প্রজ্ঞা ৬

নীরা সাদীয়া ২৯ অক্টোবর ২০১৬, শনিবার, ০৬:০৬:২৯অপরাহ্ন গল্প ২১ মন্তব্য

রোহান রেগে গিয়ে বন্ধুদের সাথে হাতাহাতি থেকে তুমুল মারামারি পর্যন্ত শুরু করে দিল। এখন তার মাথায় ভাল মন্দ বিচার করার কোন জ্ঞান নেই।পারে তো এদেরকে খুন করে ফেলে।বন্ধুরা প্রথমে ফেরানোর চেষ্টা করল।তা না পেরে উল্টে তারাও রোহানকে ধরে মারতে থাকল।ফ্ল্যাটের দরজা হাট করে খোলা।চেঁচামেচি শুনে বাড়িওয়ালা এলেন,রোহানকে উদ্ধার করলেন।তার এক চোখে ঘুষি লেগে রক্ত পড়ছে।কপাল কেটে গেছে।বাকিদের তেমন কিছুই হয়নি।তিনি রোহানের চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন।হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে ছেড়ে দিল।সে বাড়ি ফিরে দেখল বন্ধুরা নেই,একদম ফাঁকা।তখন রাত ১০টা।রিয়ার কথা তার খুব মনে পড়ছে।যতটা না অনুশোচনা,তার চেয়ে বেশি ভালবাসা জেগে উঠল রিয়ার প্রতি।তার নম্বরটা খুঁজে বের করে একটা কল দিল।এদিকে রিয়া সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত হয়ে শুতে যাচ্ছিল।তখনি ফোনটা বাজল।রোহানের ফোন দেখে সে খানিকটা অবাক হল।তারপর ভাবল হয়ত মার ফোনে নেট নেই,তাই এটাতে করেছে।ফোনটা নিজে রিসিভ করে দুটো তিক্ত কথা শোনার চেয়ে মাকে দিয়ে রিসিভ করানোই উত্তম হবে,এই ভেবে তাঁর কাছে নিয়ে গেল।তিনি রিসিভ করলেন।তিনি ছেলের গলা শুনেই বুঝলেন কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।
.
"কি হয়েছে রোহান?"
"কিছু না মা।"
"তাহলে এমন শোনাচ্ছে কেন?"
"ঐ একটু কপালটা কেটে গেছে।ছোট্ট একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল তো। চিন্তা করো না তুমি।"
...........
এ সম্পর্কে আরো দু একটা ছোটখাট কথা বলে রিয়ার কথা মাকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, কিন্তু সংকোচে মুখে আটকে গেল।খুব একটা কিছু বলতে পারল না। শুধু জিজ্ঞেস করল,রিয়া কোথায়। তার মা ভেবে নিলেন,রিয়া এ বাড়ি ছেড়েছে কিনা, তাই হয়ত জানতে চাচ্ছে। অথচ এদিকে সে মনে মনে মরমে মরে যাচ্ছে,তার ভেতরটা ভেঙে টুকরো হয়ে যাচ্ছে যা সে কাওকে বোঝাতে পারছে না।বারবার মনে হচ্ছে কেন যাচাই না করেই রিয়াকে এতটা অবিশ্বাস করলো?কেন তার সাথে এত এত খারাপ ব্যবহার করলো?এবার সে রিয়াকে কিকরে সবটা বলবে?রিয়া কি আদৌ তাকে ক্ষমা করবে?এসব ভাবতে ভাবতে নির্ঘুম রাত কেটে যায়।
সকালে উঠেই অফিসে ছুটির আবেদন জমা দিয়ে ঢাকা চলে যায়।যখন বাড়ি পৌঁছায়,তখন সকাল ১০টা।বাড়িতে তার মা একা।রিয়া অফিস গেছে।কখন ফিরবে এখন শুধু তার অপেক্ষা। এরি মাঝে তার মাকে সব ঘটনা খুলে বলল।তিনি সব শুনলেন,কিন্তু কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না।
.
দুপুরের গনগনে সূর্য মাথার ওপর।তাই নিয়ে রিয়া হোস্টেলের দিকে পা বাড়ায়।সিটটা খালি হল কিনা তা দেখে আজ ফাইনাল করে তবেই ফিরবে।সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে,এখন থেকে সে একাই বাঁচবে।অসহায় মানুষের তরে বাঁচবে।বিধাতার তরে বাঁচবে।কিন্তু আর কোন বন্ধনে জড়াবে না নিজেকে।হোস্টেলের সিট ফাইনাল করে বাড়ি ফেরে।ফিরেই বারান্দায় চটিজোড়া দেখে বুঝতে পারে রোহান এসেছে।মনে মনে ভাবল,আর কটা দিন পরে এলেই পারত,তাহলে আর এসে তাকে দেখতে হত না।যেহেতু রোহান এসেছে তাই যখন তখন আর ডাইনিং এর দিকে যাওয়া চলবে না।কখন রোহান তাকে দেখে আবার চেঁচামেচি শুরু করে দেবে। অনেকদিন পর ছেলে মায়ের কাছে ফিরেছে।তাই তাকে নিয়ে আবার নতুন করে অশান্তি শুরু হোক,তা সে চায় না।এই ভেবে নিজ রুমে কিছুক্ষণ ঘাপটি মেরে বসে রইল।তারপর রোহানের নাড়াচাড়া না দেখতে পেয়ে ডাইনিং এ এল,তার পাশেই ফ্রেশরুম।সেখানে ফ্রেশ হল।
এদিকে রোহান অপেক্ষায় আছে,কখন রিয়া ফিরবে,তাকে সব খুলে বলবে,নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইবে।রিয়া তাকে ক্ষমা করলে মাথার ওপর থেকে এক ট্রাক বোঝা হালকা হবে।কিন্তু রিয়া তার সামনেই এল না। সন্ধ্যায় চা দিতে কিংবা রাতের খাবার খেতেও এল না।বরং রোহান এসেছে দেখে রিয়া বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করল।মা অনেক ডাকার পরেও সে দরজা খুলল না।খাবে না বলে ঘুমিয়ে পড়ল।পরদিন অনেক ভোরে ওঠে নাশতা না করেই সে বেরিয়ে গেল।এ মাসের আর সাতদিন বাকি।দেখতে গেল সাতদিন আগেই কারো সাথে শেয়ার করে হোস্টেলে ওঠা যায় কিনা। সে সুযোগ মিলেও গেল।একজন মেয়ে রাজি হল। এদিকে তার বরটি অস্থির হয়ে আছে,কখন ফিরবে সে।নাকি তাকে একটা ফোন দেবে? ভেবে ভেবে ফোন দিয়েই ফেলল।রিয়া ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল রোহানের ফোন।কিছুটা বিরক্ত হয়ে কেটে দিল।তাকে ফোন করার কোন কারণ সে খুঁজে পেলনা।হয়ত বাইরে আছে,মায়ের ফোনে নেট পাচ্ছে না।এই ভেবে সে ফোনটা ধরল না।বাড়ি ফিরে শাশুড়ি মাকে জানিয়ে দিল সে আগামী কালই হোস্টেলে উঠে যাবে। তিনি কিছু বলার আগেই রোহান এসে হাজির।
.
"রিয়া,তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।"
"আপনি কোন চিন্তা করবেন না।আমি কালই চলে যাচ্ছি। আশা করি আর কিছু বলার নেই।"
হঠাৎ রিয়ার এই "আপনি" সম্বোধনে রোহান খুব অবাক হল।ভাবল সে অভিমান করে বলছে।কিন্তু রিয়া যেমন নরম মনের তেমনি দৃঢ়চেতা মেয়ে।একবার মনকে শক্ত করে নিলে আর সহজে গলে না।তবে সেটা রোহানের জানা নেই।সে এখন পর্যন্ত নিজের বৌকে ঠিকমত চিনেই উঠতে পারেনি।অবশ্য চিনবেই বা কি করে?তার সাথেতো ভালমন্দ কোন কথাই আজ অব্দি বলেনি।শুধুমাত্র মুখ দেখে তো আর একটা মানুষের ব্যাক্তিত্ব বোঝা যায় না।
.
"রিয়া,আমি আসলে তোমাকে এসব নিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না।আমার অন্য বিষয়ে কিছু কথা আছে।"
"আমার সাথে আপনার আর কি কথা থাকতে পারে?"
"দেখ,তুমি আমাকে ভুল বোঝনা।আমার ঘরে এসে বসো এবং একটু মনযোগ দিয়ে আমার কথাগুলো শোন।"
রোহানের সেই ঘরটা যেটা থেকে বিয়ের প্রথম রাতে তাকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল,সে ঘরটায় তার আর ঢুকতে মন চায় না। এমনকি সেদিনের পর থেকে আর এক মুহূর্তের জন্যেও সে সেঘরে প্রবেশ করেনি।সে সাফ জানিয়ে দিল,
.
"আপনার ও ঘরে আমি যাব না। যা বলার এখানেই বলুন।আর একটু দ্রুত বলুন।আমার অনেক কাজ। সব গোছাতে হবে।"
.
যদিও চাকরি পাওয়ার পর থেকে অল্প অল্প করে সে অনেক জিনিস গুছিয়ে রেখেছে।তারপরো,সেগুলো একত্র করা,গাড়ি ভাড়া করে সেগুলো পৌঁছানো,আরো কত কাজ বাকি।
রোহান বলল,
"ঠিক আছে ও ঘরে না যাও,অন্তত ড্রয়িংরুমে এসে বসো।"
"আচ্ছা।"
.
রিয়া ভেবে পাচ্ছে না তার সাথে রোহানের কি কথা থাকতে পারে।তা ছাড়া আজ হঠাৎ এত ভদ্র ব্যবহার! রোহানের হলটা কি?ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রিয়াকে সব খুলে বলল রোহান।তার কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইল।সে এরকম ভুল আর করবে না বলে কথাও দিল।সব শুনে রিয়া বলল,
.
"দেখুন আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।তা ছাড়া হোস্টেলে চলে গেলে কিছুদিন পর আর কিছুই মনে থাকবে না আমার।তাই আপনার বিব্রত হবার কোন কারণ নেই।আপনি এবার নিজের পছন্দমত কাওকে নিয়ে নতুনভাবে সবটা শুরু করুন।আপনার নতুন জীবনের প্রতি আমার অনেক শুভকামনা থাকবে।"
"তার মানে তুমি আমাকে ক্ষমা করনি রিয়া।নইলে কি চলে যাবার কথা বলতে পারতে?"
"দেখুন,এসব সংসার,হাঁড়িপাতিল,হাজবেন্ড,রান্নাঘর ইত্যাদি কোনটাই আমার ভাল লাগে না।আমার দ্বারা এসব হবে না সে আমি বুঝে গেছি।তাই বলছি...."
"কেন ভাল লাগবে না,আমি সত্যি বলছি,তোমার ভাল লাগে না এমন কিছু আমি করব না,প্লিজ,বোঝার চেষ্টা করো।"
"আমি বুঝেছি।কিন্তু..."
"কিন্তু কি?"
"আমার মনে হয় পৃথিবীতে যা কিছু দেখার আমি সবই দেখে নিয়েছি।আমার আর কিছু দেখার নেই।এবার আমি একটু নিজের মত করে বাঁচতে চাই।"
"কি কি দেখেছ?"
"মা বাবা,পরিবার, ছাত্রজীবন,বৈবাহিক জীবন,চাকরি জীবন,স্বামী, শশুড় বাড়ি,সংসার,রান্নাঘর ইত্যাদি সব কিছু।"
তারপরো তোমার অনেক কিছু দেখা বাকি আছে রিয়া যা আমি তোমাকে দেখাতে পারি।আমি বলব,তুমি কিছুই দেখনি।"
"যা দেখিনি তা আর দেখতে চাই না"
.
রিয়া খুব জেদী স্বভাবের মেয়ে।যা করবে বলে একবার ঠিক করে নেয়,তা করেই ছাড়ে।কেন জানি রোহানের ওপর থেকে তার মন সরে গেছে অনেকদিন আগেই।এখন এই সম্পর্কের বোঝা থেকে মুক্ত হয়ে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চায়।মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিতে চায়।ফলে অনেক চেষ্টা করেও রোহান তাকে কিছুই বোঝাতে পারল না।তাই সেও খুব ভেঙে পরল,তবে হাল ছেড়ে দিল না।
.
পরদিন খুব সকালে উঠে পরল রিয়া।রোহান ও উঠল।শেষ চেষ্টা করে দেখতে হবে,হোস্টেলে চলে যাওয়া থেকে ফেরানো যায় কিনা তাকে।
.
চলবে.........

0 Shares

২১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ