পৃথিবীর পথে পথেঃ ভ্রমণ কাহিনী , জিম্বাবিউয়ে,  ভিক্টোরিয়া ফলস,বা ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত  (১ম পর্ব )

"ভিক্টোরিয়া ফলস" জিম্বাবিউয়ে

"অনেক রকম গাভীরে ভাই একই রকম দুধ "

সময়টা ২০০৬ এবং এবার আমাদের গন্তব্য আফ্রিকার জিম্বাবিউয়ের  ভিক্টোরিয়া ফলস ।

লন্ডনের হিথরো এয়ার পোর্ট থেকে সন্ধ্যায়  'জিম্বাবিউ এয়ারলাইন্সের' ফ্লাইটে চেপে বসলাম। সারা রাত প্লেন নন স্টপ চলতে থাকলো যেহেতু রাত তাই আমরাও ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সারা রাত কাটিয়ে যখন সকাল হল আমরা এসে পড়লাম আফ্রিকার জিম্বাবিউয়ে। এটায় আফ্রিকায় প্রথম ভিজিট । জিম্বাবিউয়ের 'হরারে ইন্টারন্যাসানাল এয়ারপোর্ট'  এ   নেমে আর একটা ছোটো প্লেন  নিয়ে 'ভিক্টোরিয়া ওয়াটার ফলস' এয়ারপোর্টে আসলাম।

এয়ারপোর্টে আমরাকে আফ্রিকার ফোক নাচ দিয়ে ওয়েলকাম করলো একদল যুবক তাদের নিজস্ব কস্টিউম পরে। তারপর হোটেল থেকে পাঠানো গাড়ি আমরাকে নিয়ে চলল আমাদের রিসোর্টে । চারদিকে বাড়িঘর নাই ।খেত খামারও নাই। আছে শুধু গাছ আর ঝোপ ঝাড় । সব ফাঁকা  । এতো কম মানুষ একটা দেশে থাকে বিশ্বাস হয়না।

আমাদের রিসোর্ট টা গাছ গাছালি দিয়ে ঢাকা। রুমের চাবি পেয়ে গেলাম। যথারীতি রিসেপসনিসস্ট কে বললাম আমরা কি কি করব। ঠিক করে দেয়া তার কাজ ।

সেদিনই বিকালে গেলাম 'জাম্বেজি রিভার সাফারি ক্রুজ' করতে। অনেক প্রশস্ত নদী। মাঝে মাঝে গাছগাছালি ভরা উঁচু দ্বীপ । প্রথমেই দেখা পেলাম 'হিপোপটামাসের'। দুই তিনটি হিপো বসে আছে নদীর কিনারে । তারপর দেখা পেলাম  একদল হাতী নদী ক্রস করে ওপারের দ্বীপে সাঁতার কেটে যাওয়ার দৃশ্য । শুঁড় পানি থেকে উপরে রেখেছে   নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য ।  সাঁতার কাটতে  কাটতে চলে গেলো নদীর মাঝের দ্বীপে খাবারের জন্য।

আফ্রিকান মানুষ যে এতো ভালো আর সহজ সরল হয় জানতাম না। যা যেখানে দেখতে পাচ্ছে দেখিয়ে দিচ্ছে। একটু পরেই দূর থেকে দেখা মিললো প্রধান আকর্ষণ ভিক্টোরিয়া ওয়াটার ফলসের  কুয়াশার মতো সৃষ্টি ফগ আর তার সাথে আওয়াজ । বেশিদূর সে এগুলো  না। কারন প্রবল স্রোত  আরম্ভ হয়েছে যা কিনা বোট টিকে টেনে নিয়ে যাবে ফলসের দিকে।  নৌকা  যেখান থেকে ফিরিয়ে  আনা  কষ্টকর। মাঝের  দ্বীপ টিতে নেমে চা আর সামুচা দিয়ে পিকনিক করলাম আর সূর্য ডোবা দেখলাম । চারদিকের গাছপালা ,জীবজন্তু সব কিছু ডিফারেন্ট । এই ডিফারেন্ট টাই প্রধান আকর্ষণ আর সুন্দর।

নৌকা ফিরে আসলো,  তখন সন্ধ্যা। গাড়ীতে উঠেই লক্ষ্য করলাম অন্ধকারে জোড়ায় জোড়ায় চোখ জ্বল জ্বল করছে চারদিকে। । ড্রাইভার বুঝিয়ে দিলো এটি রাতের সাফারি। এগুলো হরিণ,  সাম্বা আর বন্য শূকর।সুন্দর একটা অভিজ্ঞতা নিয়ে রিসোর্টে ফিরে আসলাম।

ডিনার শেষে শুয়ে পড়লাম ।কারন সকালেই সেই প্রধান আকর্ষণ ভিক্টোরিয়া ওয়াটার ফলস দেখার দিন।

পরের দিন ব্রেকফাস্ট শেষে ট্যাক্সি যোগে চললাম ফলস দেখতা খুব একটা দূরে নয় আমাদের হোটেল থেকে । সেখান থেকে গর্জন শোনা যায় ।

টিকিট করে ভিতরে প্রবেশ করলাম ওয়াটার্স ফলস পার্কে।চারদিক ন্যাচারাল ভাবে রাখা হয়েছে। যা দিয়ে ইকো সিস্টেম যেমন বজায় আছে আর এই ন্যাচারাল বিউটির  সৌন্দর্জ কেও ঠিক রেখেছে ।

সে এক এলাহি কাণ্ড । ভাষা দিয়ে বোঝানো যাবে না। ১,৭০৮ মিটার প্রস্থের বিরাট নদী প্রবল বেগে ৫,৫০০ ফিট গভীর গোর্জের খাদে  প্রচণ্ড শব্দে পড়ছে। প্রতি সেকেন্ডে ৯৩৫ কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হচ্ছে ৩৩,০০০ কিউবিক ফিট ফ্লো নিয়ে। এতো দ্রুত গতিতে এতো পরিমাণ পানি যেভাবে পড়ছে এবং যে গর্জনের সৃষ্টি করছে তা  না দেখলে বর্ণনা দিয়ে বোঝা যাবেনা।

একটা তুলনা করা যায় এভাবে ,আমাদের যমুনা নদী যদি প্রবাহ বন্ধ করে সামনে না এগিয়ে একটা বিরাট গভীর খাদে পড়ে তখন যেমন হতে পারে এই জাম্বেজি নদীটিও সে একই অবস্থার সৃষ্টি করছে। কারন জাম্বেজি  নদীটি এখানে প্রবাহের মধ্যের  দিকে এবং এই খানে সব চেয়ে প্রশস্ত।

যেমন গর্জন তেমন ভয়ঙ্কর আর তেমন সুন্দর আর বিরাট বিস্ময় । এই  গর্জন কয়েক মাইল  দূর থেকে শোনা যায়।এই প্রচণ্ড গর্জন আর সৃষ্ট কুয়াশা কে স্থানীয় বাসিন্দা " মসি-ও- তুনিয়া" অর্থাৎ "The Smoke That Thunders" বাংলায় 'মেঘে বিদ্যুতের গর্জন' বলে ডাকে ।

যখন পানি প্রবাহ বেশি থাকে তখন এর ভয়াবহতা আরও বেশি আর গর্জনও প্রচণ্ড হয়। কালো রঙের ব্যাসলট পাথরে তৈরি এর দুই ধার । সেখান দিয়ে পানি কোনো একটা বেসিনে পড়েনা। পড়ে  একটা লম্বা খাড়িতে  যা কিনা এঁকে বেঁকে চলে গেছে  একটা  গোর্জ সৃষ্টি করে ।  গোর্জর দুই ধার সমান উঁচু। শক্ত ব্যাসল্ট পাথরের ধার থাকাতে প্রচণ্ড পানির প্রবাহে তা ক্ষয় হয় না।

ওয়াটার ফলস দেখার জন্য জিম্বাবিউ সাইডে ১৬ টি আর জাম্বিয়া সাইডে ১৩ টি ভিউ পয়েন্ট আছে। প্রশস্ত পানি পড়ার ব্যাপারটির কয়েকটি নাম আছে । যেমন ১) Devils cataract 2) Horseshoe Falls  3)  Rainbow Falls 4) Eastern Cataract

Devils Cataract Falls টি প্রথম ক্যাটারাক্ট যা  শীতলক্ষ্যা বা বুড়ি গঙ্গা নদী যেমন প্রশস্ত  প্রায় তার কাছাকাছি সমান প্রশস্ত ।  আর এই  নদীর মতো পানির প্রবাহটি  ভয়ংকর  ভাবে এগিয়ে এসে খাদে চলে যাচ্ছে ।দেখার মতো একটা জিনিস।

নাইফ এজ ব্রিজ (Knife Edge Bridge): জাম্বিয়া সাইডে এসে নাইফ এজ ব্রিজ দিয়ে ওয়াটার ফলস দেখাটা  একটা রোমাঞ্চকর থ্রিলিং । এখানে প্রচণ্ড ভাবে পানি পড়াতে পানি ছিটে উপরে আসে এবং বৃষ্টির মতো ছটার সৃষ্টি করে । ফলস্বরূপ এখানে রেইন ফরেস্ট এবং রংধনুর  সৃষ্টি হয়। বৃষ্টি সবসময় হয় তাই  রেইন কোট পরতে হয়। তারপর ৪২০ফুট  উঁচু ব্রিজটিতে উঠে সামনে তাকালে ভয় লেগে যাবে কারন খুব সামনেই অপেক্ষা করছে যে দৃশ্য তা  সুন্দর কিন্তু ভয়ংকর । ফলসটি খুব কাছে ব্রিজ থেকে । এ এক থ্রিলিং লাগানো অনুভূতি।

Dr living Stone নামে একজন স্কটল্যান্ডের ডাক্তার  ১৮৫৫ সালের ১৫ই নভেম্বর   এখানে  আসেন মিশনারির ডাক্তার হিসেবে।  তিনিই প্রথম ইউরোপিয়ান যিনি এই ফলস টি দেখেন ।রানী ভিক্টরিয়াকে সন্মান জানিয়ে তিনি এর নাম দেন ভিক্টোরিয়া ওয়াটার ফলস ।  তিনি  নিজ দেশে গিয়ে পাবলিশ করেন "এর সৌন্দর্জ ব্রিটেনের কোনো কিছুর সাথে তুলনা করা যাবেনা" "Most Spectacular  and The Bigest Water Falls in The World".

তার প্রচারে আজ সেখানে পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে বছরে প্রায় চার  লাখ মানুষ ভিজিট করতে আসে এই ওয়াটার ফলস টি  । ১৯৮৯ সালে ভিক্টোরিয়া ওয়াটার ফলস  ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত হয়।

পরের দিন আমরা আবার আসি ফলস দেখতে।  এবার ছোটো একটা হেলিকপ্টারে করে উপর থেকে উড়ে পুরো নদী আর ফলস দেখলাম ।  এ দেখার আর এক অনুভূতি ।

নিচে নেমে দিনের বাকি সময় সেখানেই কাটালাম। ভালো করে  দেখবো তাই। জাম্বিয়ার দিকে গেলাম পানি পড়ার কাছাকাছি জায়গায় একটা দূরত্ব রেখে পানি ছুয়ে নিলাম । একসময় দেখি সব ভিজিটর চলে গেছে। সন্ধ্যা হয়ে আসলো। কেউ নাই শুধু আমরা তিন জন । আর বিকট আওয়াজে ভিক্টোরিয়া তার কাজ কোরেই  চলছে আর তা হল প্রচণ্ড শব্দ আর বেগে পানি নিচে ফেলা ।   চারদিকে জীবজন্তু বের হওয়া আরম্ভ করেছে । আমাদের জানা ছিলনা কি হতে পারে। তারাতাড়ি  বের হয়ে হাটা  আরম্ভ করলাম কারন সেখানে কোন ট্যাক্সি ছিলনা আর বাইরের টিকিট কাটার অফিসটা বন্ধ হয়ে গেছে ।

যেতে যেতে পড়লাম এক দল হাতীর সামনে । আমরাকে  দেখে বড়ো বড়ো কান নেড়ে চলে যেতে ইশারা করছে আমরা বুঝতে পারিনি । তখন সেই হাতীর লিডার আমাদের দিকে   তেড়ে আসলো । আমরা প্রাণপণে দ্রুততার সাথে সেখান  থেকে পালিয়ে খুব বেশি দূরত্বে নয়া থাকা হোটেলে ফিরে আসলাম ।

ভিক্টোরিয়া ফলস তো দেখলামই  আর তার সাথে আফ্রিকান বন্য  হাতীর কবলে পড়ার অভিজ্ঞতাও হল ।

লেখকঃ হুসনুন নাহার নার্গিস, লন্ডন

চলবে ...

0 Shares

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ