প্রদীপ নিভে না গিয়ে মিটিমিটি করে জ্বলতো, তাঁদেরকেই বা কতোটা যন্ত্রণা কতো আক্ষেপে প্রতিমুহুর্তের সাথে লড়াই করে বাঁচতে হয়েছে? ... প্রশ্নগুলোর উত্তর লুকিয়ে আছে নির্যাতিত এবং ভুক্তভোগী প্রতিটি নারীর সাক্ষাৎকারে। বড্ড কষ্ট আর যন্ত্রণা মিশে আছে তাঁদের কথায়। আবার কারো কারো কথায় রয়েছে ৪৪ বছর ধরে জামানো অভিমানের সুর, আছে ঘৃণার নিদর্শনও- এই সমাজের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি। তেমনি কিছু বুকচাপা অভিমানের কথা লেখা আছে ১৬৭ পৃষ্ঠায়, বীর ম চানমনি সখিনা’র জবানিতে-
“ত্রিশ বছর পর আমার এই নির্যাতনের কথা শুনে কি হবে? আমার এই বঞ্চনা,অপমানের সত্যিই কি কোন বিচার হবে? এসব কথা তো স্বাধীন হবার পরপরই তোলা উচিৎ ছিল। কই,কেউ তো এলোনা। কেউ তো বলল না, চানমনি, তোমার জন্যই আজ আমরা স্বাধীন হয়েছি...”
“
যুদ্ধ ও নারী” বইটির খুব সামান্য কিছু অংশ এখানে তুলে ধরেছি।একাত্তরে নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই বইটির কোন বিকল্প আছে কিনা আমি জানিনা।
বই পর্যালোচনাঃ যুদ্ধ ও নারী; ডা. এম এ হাসান।
১৮টি মন্তব্য
স্বপ্ন
এসব ভাবলে শিউরে উঠতে হয় আপু।এসব অত্যাচারের কোন বিচার হলো না।
ফাতেমা জোহরা
বিচার হচ্ছে, বিচার হবেই…
মারজানা ফেরদৌস রুবা
দেশপ্রেমিক বাঙালীই শুধু নয়, বোধসম্পন্ন মানুষ মাত্রই এগুলো পড়লে কষ্ট হবে। উপলব্দিতে নাড়া খাবে। এতোকিছু জানার পরও দেখা যায় কিছু বাঙালী উম্মাদ পাকিপ্রেমে দিওয়ানা!!!
ফাতেমা জোহরা
ওরা হল বেজন্মার দল…
জিসান শা ইকরাম
সব কিছুতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছি আসলে
এই সব অন্যায়ের বিচার হলো না,হবেও না কোনদিন
নিজেরাই শুধু ঘৃণা ধারণ করে রাখবো পাকিদের প্রতি
আর রাষ্ট্র পাকিস্থানে পাঠায় সালমাদের ক্রিকেট খেলার জন্য।
বিচার হচ্ছে মুজাহিদ কাদের এর
আর এদের শিক্ষিত অনুসারীদের দলে নিচ্ছে কারা তা আমরা জানি।
ফাতেমা জোহরা
সহমত ভাইয়া।
নীতেশ বড়ুয়া
কোন প্রকাশনী হতে বইতে প্রকাশ পেয়েছে জানালে সংগ্রহ করতাম 🙂
ফাতেমা জোহরা
তাম্রলিপি প্রকাশনী।
নীতেশ বড়ুয়া
ধন্যবাদ আপু। সংগ্রহ করবো অবশ্যই। -{@
নীতেশ বড়ুয়া
আপু, ৭১ নিয়ে আর কি কি আছে। ইদানীং এতো বই আছে যে বেশ কিছু তথ্য একটার সাথে আরেটটার বিরুদ্ধে চলে যায়। জানাবেন প্লীজ?
নীলাঞ্জনা নীলা
উফ। এ বই আমি পড়তে পারবো না।
ফাতেমা জোহরা
প্রথমে আমারো এমন মনে হয়েছিলো আপু !!
মেহেরী তাজ
এই বই কি শেষ পাতা পর্যন্ত পড়ে শেষ করা সম্ভব? আমার পক্ষে তো না।
ফাতেমা জোহরা
একটানা বইটা পড়ে শেষ করতে পারিনি আপু !!
আজিম
শুধু পাক সেনাদেরই ঘৃণা করি তা নয়, ঘৃণা করি তাদেরও যারা এসকল আমাদের মা-বোনদের যোগ্য সম্মান দেননাই।
নীতেশ বড়ুয়া
আমি অনেকদিন থেকে নিজের ভেতরে রাখা কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছি।
স্বাধীনতার যুদ্ধে যতজন নারী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের অনেকেই ধরাও পড়েছিলেন নিশ্চিত। এদেরকেও বীরাঙ্গণা বলা হচ্ছে!?
আমাদের দেশে বীরাঙ্গণাদের সঠিক সংখ্যা কত?
একাত্তর ও একাত্তর পরবর্তী বীরাঙ্গণাদের সন্তানদের ও বীরাঙ্গণাদের যে মর্যাদা দেওয়ার কথা তার কতটুকু দেওয়া হচ্ছে? তাঁদের সন্তানদের কে কোথায় কি পরিচয়ে! এইসব কথা জানা যায় না কেন?
ফাতেমা জোহরা
দাদা, এই বিষয়ে বিস্তারিত পোস্ট আসছে… 🙂
ফাতেমা জোহরা
দাদা, আপনি একাত্তরের কি বিষয়ের উপর বই খুঁজছেন, সেটা বললে ভালো হতো। গণহত্যা, শরনার্থী, নারী নির্যাতন নাকি আরো কিছু?
আমার পড়া কিছু বই এর নাম দিচ্ছি-
০১. ১৯৭১ : ভয়াবহ অভিজ্ঞতা; রশীদ হায়দার, সাহিত্য প্রকাশ।
০২. ত্রিশ লক্ষ শহিদঃ বাহুল্য নাকি বাস্তবতা? ; আরিফ রহমান, নান্দনিক প্রকাশনী।
০৩. বাংলাদেশের গণহত্যা ১৯৭১; খালেক বিন জয়েনউদদীন সম্পাদিত, বর্ণায়ন প্রকাশ।
০৪. গণহত্যা’৭১; তপন কুমার দে, নওরোজ সাহিত্য সংসদ।
০৫. বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের গণহত্যা ও নারী ধর্ষণ;রশীদ হায়দার, সাহিত্য প্রকাশ।
০৬. গণহত্যা (Genocide);মূল: অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস,অনুবাদ: সৈয়দ রেদওয়ানুর রহমান, প্রকাশক: প্রেসিডেন্সী লাইব্রেরী। আরো অনেক বই আছে।
নারী নির্যাতন সম্পর্কে জানতে মুনতাসীর স্যারের বীরাঙ্গনা’৭১ এবং এই বইটা তো আছে এগুলো পড়তে পারেন।