গাছের উপরের গাছকে বলে ‘পরগাছা’। বছরের পর বছর বনের প্রকৃতিতে পরগাছারা বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে। তবে কিছু কিছু পরগাছার জন্ম ও বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে ‘ফুলঝুরি’ (Flowerpeacker) পাখিদের ভূমিকা অনেক।
নিজেদের স্বার্থেই পরগাছা জন্মাতে সাহায্য করে ‘কমলা-নীল ফুলঝুরি’। সংরক্ষিত বনের বিশালাকৃতির কোনো কোনো গাছের উপর শূন্যে রয়েছে অসংখ্য পরগাছা। এই পরগাছার ফুল ও ফল থেকে ফুলঝুরিরা যে মলত্যাগ করে সেখান থেকে জন্ম হয় নতুন পরগাছা। দুর্লভ পাখি ‘কমলা-নীল ফুলঝুরি’। এর ইংরেজি নাম Orange-bellied Flowerpeacker এবং বৈজ্ঞানিক নাম Dicaeum trigonostigma। পাখিটির দৈর্ঘ্য মাত্র ৯ সেন্টিমিটার। আমাদের চড়ুই পাখির মতো। ‘কমলা-নীল ফুলঝুরি’ খুবই দুর্লভ। ‘ফুলঝুরি’ পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন পাখি ‘কমলা-নীল ফুলঝুরি’। আমার প্রথম দেখা ও প্রথম তোলা। সুন্দরবনের করমজল থেকে তোলা ছবি। এপ্রিল-মে প্রজনন মৌসুমে পত্রগুচ্ছ ও সবজির অংশ দিয়ে বাটির মতো বাসা বানায় এবং ২/৩টি ডিম দেয়।
ফুলঝুরিরা বনের বিভিন্ন গাছের উপর ছোট ছোট যে সব পরগাছা জন্মে সেগুলোর পাতা খায় এবং ফুলের মধুও খায়। সব ফুলঝুরিদেরই কিন্তু মূল খাবার গাছের উপরের পরগাছার ছোট ছোট ফল। এ ফলগুলো ওরা খায় বলেই কমলা-পেট ফুলঝুরিরা ওই গাছগুলো লাগায়।
ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, যেখানে ফুলঝুরি পাখিরা আছে সেখানেই গাছের উপরে পরগাছাগুলো আছে। কারণ ওরা ফল খেয়ে মলত্যাগ করলে ওই মল থেকেই নতুন গাছ জন্মে। এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের পরগাছা, এটাকে ‘আমঘরোঞ্জ’ বলে অনেক জায়গায়। বনের ভেতর দেখবেন গাছের উপরে অনেক বড় বড় পাতা হয়; আর অনেক ফুল ফল হয়। ‘আমাদের দেশে যে সাত প্রজাতির ফুলঝুরি (Flowerpeacker) আছে তারা সবাই এমন পরিবেশেই বসবাস করে। ফুলের মধু খেয়ে এরা ফুলের পরাগায়নও করে আবার ফল বিস্তারের মাধ্যমে নিজের এলাকায় নতুন গাছ তৈরিতে প্রত্যক্ষ সাহায্য করে। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের সংরক্ষিত বনগুলোতে হাঁটলে হঠাৎ দেখতে পাওয়া যায় গাছের উপরে গাছ হয়ে আছে অনেক। এভাবে অনেক পরগাছা দেখলে বুঝবেন যে এখানে ফুলঝুরি পাখিরা আছে।
আমাদের দেশের সাত ফুলঝুরিই কিন্তু একই কাজ। অর্থাৎ, ওরা নিজের গাছ নিজেই লাগিয়ে নেয়। গাছের উপরে দারুণভাবে বাগান তৈরি করে তারা। বনের কোনো কোনো বড় গাছের মাথায় শূন্যে বাগান তৈরি হয়ে আছে। এখানেই ওরা বসবাস করে। নিজে ওরা কখনও নামেই না; খুবই কম নামে। যেমন- ‘কমলা-নীল ফুলঝুরি’ তো নিচে একেবারেই নামে না। ওখানেই বসবাস করে, পাতার নিচে বড় বাসা করে; বাবুই পাখির বাসার মতো অনেকটা। ওখানেই ডিম পাড়ে, ছানা ফোটায় এবং ওখানেই কাটিয়ে দেয় পুরোটা জীবন। পাখিটির বেঁচে থাকার কৌশল হলো, গাছের উপরের পরগাছাগুলোর ফুলের মধু কিছু খায় আর পরগাছাগুলোর ফল খায় বেশিরভাগ সময়। ঝাঁকড়া ঘন হয়ে পরগাছাগুলো যেখানে রয়েছে সেখানেই ফুলঝুরিদের সারাক্ষণ আনাগোনা। ঝোপের মধ্যে অথবা লম্বা একটা পল্লব পেলেই সে ওখানে লুকিয়ে যায়। ছোট পাখির তো অনেক শত্রু। তবু সে কৌশল করে সাবধানে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে প্রকৃতিতে। বিপদ টের পেলে পাতার ফাঁকে ফাঁকে নিজে আড়াল করে ফেলে সে। সেজন্য আমরাও তাদের সহজে খুঁজে পাই না। তাদের দেখতে হলে বেশ কষ্ট করতে হয়।’ বনের গাছের উপরের থাকে বলে মানুষ চেনেই না ‘ফুলঝুরি’দের। বিশেষ করে ‘কমলা-নীল ফুলঝুরি’ পাখিটিকে খুব কম লোকই দেখেছেন। এরা পাহাড়ি বনের পাখি। সিলেট-চট্টগ্রামের সংরক্ষিত বন ও সুন্দরবনেই শুধু তাদের দেখা যায়। লাখ লাখ ‘কমলা-নীল ফুলঝুরি’ রয়েছে ওই তিনটি স্থানের বনাঞ্চলে কিন্তু কেউ দেখেনি। তার একটাই কারণ, তারা গাছের উপরের পরগাছাতে থাকে বলে।
লেখাটি পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। ভালো থাকুন
সুন্দর থাকুন।
0 Shares

৩১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ