সন্ধ্যার কিছু পরেই নিয়ম করে ঘুমিয়ে যাওয়া গ্রামটি ক'দিনের জন্যে নিয়মভাঙা গ্রাম হয়ে উঠত।

শহর থেকে আমরা যখন গ্রামে ফিরতাম ঈদ উপলক্ষে, ঠিক তখন। আমাদের ঈদের পোশাক, গ্রামে থাকা আমাদের বু'য়ের শাড়ি, আরও অনেকের জন্যে কেনা উপহার নিয়ে ট্রেনে চেপে গ্রামে যাবার সময়টাতে অদ্ভুত এক সুখানুভূতিতে আচ্ছন্ন থাকতাম। জানালার পাশে বসে দু'পাশের সবুজ ধানক্ষেতের ঢেউ খেলে যাওয়া দেখতাম। সবুজকে, ছোট বড়  গ্রাম'কে পেছনে ফেলে ট্রেন ছুটে চলত, দাদাবাড়ির উদ্দেশ্যে আমাদের ঈদ যাত্রায়। ঈদের দু'দিন আগে থেকেই আমাদের ঈদ শুরু যেন ! 

চাঁদরাতে উঠোনে যখন জ্যোৎস্না ঠিকরে ঠিকরে পড়তো, মায়েরা, চাচীরা গল্পে মেতে উঠত। বাচ্চারা ছুটোছুটি করত। আর আমি দীঘির পাড়ে আমগাছের নিচে পাটি বিছিয়ে গল্পে মশগুল বাবা চাচাদের মাঝে বসে নারকেলপাতা আর শলা দিয়ে তৈরি পাংখা, বাতাসের বিপরীত দিকে ধরে থাকতাম। তার ঘূর্ণন দেখতাম। ঝিঁঝিঁ পোকার অবিরাম ডাক, নাম না জানা ফুলের বুনো গন্ধ আর পাখিদের দিগন্তরেখার পানে উড়ে যাওয়া __ সব মিলে ভিন্ন এক পরিবেশ !

ঈদের ভোর। তখনো আকাশ ফর্সা হয়নি, অথচ গ্রামের সকলের মাঝেই তোড়জোড়, ব্যস্ততা। গোসল করে, নতুন পোশাক পড়ে তৈরি হয়ে দলে দলে ঈদগাহের দিকে ছুটে চলা। বাবার হাত ধরে ছোট্ট আমিও যেতাম। সেখানে মেলা বসতো। মাটির তৈরি হাতি-ঘোড়া, কটকটি, বেলুন আরও কতো কি ! বাড়ি ফিরে বু (দাদী) এর হাতের রান্না খাওয়া, এঘর ওঘর ঘুরে বেড়ানো দিনভর, রাতভর। ভীষণ আনন্দে কাটতো ক'টি দিন। আমার এক চাচা বলতো, "ও নীড়ে বেড়াইতে আসা পাখি, কবে আইছো ?"

শৈশবে আমাদের ঈদগুলো ছিল গ্রামমুখী। নীড়ে বেড়াইতে আসা পাখির মতই।

কৈশোরে বন্ধুবান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী নিয়ে আমাদের শহুরে ঈদ। পুরো পাড়া লাল-নীল-বেগুনী লাইট দিয়ে সাজানো হতো। রাতভোর মাইক বাজানো হতো, কিশোর কুমারের গান হতো। আমাদের কেনাকাটা যেন শেষ মুহূর্তেও শেষ হতো না। পছন্দের নীল জামাটি পাইনি বলে একবার কি ভীষণ কেঁদেছিলাম। অতঃপর শেষ মুহূর্তে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা আমি জামাটি গায়ে দিয়ে নীল পরী হয়ে সারারাত এঘর ওঘর হেঁটেছিলাম। তা দেখে আম্মা বলে, "পাগল হইয়া গেলি নি ?" নির্ঘুম সেই চাঁদরাতগুলো যেন পৃথিবীর দীর্ঘতম রাত ছিল। কেবলই জানালার ওপাশে একলা দাঁড়িয়ে থাকা আকাশ দেখতাম। পূবের আকাশে ভোরের অপেক্ষায়।

ঈদের দিনটি বন্ধুদের বাসায়, পাড়ায় এঘর ওঘর ঘুরেঘুরে খুব দ্রুতই যেন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতো। আমরা আমাদের বিশালাকৃতির কাঠের বাক্সে থাকা ফিলিপস্‌ টিভি সেটের সামনে বসতাম ঈদের দিনের শেষ এবং একমাত্র বিনোদনটুকু পাবার জন্যে। "ঈদ চলে গেলো" এই ভেবে তীব্র মনখারাপ নিয়ে অনুষ্ঠান দেখতাম। ঈদ বিদায়ে বিষণ্ণ হতাম। রাতে ঘুমোতে গিয়ে বাতাসে নড়ে উঠা পর্দার ফাঁক ফোকর গলিয়ে বাইরের আকাশ দেখেও হাহাকার লাগতো__ দিনটি শেষ হয়ে গেল !

এখনো ঈদ আসে, ঈদ যায়।

আটলান্টিকের এইপাড়ে আমার ঈদ হয়। পছন্দের জামাটি কিনে গায়ে দিয়ে এঘর ওঘর হাঁটি। কেউ আমাকে বলে না "পাগল হইয়া গেলি নি ?"। কেউ আমাকে বলে না, "ও নীড়ে বেড়াইতে আসা পাখি, কবে আইছো ?"

এখনো ঈদ আসে।

চাঁদরাতে কংক্রিটের এই শহরে জ্যোৎস্নাও নামে। আমার বেলকণি'তে এককোনে বেত আর লাল-নীল-বেগুনী রং এর কাগজ দিয়ে বানানো একটি "মেইড ইন চায়না"র পাংখা, বাতাসের তীব্রতায় ঘুরে অবিরত। ইজি চেয়ারটিতে বসে আমি তার ঘূর্ণন দেখি। দেখি ধুসর সাদা মেঘের আকাশে দিগন্তরেখার পানে উড়ে যাওয়া একটি একলা পাখি।

ঈদের দিন খাঁ খাঁ রৌদ্র দেখি।

ঈদের রাতে রাতের নিস্তব্দতায়, অন্ধকারে স্মৃতি হাতড়ে "বিদায়" দেখি।

গাঁ'য়ের সরু রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা আমার বু আমাদের বিদায় দিতেন যে ! গাঢ় আবেগে ভেতরটা তোলপাড় করা মায়ায় বারবার পিছু ফিরে চাওয়া এক "বিদায়" ! বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে লাঠি ভর করে দাঁড়িয়ে আঁচলে চোখ মুছতে থাকা "বু" ধীরে ধীরে ছোট হতে থাকে সে বিদায়ে। পাঁচ সদস্যের পরিবারটি ফিরে যাচ্ছে দূরে, আরও দূরে, শহরের দিকে। সরু রাস্তার একপাশে সবুজ ক্ষেত আর অন্যপাশে বহমান নদী। বেঁকে বেঁকে ছুটে চলা স্রোতস্বিনী নদী। পিছনে পড়ে রয় আঁচলে চোখ মুছতে থাকা একলা একজন। আমার বু।

ইট, পাথরের এই শহরে অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে সে বিদায় দেখতে দেখতে অপেক্ষায় থাকি, কখন আকাশ ফর্সা হবে। পূবের আকাশে ভোরের অপেক্ষায়। অতঃপর ভোর এলে ব্যস্ত শহরের যান্ত্রিক মানুষজনের কোলাহলের ভিড়ে আমিও ব্যস্ত হয়ে উঠি প্রতিদিনকার মতন।

রিমি রুম্মান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ