নীল ডায়েরি (প্রথম পর্ব)

ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন ২৭ নভেম্বর ২০১৫, শুক্রবার, ০৯:৪৬:৪০অপরাহ্ন গল্প ২ মন্তব্য

“ ডায়েরি লেখার অভ্যাস কোনকালেই ছিল না আমার। এমনকি আমি যে খুব ভালো লিখি সেটাও না। স্কুল-কলেজে বাংলা-ইংরেজি পরীক্ষা পার করে এসেছি বেশ আতঙ্কের সাথে। সেসব কথা থাকুক।

নিয়তির জেরে এখন আমি এই কাজটাই করছি। আমার শরীরের প্রকৃত অবস্থা জেনে এসে আজ কেন জানি নিজের জীবন নিয়ে লিখতে মন চাচ্ছে!

একাকী নিঃসঙ্গ জীবন যে কতটা ভয়াবহ যে এটায় না পড়েছে কখনো বুঝবে না। কর্মব্যস্ত মানুষেরা অনেক সময়েই ভাবেন, ‘ ইশ! সব ছেড়ে যদি বনবাসে থাকতাম। ’
আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলছি বনবাসে থাকার দরকার নেই। সর্বোচ্চ ৩ দিন আমার মত থাকলেই বুঝবেন। তখন সব ছেড়ে ছুড়ে দৌড়াবেন ওই কর্মব্যস্ত জীবনেই।

ভূমিকা বেশি বড় করতে চাই না। সেদিন এক সেমিনারে হটাৎ করেই পেয়ে গেলাম একটা নীল ডায়েরি। অনেক ডায়েরি পেয়েছি এই ১১ বছরের চাকরির জীবনে। কিন্তু এরকম কোন নীল ডায়েরি পাইনি। কোথায় জানি পড়েছিলাম বেদনার রঙ নাকি নীল হয়! আমার জীবন পুরোই এক বেদনাগাথাঁ।

আমার বেদনাগাথাঁ কেউ পড়বে কিনা জানি না, কিন্তু একাকীত্ব কাটানোর এক মাধ্যম পেয়েছি আমি।
- মোঃ আশরাফুল ইসলাম রতন
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, নোয়াখালী জেলা পুলিশ, নোয়াখালী। ”

এতক্ষণ এই পুলিশ কর্মকর্তার নীল ডায়েরির ভূমিকাটা পড়ছিলাম। হাসপাতালের ডাইরেক্টর জরুরি মিটিং-এ আছেন। বসে থাকতে হবে আরো অনেকক্ষণ। সময় কাটানোর জন্য ভূমিকাটা পড়ে পাতা উল্টে প্রথম পাতা থেকে পড়া আরম্ভ করলাম।

*********************
১২.৭.২০১৫

কখনো ডায়েরি লিখিনি। তাই কিভাবে শুরু করব জানি না।
তবে আজকে কেন যেন বাবার কথা খুব মনে পড়ছে! বাবাকে হারিয়েছি আজ প্রায় ১৬ বছর হতে চললো। সে সময় ঢাকা ভার্সিটিতে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি আমি। দিনটি আমার স্পষ্ট মনে আছে।

আমার স্বল্প বেতনের সরকারি চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী বাবা সেদিন হটাৎ-ই স্ট্রোক করে মারা যান। গ্রাম থেকে জীবিকার তাগিদে শহরে আসা বাবা তার স্ত্রী আর একমাত্র সন্তানের ভরণপোষণ জোগাতে এতটাই হিমশিম খেতেন যে গ্রামের আত্মীয়দের খবর নেওয়া হত না। ফলাফল আত্মীয় স্বজন বলতে তেমন কেউই ছিল না। কয়েকজন প্রতিবেশি, বাবার কলিগরা কেবল এসেছিলেন। বাবার মৃত্যুর খবরে সরকারি কয়েকজন কর্মকর্তাও এসেছিলেন। তাদের দেওয়া টাকাতেই মোটামুটি দাফন-কাফনের ব্যবস্থা হয়ে গেল।

আমার মার কথা স্পষ্ট মনে আছে। অদ্ভুতভাবে নিজেকে ধরে রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু আমার দিকে তাকিয়ে বারবার বলছিলেন, “ আজ থেকে তুই অনাথ হয়ে গেলি রে! এখন তোর কি হবে? ” নিজের স্বামীকে হারিয়েও তিনি সন্তানের কথা, তার ভবিষ্যতের কথা ভুলতে পারেন নি। এগুলো বোধহয় একমাত্র মা-দের দ্বারাই সম্ভব হয়।

বাবা মারা যাওয়ার পরে ভীষণ অর্থকষ্টে পড়তে হয়েছিল আমাদের। সরকারি বাসা গেল। মা-ও ভীষণ অসুস্থ ছিল। বাবার সামান্য পেনশনের টাকা আর আমার টিউশনির টাকা, এই দুইয়ে কোনমতে চলছিল দিন।

আমার অনেক বড় অনুপ্রেরণা ছিল আমার মা। কিন্তু অনার্স থার্ড ইয়ারে থাকতে তিনিও মারা গেলেন। ক্যান্সার হয়েছিল, চিকিৎসার টাকা আমি জোগাড় করতে পারিনি। আমার মা আমার কষ্ট হবে বুঝে প্রথমে ডাক্তারকে নিষেধ করেছিলেন যেন আমাকে না জানানো হয়।

সারাজীবন সন্তানের জন্য কষ্ট করে যাওয়া মা নিজের জীবনটাও সন্তানের জন্য দিয়ে গেছেন। মা-বাবা হারা আমি বুঝি তাদের কি মূল্য !
আমি .........

নাহ এখন আর লিখতে পারছি না। চোখ ফেটে কেন জানি কান্না আসছে। পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই। আমি একাকী, আমার কান্না কেউ দেখবে না। কিন্তু কাদঁতে আমার ইচ্ছা হচ্ছে না।

কান্না পাচ্ছে কিন্তু জেদ চেপে গেছে ...
আমি কাদঁবো না ... কোনভাবেই না ...

১৬.৭.২০১৫

আজ আমার জন্মদিন। হ্যাপি বার্থ ডে টু মি!
হাহাহা! একা একা বার্থ ডে সেলিব্রেশন!
বাবা থাকতে অবশ্য কিছু না কিছু গিফট পাওয়া হত। বাবার মৃত্যুর পর অবশ্য আমার জন্মদিনের কথা ভুলেই গেছিলাম। হয়তো পুরোপুরি ভুলে যেতামও!

কিন্তু একজনের জন্য অবশ্য মনে আছে এখনো।
সেই একজন!

আমার নিঃসঙ্গ জীবনের একমাত্র সাথী ছিল। আমার ভার্সিটির ক্লাসমেট। কথায় আছে সমবয়সী প্রেম করতে নেই। অথচ চরম বাউণ্ডুলে আমি সেই কাজটাই করে বসেছিলাম। বাবা-মার মৃত্যুর পর আমার জীবনের একমাত্র প্রেরণা ছিল সে-ই। পরিচয় হয়েছিল ক্লাসের মধ্যেই। সবার থেকে একটু দূরে দূরে থাকতাম প্রথম প্রথম। ওই এসে পরিচিত হয়েছিল। পরে অনেক ভালো বন্ধুত্ব হয় ... কিভাবে যে পরের দিনগুলো কেটে যায় আমার! স্বপ্নের মত দিন ছিল সেগুলো।

সিদ্ধান্ত নেই যদি আমি প্রতিষ্ঠিত হতে পারি তবেই তাকে জানাব মনের কথা। মা-বাবাহীন এতিম এক ছেলে আমি। জানি না কিভাবে নিবে সে অথবা তার পরিবার, সত্যিই জানতাম না।

সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে চাকরি করা আমার বাবা সবসময় আমাকে একজন সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখাতেন। ভার্সিটি পাশ করে তাই বিসিএসের জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলাম। সারাটা জীবন কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাওয়া আমি কিভাবে যেন ভাগ্যের সহায়তায় চান্স পেয়ে যাই। স্বাভাবিকভাবেই আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট ছিল সেটা।

১৯.৭.২০১৫

বিভিন্ন কারণে ব্যস্ত ছিলাম, নিজের চিকিৎসা নিয়েই দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে অনেক। জরুরী কাজে ঢাকা যেতে হয়েছিল। গিয়েছিলাম আমার স্মৃতিজড়িত ক্যাম্পাসটায়। কেন জানি তার কথাই বেশি মনে পড়ছিল। আমাদের ভালোবাসার বীজের অঙ্কুরুদগম হয়েছিল সেখান থেকেই দেখে বোধহয়!

তাকে প্রপোজ করার ঘটনা এখনো মনে আছে আমার ... ‍
আমি যেবার বিসিএস দিয়ে পুলিশে জয়েন করলাম সেবার পহেলা বৈশাখের সময়ে একদিন তার ফোন আসলো ...

“ পহেলা বৈশাখে কি করবি ? ”
- একলা একলা ঘরে বসে টিভি দেখবো আর ঘুমাবো।
- বের হবি না ?
- নাহরে আমার কপালে ওইসব নাই।
- কেন ?
- গার্লফ্রেন্ড নাই যে তাই
- আমি আছি না ?
- তুই ?
- হ্যা। আমি তোর ফ্রেন্ড। আর আমি যেহেতু মেয়ে সেহেতু তোর গার্লফ্রেন্ড।
- তুই পোলা না মাইয়া সেইটা নিয়ে মাঝে মধ্যেই কনফিউশনে পইড়া যাই।
- কি ?

“ না কিছু না ... আসলে তোর বয়ফ্রেন্ড হওয়ার চেয়ে কোন ছেলের জন্য গলায় দড়ি দিয়ে মরা সহজ। ”
- আমি এতই খারাপ ?
- হু ...
- যাহ তোর সাথে আর কথা নাই।
- আরে আরে ...

টুট টুট ... ফোনটা কেটে গেছে।
মেয়েটা যে কি ! এতটুকুতেই রেগে ফায়ার !

মেয়েটার সাথে পরিচয় দুই বছর ধরে। অনেক ভালো একটা মেয়ে। ভাবছি কি করে মেয়েটাকে চমকে দেওয়া যায়। সিদ্ধান্ত নেই, কালকেই জানিয়ে দিব মনের কথা।

মোবাইলে মেসেজ দিলাম, “ কালকে সকাল ১০টায় কলেজ গেটের সামনে থাকিস। তোর সাথে কথা আছে। ”
কোন রিপ্লাই এলো না। যদিও ভালো করেই জানি মেয়েটা অবশ্যই যাবে। আমার মেসেজ মেয়েটি কোনভাবেই ফেলতে পারবে না।

পরদিন পহেলা বৈশাখ ... লাল রঙের একটা পাঞ্জাবি, সাথে সাদা পায়জামা পড়ে রওনা দিলাম। গত বছরে ওই গিফট দিয়েছিল।

কলেজ গেটের সামনে এসে দেখি লাল সাদা শাড়ি পড়ে এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শাড়িতে এমনিতেই বাঙালী নারীদের রূপসী লাগে আর এই মেয়েকে তো মনে হচ্ছে আসমান থেকে নেমে আসা কোন পরী !

“ শুভ নববর্ষ, নিশি! ”
- শুভ নববর্ষ।
বেশ গম্ভীরভাবে জবাব দেয় মেয়েটা।

- এখনো রাগ করে আছিস ?
উত্তর নেই কেবল মাথা নাড়ায় নিশি।

সাথে করে আনা গোলাপটা বাড়িয়ে ধরে বললাম ...
“ আই ... আই লাভ ইউ ! ”

- বুদ্ধু !! আজকে কি রোজ ডে, নাকি ভ্যালেন্টাইন্স ডে যে গোলাপ আনছোস ?
- তো আর কি আনবো ?
- ইলিশ আনতে পারলি না ?
- ইলিশ !
- হু। আর এমনে প্রপোজ করলে আমি তো দূরে থাক রাস্তার কুত্তাও তোরে লাত্থি মারবে।
- তাইলে কেমনে কি ?
- অন্যভাবে কর।

“ আচ্ছা ...
তুমি আমার ঘুম, তবু তোমায় নিয়ে স্বপ্ন দেখি না
তুমি আমার সুখ.. তবু তোমায় নিয়ে ঘর বাঁধি না
তুমি আমার খোলা আকাশ.. কখনো সূর্য দেখি না
তুমি আমার দিন থেকে রাত..
আমি যে সময় জানি না……. "

- ফালতু ! আমি তোর ঘুম হইতে পারবো না, তুই যে মরার মত ঘুমাস !

“ তুমি আমার পহেলা বৈশাখের ইলিশ মাছ, তবু তোমায় আমি রান্না করে খাই না
তুমি আমার ভ্যালেন্টাইনস ডের গোলাপ, তবু তোমায় নিয়ে কাউকে প্রপোজ করি না
তুমি আমার কোরাবানীর গরু, তবু তোমায় কোরাবানী দিয়ে ওয়াজিব পালন করি না
তুমি আমার যে আর কত কি তা আর বলতে পারবো না। ”

- হারামি, কুত্তা, বদমাইস, ইতর ! আমি তোর কোরাবানীর গরু ? আজকে তোর একদিন কি আমার একদিন !
- হেহেহে ! গালি দেখি ফোর ইন ওয়ান প্যাক হয়ে গেছে।
- আবার দাঁত কেলাস কেন ?
- এমনি। আই লাবু

এবার একটু লালচে আভা নিশির চেহারায় !
তারও বলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু ...
কিন্তু পারছে না, ভীষণ লজ্জা হচ্ছে তার !

আজ আর নাই লিখি। স্বপ্নের জগতে গিয়ে এভাবে বাস্তবতার নির্মম জগতে ফিরে আসতে কারই বা ইচ্ছা করে!

*********************
এতটুকু পড়েই তাকালাম কক্সবাজারে নবনির্মিত বাংলাদেশ সম্মিলিত ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারের ডাইরেক্টর ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল ডাঃ শাহজাহান সিরাজের দিকে। জরুরি মিটিং শেষে মাত্রই ফিরে এসেছেন উনি। ভীষণ ব্যস্ত মানুষ।

আজ সকালে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপারকে উনি ফোন দিয়ে তার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার নিখোঁজ হওয়ার খবর জানান। অবশ্য উনি যে ইচ্ছাকৃতভাবে গেছেন সেটা স্পষ্ট। কিন্তু নিজের রোগীর এধরণের হেয়ালিপনা ব্রিগ্রেডিয়ার ডাঃ সিরাজের পছন্দ হচ্ছে না। সেজন্যই আমার ডাক পড়েছে।

কক্সবাজারে নবনির্মিত বাংলাদেশের এই ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টার দেশ তো বটেই পুরো দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সেরা। ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য এ প্রতিষ্ঠানে রয়েছে দেশের সবচেয়ে দক্ষ জনবল, অত্যাধুনিক সরঞ্জামাদি। সামরিক ও সরকারি বেসামরিক চিকিৎসক, কর্মকর্তাদের সম্বন্বয়ে গড়ে উঠেছে পরিচালনা পর্ষদ।

“ ডায়েরিটা পড়ে কি বুঝলেন? ” - জিজ্ঞেস করলেন উনি।
- আহামরি কিছুই পেলাম না এ পর্যন্ত।
- যাই হোক, অফিসার ওনাকে খুঁজে বের করেন। ওনার কেস বেশ ক্রিটিকাল কিন্তু ডাক্তার ওনাকে সুস্থ করে তোলার ব্যাপারে আশাবাদী। আর ওনার শরীর যেভাবে রেসপন্স করছিল তাতে করে তাকে নিরাময় করে তোলা গেলে বিশ্বজুড়ে ক্যান্সারের চিকিৎসার বিপ্লব ঘটে যাবে। আশা করি বুঝতে পারছেন আমার কথাটা।
- জ্বি খুব ভালো করেই।
- ধন্যবাদ। কষ্ট করে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছেন।
- ঠিক আছে। আমাদের ডিউটিই এটা। আসি তাহলে।
- জ্বি।

গতবারেই বিসিএস দিয়ে পুলিশের এএসপি হিসেবে জয়েন করার পর পোস্টিং হয়েছ কক্সবাজারের জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে। স্বেচ্ছায় নিরুদ্দেশ হওয়া এক সিনিয়র পুলিশ অফিসারকে খুঁজে বের করব কি করে!

আচ্ছা! উনি কেন এরকম নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন ? ওনার প্রিয়তমাই বা কোথায়?
জানতে হলে পড়তে হবে ডায়েরিটা ...

(চলবে)

0 Shares

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ